প্রয়াত আলহাজ্ব আবুল কাশেম পিতা মৃত মহির উদ্দিন মন্ডল। পালাক্রমে বংশধর মহির উদ্দিন মন্ডলের পিতা মরহুম হাবেজ মন্ডল, মরহুম হাবেজ মন্ডলের পিতা মরহুম তাজু মন্ডল।
১৮০০ সালের কথা। মরহুম তাজু মন্ডল এর আসল নাম ছিল তাইজুল চৌধুরী। তিনি ছিলেনে কালিবাড়ী কয়ড়া এলাকার চৌধুরী বংশের সন্তান। বর্তমানে চৌধুরী বংশের যিনি সম্মানিত ব্যক্তি জীবিত আছেন উনার নাম সম চৌধুরী অর্থাৎ সামস উদ্দিন চৌধুরী।
তৎকালীন সময়ে কয়ড়া বাজারের আশেপাশে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিলনা কিন্তু গুনারীতলা গ্রাম ছিল ঐতিহ্যবাহী এলাকা। এখানে সব ধরনের প্রতিষ্ঠান ছিল। তাই তাইজুল চৌধুরীর বাবা সন্তানের লেখাপড়ার সুবাধে গুনারীতলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করে দেন।
সেকালে লজিং এর ব্যপক প্রচলন ছিল। গ্রামে যারা বিত্তবান ছিলেন বিদ্যালয়ের কমিটি তাদেরকে একজন করে ছাত্র লজিং রাখতে দিতেন। সে সুবাধে তাইজুল চৌধুরী গুনারীতলা উত্তর পাড়ার মফিজ পন্ডিত এর বংশে লজিং থাকা শুরু করেন।
যখন তিনি যুবক তখন একটা মেয়েকে পছন্দ করেন এবং পচ্ছন্দের কথা বাড়ি গিয়ে তিনি প্রথমে তার মাকে জানান। মা জানতেন তার বাবা কিংবা বড় ভাই এ কথা কখনই মেনে নিবে না। তবুও সন্তানের বিশেষ অনুরোধে একদিন তাইজুল চৌধুরীর মা’ তাইজুলের বাবা ও বড় ভাইকে কথাটি জানিয়ে দেন।
কথাটা শুনা মাত্রই বাবা যথেষ্ট রেগে যান। রেগে যান বড় ভাইও। শুধু রেগে গিয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি রীতিমতো প্রহারও করেছেন ছোটভাই তাইজুলকে। তাইজুল প্রহারিত হয়ে ক্ষুব্ধ মনে চলে আসেন লজিং বাড়ি। এসে লজিং দাতার কাছে বিস্তারিত খুলে বলেন।
লজিং দাতাও ছিলেন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের অধিকারী তাছাড়া তাইজুলকে তিনি ছেলে হিসেবেই মহব্বত করতেন। সন্তানতুল্য ছেলে তাইজুল চৌধুরীর পিতার সকল দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন এবং তাইজুলের জন্য মেয়ের বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যান। তৎকালীন সময়ে মেয়ের বংশধরও ছিল প্রভাবশালী। বর্তমান তাদের বংশধর আব্দুল হাই মাতাব্বর এর বাপের ফুপুর সহিত তাইজুল চৌধুরীর বিয়ের ব্যবস্থা করেন। বিয়ের পর তাইজুল চৌধুরীকে সবাই তাজু নামে ডাকতে শুরু করেন।
সময় যাচ্ছে তো যাচ্ছে। তাইজুল থেকে তাজু মন্ডল নামের টগবগে যুবক ছেলেটি ঘরজামাই হিসেবে থাকতে থাকে। একদিন তাজু মন্ডলের দাদী শাশুড়ী তাজুকে মশকরা করে বলে, ‘এই যে নাতিন জামাই সারা জীবন কি এভাবেই ঘরজামাই থাকবেন। একটা কিছু করতে হুবেনা’।
