Home অন্যান্য পোস্ট মাস্টার

পোস্ট মাস্টার

নুর এমডি চৌধুরী

0

স্থান গুনারীতলা বাজার। আশির দশকে মানুষের মনের ভাব আদান প্রদানের একমাত্র অবলম্বন ছিল পোস্ট অফিস। আমি তখন খুব ছোট। বড় ভাই সবে মাত্র মেট্রিক পাশ করে সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে যোগদান করেছে। মাকে দেখতাম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে রোজ কাঁদতে। কখনও আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে কখনও জোরস্বরে হাউমাউ করে কাঁদতে দেখে আমিও ঠিক থাকতে পারতাম না মায়ের মত আমিও হাউমাউ করে কেঁদে দিতাম। সেদিন মায়ের কান্নার অর্থ বুঝতাম না, আজ বুঝি।

মা আমার কান্না দেখে খুব সযত্নে বোকে জড়িয়ে নিতেন। নিজের চোখ দু’টো মুছে একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও হয়তো হাসির ভান করতেন বলতেন, খোকা, তুই কান্দিস ক্যান। তোর আবার কি হইলো আমারতো কিছু হয়ন নাই বাপ। ঐযে তোর দাদুভাই চাকুরীতে গেছেনা অনেক দিন হয় কেমন আছে তার কিছুই জানিনা তাই খুব ফাফুরে একটু কান্দি, তুই কান্দস ক্যান। ফাফুরে ফাফুরে কখন যে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলি বুঝতেই পারিনা। মায়ের কথা গুলো বলার ফাঁকেও দেখতাম দীর্ঘশ্বাস আর দু-চোঁখ ভরে অশ্রুর ছলছল করা।

মায়ের কান্না বলে কথা। আমি যেন ফের কান্নার বেগ বাড়িয়ে দিতাম। আর মা তখন শত কষ্টের মাঝেও সুখের হাসি হাসতেন বুঝতাম এ হাসি অন্ততের কোন হাসি নয় এ হাসি একান্তই ফেক শুধুমাত্র আমাকে শান্তনা দেবার হাসি। কান্নার মাত্রা যদি অধিক হইতো মায়া দিয়ে বোকে জড়িয়ে নিয়ে বলতেন মা, আয় বাবা কোলে আয় তোকে ঘুম পাড়ানোর গান শুনিয়ে দেই। বলেই কোলে জড়িয়ে নিয়ে দু’গালে পরপর চুমু দিয়ে যেতো।

প্রতিদিন পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকতো মা। আমিও মায়ের আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে থাকতাম রোজ। পরিচিত কারও দেখা পেলেই মা’কে দেখতাম ঘোমটাটা লম্বা করে টেনে জিজ্ঞেস করছে ছোট হলে নাম ধরে বড় হলে সন্মোধন করে কে’গো পোষ্ট অফিসে গেছিলা? কেউ বলতো হ্যাঁ কেউ বলতো না। এমনিভাবে প্রতিটা দিনই যেন ছিল মায়ের অফিসিয়াল ডিউটি। সেকালে পোস্ট মাস্টার ছিলেন আমার সম্পর্কে দাদা। মুন্সীবাড়ির হযরত আলী মাস্টার আমাদের বাড়ীর পেছনেই ছিল দাদার বাড়ি। একদিন মা আমাকে নিয়ে পোস্ট মাষ্টার দাদার কাছে গেলেন। আমাকে পাশে রেখে অনেকক্ষণ সুখ দুঃখের আলাপচারিতা করলেন। সময় প্রায় ঘণ্টা খানেক গড়িয়ে গেলো এর মধ্যে মা’কে দেখলাম অনেকবার কাঁদতে আজ ভাবতেই শিহরিত হই। মা যতক্ষণ কথা বলছিলেন দেখেছিলাম প্রতিটি কথাই ছিল মায়া কান্নায় ভরা দাদার প্রতি অনুনয় আর বিনয়ের প্রত্যাশা।

সেকালে ছোট ছিলাম অনুনয় বিনয় এর গহীন বাস্তবতা বুঝে উঠতে পারিনি কিন্তু আজ তা পরতে পরতে অনুভব করি, বুঝি। একজন মাতৃ হৃদয় সন্তানের জন্য কতটা যে মমতার হতে পারে তা কেবলি প্রত্যক্ষদর্শি না হলে কেউ বুঝতেই পারবেনা। মাঝে মধ্যে মা কেঁদে ফেললে দাদাকে দেখতাম সান্ত্বনার সুরে বলতে, বউমা কান্না থামাও! ধৈর্য ধরো। এতো ভেংগে পড়লে কি চলে। দেখি কাল ওকে আমি একটা টেলিগ্রাম পাঠাই।

