রতন

0

নুর এমডি চৌধুরী: রতন নিতান্তই দরিদ্র পরিবারের ছেলে। বয়স একেবারেই কম। সারাদিন রাস্তায় থাকে। বাপ রমিজ মিয়া রিক্সা চালায়। মা সালেহা বিবি অন্যের বাসায় কাজ করে। বাপে আরেকটা বিয়ে করার পর রতন বাপের সাথে খুব একটা কথা বলেনা, মিশেওনা। বস্তিতেই তাদের বাসা। বাঁশের চাটুলী দিয়ে মোড়ানো শাপুড়েদের মত ক্ষণস্থায়ী ঘর পেতে মাঝখানে কাপড় দিয়ে দেয়াল তৈরী করে দুইটা রোম বানাইছে। নিতান্ত অসহায়দের ফুটপাতে যেরুপ জীবন কাঁটে তেমনই। একরোমে রতন ও তার মা সালেহা বিবি শয় আরেক রোমে রতনের বাবা রমিজ মিয়া নতুন বউকে নিয়ে শয়।

সারাদিন মানুষের বাসায় কাজ করে সালেহা বিবি যে টাকা পায় স্বামী রমিজ মিয়া প্রায় সময়ই সব টাকা ছিনিয়ে নেয়। সেচ্ছায় দিতে রাজি না হইলে চালাতো অমানবিক নির্যাতন। তাও আবার টাকাটা যদি তার সংসারের কোন কাজে ব্যয় করতো তাইলেও চলে টাকাটা যাইতো নতুন বউয়ের রুপ চর্চার কাজে। যেদিনই রমিজ মিয়া টাকাটা নিতো পরদিনই দেখা যেতো নতুন বউয়ের পরনে বাহারী রঙের শাড়ি, চুড়ি কত কিছু। নিজের পরিশ্রমের টাকায় অন্যের সাজগোজ দেখে কেইওবা ঠিক থাকতে পারে।

একদিকে স্বামী থেকেও না থাকার নির্মম যন্ত্রণা। চোখের সামনে রতন তার বাবা থেকেও বাবার আদর হতে বঞ্চিত। এতো সব কষ্ট সালেহা বিবিকে যেন প্রতিনিয়ত কুরে কুরে বিনাশ করতে থাকে। মাঝে মাঝে সালেহা বিবি জীবনের প্রতি ভীষণ অতিষ্ঠ হয় ভাবে গলায় দড়ি দিয়ে মরি। পরক্ষণই অসহায় রতনের কথা ভেবে তওবা আস্তাগফিরুল্লাহ পাঠ করতে থাকে। বিয়ের পর থেকেই রমিজ মিয়া রতনদের কোন খরচপাতি দেয়না সালেহার দিকেতো তাকাইনা। একবারও রমিজ মিয়া ভাবেনা রতন তার সন্তান। তাই প্রতিনিয়তই কেঁদে কেঁদে সালেহা বিবি আল্লাহর কাছে নালিশ দেয় বলে, আল্লাহ তুমি এর বিচার কইরো। শুধু সালেহা বিবি নয় এই সমাজে লক্ষ লক্ষ সালেহা বিবি আছে যাদের করূণ কাহিনী সিনেমাকেও হার মানায়। এদের দূর্দর্শা দেখে আজকাল সুশীল সমাজও মুখ ফিরিয়ে নেয়। এতো সবের পরেও একমাত্র সন্তান রতনের মুখপানে চেয়ে সালেহা বিবি যেন কোন প্রতিবাদী হয়না। নীরবে সরল হৃদয়ে সব সহ্য করে।

ভাবে শত হইলেওতো সে স্বামী। নিভৃত্যে শুধু চোঁখের জল ফেলে। সরলতা বাঙ্গালী নারী চরিত্রের ধর্ম। এ সরলতার গুনেই তারা আজন্ম স্বামীর ঘর করে, স্বামীকে দেবতা জ্ঞানে পুঁজো করে, মৃত স্বামীর কবরগাত্র এদের কাছে যেনো কাবা। স্বামীর চাওয়া পাওয়ার মাঝেই এরা পূর্ণতা খোঁজে। রতন বড় হয়েছে। ভালমন্দ বুঝতে শিখেছে। বুঝতে শিখেছে মায়ের কষ্ট আর অমানবিক যন্ত্রণার কথা। কিন্তু মায়ের অনুনয় বিনয়ে আর কড়া নিষেধের কাছে বারবার হার মেনে থেকেছে রতন।