শুনেছি আপনার বাবা বেশ নামীদামি মানুষ চৌধুরী বংশ। ছেলের দাবি নিয়ে উনার কাছে যান কিছু নিয়ে আসেন। তাইজুল মনে মনে ভাবেন বাবার কাছে যাওয়ার সাহস তার কোনদিনই হবেনা আর বড় ভাইকেতো কোন দিন সে মুখ দেখাবেননা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন, কিন্তু আমি কি করে যাবো আমারতো যাওয়া নিষেধ আছে ওখানে। তখন বুদ্ধিমান দাদী শাশুড়ী বুদ্ধি এটে দিয়ে বলেন, শুনেন নাতিন জামাই আপনিতো আপনার মা’য়ের খুব আদরের সন্তান মায়ের কাছে একদিন রাতের আঁধারে যান। গিয়ে আপনার কষ্টের কথাগুলো বলেন কাজ হবে।সেকালে সিন্দুকের দায়িত্বে পরিবারের যিনি কর্তৃ উনার কাছেই থাকতো।
দাদী শাশুড়ীর কথামত একদিন রাতের অন্ধকারে তাইজুল মায়ের ঘরে গিয়ে দরজায় আস্তে আস্তে টুকা দেয়। মা দরজা খোলার আগে জিজ্ঞেস করে কে তুমি। তাইজুল চুপিসারে উত্তর দেয়, মা আমি তাইজুল। তুমি কিন্তু জোর স্বরে কান্না করবেনা তাহলে আমার মুখ দেখতে পারবেনা। আমি কিন্তু চলে যাবো। সাবধানে দরজা খুলো মা, বাবা যেন টের না পায়।
মা চুপিসারেই দরজার কপাট খোলে। নীরবে অন্ধকারে ছেলের মুখমণ্ডল হাতিয়ে দেখে আর নীরবেই কাঁদে। কিছুটা সময় চুপিচুপি তার কুশলাদিও জিজ্ঞেস করে মা। তাজু এবার দাদী শাশুড়ীর শিখিয়ে দেয়া মন্ত্র কাজে লাগায় বলে, মা আমি যে বিয়েটা করে ফেলেছি। এখন আমার যে নিজের বলতে কিছুই নেই। না আছে জমিজমা না আছে টাকাপয়সা। তুমি আমাকে কিছু দিয়ে সাহায্য কর মা। সব কিছু শুনে মা এবার সিন্দুক থেকে কাঁচা টাকার একটা পোটলা বের করে তাজুর হাতে ধরিয়ে দেয়। তাজু রাতের আঁধারেই ফের চলে আসে গুনারীতলা গ্রামে শশুর বাড়িতে।
সেই টাকা দিয়ে তাজু শুরু করেন জমি কেনা। যেখানে যেভাবে যত টুকু জায়গা পান কিনতে থাকেন তিনি। একএক করে তাজুল অনেক একর সম্পত্তি মালিক হন।
বিয়ের কিছু দিনের মধ্যে তার ঘরকে আলোকিত করে এক ছেলে সন্তান আসে। নাম রাখেন আজিম মন্ডল। তারও কিছুদিন পর ঘরকে আলোকিত করে আসেন আরেক ফুটফুটে ছেলে সন্তান নাম রাখেন হাবেজ মন্ডল। হাবেজ মন্ডলের পর জন্ম নেন এক কন্যা সন্তান। নাম রাখেন মায়মুনা।
পরবর্তীতে বড় ছেলে আজিম মন্ডলের ঘরে আসে ৫ ছেলে। অন্যদিকে হাবেজ মন্ডলের ঘরে পরপর কয়েক সন্তানের জন্ম হলেও তারা অকালেই মৃত্যুবরণ করে। পরে এক ছেলে সন্তানের আগমন ঘটলে বাবা হাবেজ মন্ডল নাম রাখেন মহির মন্ডল সবাই মইরে বলে সম্মোধন করতো।
মহির মন্ডল হাবেজ মন্ডলের একমাত্র সন্তান। পরবর্তীতে মহির মন্ডলের ঘরে জন্ম নেয় দুই ছেলে পাঁচ মেয়ে। বড় ছেলের নাম আবুল কাশেম। কিছুটা বিদ্যা শিক্ষা করায় এলাকার লোকসকল তাকে সরকার উপাধি দেয়। নাম হয় আবুল কাশেম সরকার।
মরহুম আবুল কাশেম সরকারের তিন ছেলে দুই মেয়ে। বাবা মহির উদ্দিন মন্ডল খুব সহজ সরল মানুষ ছিলেন বলে তার বিশাল সম্পত্তিতে লোকসকল জোরপূর্বক দখল দারিত্ব শুরু করলে আবুল কাশেম সরকার ছোট বয়সেই সংসারের হাল ধরেন। পারিবারিক ভাবে ব্যবসার জন্য বিশাল আকারের একটা নৌকা ছিল। আবুল কাশেম সরকার সংসার দেখার পাশাপাশি বাবার ব্যবসাতেও নিজেকে মনোনিবেশ করেন।