এবার মাকে দেখতাম খুব খুশি হয়ে উঠতে আর শাড়ীর আঁচলে বেঁধে রখা কিছু সিকি আধুলির গিট্টু দাঁত দিয়ে খুলছে। কিছু একটাকার কিছু পঞ্চাশ পয়সার পঁচিশ পয়সার দশ পয়সার কয়েন যা ছিল দাদার হাতে গুজে দিয়ে বলতো কাকা মশাই বাকীটা পরে দিবো।

সময় যেতে লাগলো সময়ের নিয়মে। আমি যখন কিছুটা বুঝতে শিখলাম। মা তখন আমাকেই দাদার কাছে পাঠাতে শুরু করলেন। কখনও বাড়িতে কখনও পোস্ট অফিসে যেখানেই থাকতেন দাদা আমি নতশিরে জড়তা আর সংকোচে দাদার পাশে গিয়ে দাঁড়াতাম। আমাকে দেখেই দাদা মুচকি একটা হাসি দিতেন। যে হাসিটার মূল্য লক্ষ টাকা। হাসিটা দেখলেই পরান জোড়ায় যেত। দাদা হাসলেই যেন সুন্দর মুখখানা লাল হয়ে উঠত। আর মুক্তোর দানার মত সাদা পাটি পাটি দাঁতগুলি ঝিকঝিক করত। মুখ ভরা পাকা পাকা দাঁড়ি ছিলো তার। দেখতাম সব সময় আয়রন করা দামী সাদা রঙের পাঞ্জাবি আর পাজামা পরতেন। দাদা যখন হাসতেন তার মিষ্টি-মাখা হাসির সহিত জেনো পরিধানের সাদা জামা গুলোও হাসছে হাসতে থাকতো। যা হোক যদি চিঠি থাকতো তবে হাসির পাশাপাশি দুই একটা রসিক কথা বলে চিঠিটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলতেন, তাড়াতাড়ি বাড়ি যা। আর সাবধানে নিয়ে যাইস চিঠিটা। আর চিঠি যদি না থাকতো সোজা বলে দিতো কোন খবর নাইরে দাদা। কিছু খাবি? আমি মাথা নাড়িয়েই ফের দৌড়াতে দৌড়াতে মায়ের কাছে ছোটে যেতাম। আমার শূন্য হাতখানা দেখেই মা বুঝে নিতেন আজও ছেলেটার চিঠি আসে নাই।

দিন চলছে কত প্রিয় মুখ অন্ন অভাবে আপনজন ছেড়ে ছুটছে দেশ থেকে দেশান্তরে কাজের সন্ধানে। আর ঘরে থাকা আপন প্রাণগুলো রাত দিন রাহাজারি করছে রোজ। কেউ থেমে থেমে কাঁদতো জোরে স্বরে অহর্নিশ। সরলা বধূ, মমতাময়ী মা আর আদরের ছোট ভাইবোন গুলোর চোখ যেন সব সময় রক্ত কমলে রঞ্জিত হয়ে থাকতো। নিয়তির উপর ভর করেই চাতকের ন্যায় দিন কাঁটাইতো এসব মানুষ গুলো। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর দিনাতিপাত হইতো কোন খবর হইতোনা। সেকালে খবর পাওয়ার একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি। সেও মাসের পর মাস চলে যেতো পৌঁছাতোনা। দীর্ঘদিন প্রিয়জনের খবর না পেলে কেউ কেউ ধরেই নিতো জংগলের বাঘ হয়তো খেয়ে ফেলেছে। পাল তোলা নৌকা গুলো প্রতিনিয়ত আসা যাওয়া করতো। দুর থেকে নৌকার পাল দেখলেই প্রতীক্ষায় থাকা মেয়ে মানুষ গুলোর অন্তর ছটফট করতো। আল্লাহ এই নৌকায় তুমি যদি আমার প্রিয়জনকে দিতে। যখন দেখতো পাড়ে আর নৌকা ভিড়লোনা। কেউ চীৎকার দিয়ে বলে উঠতো ও মাঝি তুমি কি আমার আমার মানুষটার খবর জানো! কেউ বলতো ও মাঝি ভাই, আমার মাঝির খবর কিছু জানো? আবার কেউ চোখের জল আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে ঘরে ফিরে যেতো রোজ।

সেকালে ছিলনা তথ্য প্রযুক্তির মেলা। ছিলোনা বৈদ্যুতিক আলোর ঝলকানি। তথ্য আদান প্রদানের হাতিয়ার তো কেবল ঐ একটি গোলাকার লাল রঙের বাক্সটাই। যার পকেট ভরতও হাজারো কথার ব্যঞ্জনা দিয়ে। কত আর্তনাদের কথামালা, কত চোখের জলরাশিতে ভেজা পত্র দিয়ে যা কিনা একটা আর্তনাদের বাক্স বলা যেতে পারে।