সেও নীরবে বাবার দেওয়া সকল অত্যাচার সহ্য করে গেছে। দিন যায় দুঃখকে সাথী করেই বড় হয় রতন। পড়ালেখা কি জিনিস জানেনা সে। তবে বুঝে স্কুল বলতে একট ভালো দালান আছে যেখানে তার বয়সী ছেলেমেয়েরা সেজেগুজে সকাল বেলায় যায় আবার বিকেল বেলায় ফিরে আসে। রতন ওদের হাসিখুশি মুখ আর সুন্দর জামাকাপড় দেখে অপলক তাঁকিয়ে থাকে। ভাবে এরা কারা? একবার রতন মা সালেহা বিবিকে জিজ্ঞেস করেছিল ওরা কারা মা? সালেহা বিবি উত্তর দিয়েছিল, ওরা সব বড় লোকের সন্তান আর ঐযে দালানটা দেখছিস ওটা ওদের স্কুল। পড়ালেখা শুধু ওদের জন্যই। তাই রতন তাদের প্রভুর মত সমীহ করে চলে। সেদিন অনেক রাত হয়েছে। মা সালেহা বিবির বাসায় ফিরেনি।

রতন ভীষণ চিন্তিত। মায়ের এহেন না ফেরর কষ্টে রতন ছটফট করতে থাকে। সারাঘর পায়চারি করতে দেখে সৎ মা স্বামী রমিজ মিয়াকে উস্কানী দিয়ে বলে, ছেলেতো না যেনো একটা বিচ্ছু জন্ম দিছো। ছিঃ ছিঃ লজ্জার মাথা খেয়েছে কেমন করে উঁকিঝুঁকি মারছে দেখছোনা। রমিজ মিয়া নালিশ পেয়েই রতনকে ইচ্ছেমত গালমন্দ এবং কি লাঠি দিয়ে বেদম প্রহার করে। রতন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বেশক্ষণ কাঁদে। কেঁদে কেঁদে অস্থির হয়ে উঠে। প্রহারের ব্যথা যতটা না কষ্টের তার চেয়ে বেশি কষ্ট দেয় তার মায়ের না ফেরার যন্ত্রণা। কি করবে রতন ভেবে পায়না। রতন এখন অনেকটাই বড় হয়েছে এখন সবই সে বুঝে। বাবার আদর বুঝে শাষণ বুঝে অত্যাচারের মাত্রা বুঝে এমনকি সে কষ্টের পরিমাপও করতে পারে। শুধু মুখ বুঝে সহ্য করে যায় কিছু বলেনা। কারণ মা কষ্ট পায় বলে। চোখের সামনে বাবার আদরকে জলাঞ্জলি, মায়ের অমানবিক কষ্ট কথা, জীবন ধারণে কি নির্মম গতি এসব মোকাবেলা করতে গিয়ে রতন অনেকটাই রুক্ষ মেজাজের হয়ে উঠেছে। গভীর রাত হয়েছে মা সালেহা বিবির এখনও ফেরার নাম নেই। রতনের দু’চোখ গড়িয়ে নীরবে জল ঝরতে থাকে।

বাবা রমিজ মিয়ার যেন এতোটুকুও টেনশন নেই। সৎ মায়ের হাত ধরে হাসি খুশির বন্যা বহাইতেছে। রতন রুক্ষ মেজাজে তা লক্ষ করে। রতনের ধৈর্যের বাঁধ যেন এবার ভাঙ্গতে থাকে। রক্ত চোখে টগবগ করে এদিক সেদিক তাকায়। কিন্ত মা আসছেনা সে কথা ভাবতেই মনটা পাথর হয়ে যায় বারবার। এতো রাত। মা কেন আসছেনা, কি হলো তাহলে, মাকেতো কোন দিনই এতোটা রাত করে ফিরতে দেখেনি রতন। নাকি রাস্তায় ছিনতাই কারীদের কবলে পড়লো। মায়ের কাছেতো তেমন কোন টাকা পয়সাও নেই, মোবাইলও নেই। স্বর্ণলঙ্কারতো দুরের কথা। তাহলে ছিনতাকারীরা মাকে ধরবেইবা কেন। নানা প্রশ্ন রতনের মনে ঘুরপাক খায়। বস্তির গলিতে প্রায়ই নারী কেলেঙ্গকারীর ঘটনা ঘটে থাকে। রতন সে দিকটাও ভাবে, ভেবে ভেবে অস্থির হয়। কি করবে এখন সে কিছুই বুঝতে পারছেনা। তিমির রাত। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।

তবু মায়ের টানে মায়ের মমতায় ছোট হোক বড় হোক কোন সন্তানই পারেনা চুপ করে ঘরে বসে থাকতে। বাবার কথা ভাবে কত বড় পাষন্ড বাবা একবারও আমার মা’টার খবর নিলোনা। এমন বাপকে কি করা উচিত। সব চেয়ে বেশি রাগান্নিত হয় সৎ মায়ের প্রতি। এই ডাইনীটাই যত সব অশান্তির মুল। এর কারণেই আজ আমার মায়ের হৃদয় ভরা কষ্ট। একদিনতো অনেক সুখ ছিলো এই সংসারে মায়ের মুখেতে অনেক হাসিও ছিল। আর আজ কতটা বছর মাকে একটুও হাসতে দেখিনা। চোখ ভরা জল আর বোক ভরা দীর্ঘশ্বাস শুধু বয়েই চলেছে। অথচ ডাইনী কি দিব্বি হেসে খেলে দিন কাটায়। রতনের প্রতিহিংসার আগুনটা যেন নিমিষেই প্রখর হয়ে উঠে। প্রজ্জ্বলিত নরককুণ্ডের ন্যায় রতন জলে উঠতে থাকে যা শুধু মারাত্মকই নয় যেন মরন কামড়ের আস্ত শিবির। মায়ের কষ্টে সে মর্মাহত হতে থাকে চোখের সামনে এতো বড সুখকে কি করে মা জলাঞ্জলি দিয়ে বাঁচে। এভাবে আর বাঁচতে চায়না রতন। একবার কাপড়ের ওয়ালটা দিয়ে উঁকি দেয় দেখে, বাবা রমিজ মিয়া নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে আর পাশে সৎ মা ডাইনীটাও ঘুমিয়ে গেছে।