পরবর্তীতে যখন তিনি সয়ংসম্পূর্ণ হন দীর্ঘ কাল ব্যবসার সাথেই জড়িয়ে ছিলেন। শতশত মন পাট নৌকায় বুঝাই করে প্রথম দিকে সরিষাবাড়ির জুটমিলে পরবর্তীতে নারায়ণগঞ্জ জুটমিলে সরবরাহ করতে থাকেন। এতোটাই পাট ব্যবসার সাথে মিশে গিয়েছিলেন যে আবুল কাশেম সরকারকে এলাকার লোকজন ডান্ডি উপাধিতে ভূষিত করেছিল।
১৯৮৩ সালে তিনি মেম্বার পদপ্রার্থী হন। এবং যৎসামান্য ভোটের ব্যবধানে হেরে যান তিনি।
জনাব আবুল কাশেম সরকার এর নানা নাড়ি গুনারীতলা পশ্চিম পাড়া। প্রফেসার বাড়ির প্রয়াত সিরাজুল ইসলাম সাহেব (যিনি দুর্নীতি দমন বুর্যোর পরিচালক ছিলেন) তিনি আবুল কাশেম সরকারের আপন খালাতো ভাই।
আবুল কাশেম সরকার বিয়ে করেন দক্ষিন পাড়ার তাহের দারোগার ভাগ্নিকে প্রয়াত অহেদুজ্জামান অহেজ ও প্রয়াত সিরাজুল ইসলামের সর্ব কনিষ্ঠ বোন সমত্ত ভানকে।
আবুল কাশেম সরকার যথেষ্ট ধর্ম ভীরু ও একজন পরহেজগার মানুষ ছিলেন। সত্যবাদী ও সমাজের ন্যায় বিচারক ছিলেন। তিনি কওমী মাদ্রাসাকে মনেপ্রাণে ভালোবাসতেন। সারাজীবন তিনি অত্র মাদ্রাসায় খেদমত করে গেছেন। এবং দক্ষিন দোয়ারী মাদ্রাসার দু’তলা ছাঁদের জন্য সেকালে বড় বড় দু’টি গরু এবং ত্রিশ হাজার টাকা দান করেন। অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিও তার দানের হাতটি ছিল সুদুর প্রসারী।
তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ব্যবসার কাজে সরিষাবাড়ি গেলে সেখানে পাক হানাদারদের হাতে ধৃত হন। তার সাথে ধরা পড়েছিলেন আরেকজন ব্যবসায়ী। দু’জনকেই গাছের সাথে বেঁধে ফেলা হয়েচহিল। রাইফেল তাক করা হয়েছে। ঠিক এমন সময় মহাজন দোড়ে আসে ঘটনাস্থলে। বলে, বাবু বাবু ওরা আমার লোক। অল্প থেকে দু’টি প্রাণ জানে বেঁচে যায়।
নিজের একক প্রচেষ্টায় হজ্জে যাওয়ার কিছুদিন পূর্বে গ্রামের মাটিতে একটা মসজিদ ঘর নির্মান করেন। এরপর পবিত্র হজ্জ পালন করে দেশে এলেও যতদিন তিন বেঁচে ছিলেন মসজিদে মসজিদে দ্বীনের খেদমত করেই অবশেষে ২০১৩ সালে ১৭ই জুন শুক্রবার মসজিদে যাওয়ার নিয়তে ওযু করতে বের হন। এরপর কলপাড়ে পড়ে গেলে লোকসকল ধরাধরি করে ঘরে নেন। ঘরে নেয়ার কিছুক্ষণ পরই তিনি ইহধাম ত্যাগ করেন। ইন্না.. রাজিউন।
তার কবরটি তার নিজহাতে গড়া বর্তমানে উত্তরপাড়ার হাজি বাড়ি মসজিদ সংলগ্ন রাস্তার পশ্চিম পাশে উচু তালগাছটির সাথেই অবস্থিত। আমি উনার সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। আমার নাম নুর মোহাম্মদ। আমার ফেইজবুক আইডির নাম Noor MD Chowdhury,। অত্র গুনারীতলা গ্রামের ছোট বড় সবার কাছে বিনীত অনুরোধ করি আমার বাবার জন্য সকলেই প্রাণখুলে দোয়া করবেন যেনো আল্লাহ মহান রাব্বুল আলামিন বাবাকে মাফ করেন এবং বেহেস্ত নসিব করেন। আমীম