দাদাকে একদিন দেখলাম ভীষনভাবে মন খারাপ। যে দাদাকে দেখতাম আমাকে দেখলেই একটা হাসি দিয়ে ভীতু মনটাকে সাহসে পরিপাটি করে দিতো সেই সুন্দর মুখটাতে আজ দেখছি কোন হাসি নেই মলিনতায় ঢাকা। আমি ভয়ে দাদার কাছে যেতে সাহস করলামন। দাদাও কেবল একবার চোখ তুলে আমাকে শুধু দেখলেন ফের মাথাটা নীচ করে বেশক্ষণ চুপচাপ রইলেন। আমিও নিস্তুর পাথরের মত দাঁড়িয়েই রইলাম।

কিছুক্ষণ পর একজন ভদ্রলোক এলেন। উঁচা লম্বা দেখতেও সেরকম। উনার দিকে তাকাতেই কেন ভয়ে জড়ষড় হয়ে যাচ্ছিলাম। দাদা বিষয়টি খেয়ালে করেছিলেন রীতিমতো বলেই ভয়টা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলাম। দাদা আমাকে লক্ষ্য করে বললেন ক্যারে ছ্যাড়া, নানাকে দেখে নাতিরা খুশি হয় আর তুই দেখি ভয় পাইলি। তিনি ছিলেন অত্র গ্রামের নেতা তথা পশ্চিম জামালপুর এর কৃতি সন্তান। না আব্দুল কাদের সরকারআমার দিকে তাকিয়ে দাদাকে জিজ্ঞেস করলেন, কে এই ছেলে মাস্টার?। দাদা পরিচয় দিলেন, আমাদের কাশেমের ছেলে। লম্বা হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে একটানে কোলে তুলে নিলেন আমায়। আদর করে বললেন, কি খাবি নানু ভাই। ততক্ষণে ভয়ে আমার হাত পা কাঁপছিল। ভয় পাসনে নানু ভাই বলেই পকেট থেকে দুই টাকার কয়টি নোট বের করে হাতে ধরিয়ে দিলেন বললেন, নে চকলেট কিনে খাবি। আর তোর মা জিজ্ঞেস করলে বলবি সরকার বাড়ির আব্দুল কাদের সরকার তোমার মামা টাকাগুলো আমাকে দিয়েছেন। আমি টাকাটা হাতে নেই এবং একটু একটু দূরে সরে দাড়াই। এখনও দেখি পোস্ট মাস্টার দাদার মনটা বিষন্নতায় ঢাকা। দেখলাম নানা দাদাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, কি আর করবেন মাস্টার ছেলের হয়তো হায়াত ছিলোনা। আল্লাহর যা ভালো তাই সবার মেনে নিতে হবে। নিয়তির উপর তো আর কারো হাত নেই মাষ্টার।

বুঝলাম দাদার আপনজন কেউ মারা গেছেন। পরে জেনেছিলাম দাদার দাদার ছোট ছেলে নাম রতন কাকা। জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। শুনেছি কাকার বিয়েও ঠিক হয়েছিল। আজ বাদে কাল বিয়ে। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে জামালপুর সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে রোগ ধরা না পড়লে ময়মনসিংহ চরপরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করে। যতক্ষণে চরপরা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় পথিমধ্যেই তিনি ইন্তেকাল করেন। জেনেছি তিনি মারাত্মক জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তারপর বেশ দিন কেটে গেলো। আমিও বেশ চঞ্চলতায় পা দিয়েছি। এখন কিছু কিছু রসিকতাও দাদার সাথে মাঝে মধ্যেই করি।

মাঝে মাঝে দাদার বাড়িতে গেলে দাদীর সাথেও বেশ মজা করে আসি। হঠাৎ একদিন শুনি দাদা হার্ট এট্রাক্ট করে মারা গেছেন। কথাটা শুনার পর আমার মাথার উপর যেন পুরো আসমানটা ভেঙ্গে পড়ে আমি সত্যিই দিশেহারা হয়ে ছুটে যাই দাদার বাড়িতে। সাথে বন্ধুরাও ছিল। দেখি উঠানে একটা কাঠের চার পায়ার উপর উত্তর দিকে মুখ করে শুয়ায়ে রেখেছে দাদাকে।

অনেক লোকের ভিড়। বাড়ির ভীতর থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে। উপস্থিত সকলের চোখ মুখে কান্নার ছাপ। একজন লোক কাফনের কাপড়টা খোলে দাদার মুখটা শুধু দেখালো। আমি মুখটা দেখেই চীৎকার দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। সাথে সাথে বন্ধুরাও কেঁদে উঠলো। তারপর জানাজা হলো, কবর হলো পরিশেষে দোয়া মোনাজাত করে চোখের পানি মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরলাম।

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version