সমস্ত ঘর অন্ধকার। অন্ধকারেই রতন কি যেন খুঁজছে। কিছুক্ষণ পর একটা শক্ত লাঠি খোঁজে পায়। এদিক সেদিক চুপচাপ তাকিয়ে ফের আরও কিছু খুজতে থাকে। কিন্তু একি! এযে ধারালো ছুরি তার হাতে। ছুরিটা পাওয়ার পর রতনের চেহারাটা যেন কিরুপ হয়ে উঠেছিল তার বর্ণনা করা মুশকিল। তবে চোখ দু’টিতে যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গ বইছিল। সমস্ত শরীর দিয়ে ঘাম টপটপ করে ঝরছিলো। সত্যিই রতনের মাথায় আজ খুন চেপে বসেছে। তার জ্বালাময়ী চেহারাটাও সাক্ষ্য দিচ্ছে রতন কোন রক্তক্ষয়ী কাজের দিকে হাত বাড়াচ্ছে। হায়রে খোদা! এ এমনই একটা মুহুর্ত যে, এখানে না আছে কেহ তাকে শান্তনা দিবে, না আছে কেহ তাকে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড থেকে ফিরাবে। হায় প্রভু! এতটুকু শিশু মানষী ছেলেটার বোকে কি আগুনই না তুমি জ্বালিয়ে দিয়েছো যে আগুনের দাহ আপন জীবনের মায়াকেও জলাঞ্জলি দিয়ে এক মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের দিকে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। ঠিক তাই হলো। পরনের হাফ প্যান্টটাকে শক্ত করে পুনরায় বেঁধে নিলো গামছা দিয়ে। কাকে সে হত্যা করতে চায়? সৎ মা’কে নাকি বাবা রমিজ মিয়াকে। টার্গেট কাকে জানিনা।

হয়তোবা বাবা রমিজ মিয়া নয়ত সৎ মা দু’জনের একজনতো বটেই। লাঠিটা বাম হাতের কব্জিতে শক্ত করে ধরলো আর ডান হাতে ধরলো ধারালো ছুরিটা তারপর দুই রোমের মাঝের পর্দাটা সরিয়ে আর একবার উঁকি দিয়ে কি যেন দেখে নিলো রতন। বাবা রমিজ মিয়া সজোরে নাক ডাকছে সৎ মা বাম দিকে চিৎ হয়ে সেও বিভোর ঘুমে আচ্ছন্ন। রাত তখন অনেক হয়েছে। তিমির কালো রাত মা সালেহা বিবি তখনও বাসায় ফিরেনি। মায়ের না ফেরার কথা যেন রতনের একটুও মনে নেই। তার মাথায় ভর করছে কেবল হত্যা, খুন, মার্ডার। রতন যেনো খুনের মাঝেই সকল যন্ত্রনার অবসান খুঁজছে। শক্ত করে ছুরিটা ধরে অমারম বাবার মাথার উপর দন্ডায়মান হলো। তবে কি বাবাকেই সে খুন করবে।

এত বড পাপ কাজ সে করবে। মুখ দিয়ে বিরবির করে রতন বাবার উদ্যেশে বেশ কিছু কথা বলে গেলো তবে কি কথা জানিনা তারপর দৃষ্টিটা বাম দিকে ঘুরায়ে নিলো এবার ব্যগ্রতার সাথে পেশাদার খুনির মতো ধারালো ছুরিখানা সৎ মায়ের গলায় পরপর কয়েক বার বসিয়ে দিলো। মরণ চীৎকারে রমিজ মিয়ার ঘুম ভাঙ্গলো। ততক্ষণে রতন ছুরিটা ছুড়ে ফেলে দৌড়ায়ে পলাতে লাগলো। রমিজ মিয়াও হাতে রক্তাক্ত ছুরিটা নিয়েই রতনের পিছে পিছে ছুড়তে লাগলো। তারপর কি হয়েছে জানিনা। হয়তোবা রতনকে খুঁজে পেয়ে রমিজ মিয়াও রতনের মত দাগী ফেরারী খুনী আসামী সেজেছে নয়তোবা..।

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version