Home অন্যান্য আনোয়ারা (ছোটগল্প)

আনোয়ারা (ছোটগল্প)

নুর এমডি চৌধুরী || কবি ও সাহিত্যিক

0

ঠান্ডু মিয়া ইস্ট বেংগল রেজিমেন্টের একজন সৈনিক। তার গ্রামের বাড়ি জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ থানা ঘেষে যমুনা নদীর ওপারে সারিয়াকান্দির একটি গ্রামে যা বগুড়া জেলার আওতাধীন। চাকুরী পাওয়ার কিছুদিন পরেই ঠান্ডু মিয়া বিয়ে করে নিজ গ্রামের দরিদ্র পরিবারের আনোয়ারাকে। আনোয়ারা দেখতে যেমন সুন্দরী সুগঠন লেখাপড়াতেও ছিল বেশ ভালো। তাই ঠান্ডু মিয়া বাসর রাতেই আনোয়ারাকে কথা দিয়েছিল তার যতদুর পড়তে ইচ্ছে সে পড়বে ঠান্ডু মিয়া সাধ্যমতো খরচ চালিয়ে যাবে। সময় কাঁটছিল হাসি আর আনন্দেই। সেবার এসএসসি পরীক্ষায় আনোয়ারা ষ্টার মার্ক পেয়ে এলাকায় যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিল। সেই ধারাবাহিকতায় এবারও আইএসসিতে স্টার মার্ক পেয়ে পুরো গ্রামের মানুষকে তাঁক লাগিয়ে দিয়েছে। আনোয়ারার আশা সে ডাক্তার হবে। তাই স্ত্রীর মনের বাসনা পূরণ করতে ঠান্ডু মিয়া মরিয়া হয়ে উঠে। মাঝে মধ্যে বন্ধুরা যদি বলতো ঠান্ডু কাজ যাই করিস ভেবে চিন্তে করিস। যা করছিস পরে কিন্তু পস্তাবি। আরে বউয়ের পড়ালেখা যদি স্বামীর চাইতে বেশি হয় স্বামীর কি আর দাম থাকেরে। ভাবিস কিন্তু। এরুপ কথা শুনলেই ঠান্ডু মিয়া রেগে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতো। শুধু তাইনা উল্টো দোষারোপ করে বলতো, হিংসে হয় তাইনে, হিংসে হয়। আরে হিংসে তো হবেই ঠান্ডু মিয়ার বউ হবে ডাক্তার তাও আবার এমবিবিএস হিংসে কি না হয়ে পারে। মাঝে মধ্যে আত্মীয় স্বজনদের নানমুখী কথায় ঠান্ডু মিয়ার বাবা মা যদি বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে চাইতো ঠান্ডু মিয়া রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে যেতো। সময় যেতে লাগলো নিয়মে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ঠান্ডু মিয়াও তার সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগল। যোগ্যতা অনুযায়ী স্ত্রী আনোয়ারাকে সরকারী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিলো। যথারীতি কোর্স শেষ করে সফলতার সহিত এমবিবিএস পাশ করল আনোয়ারা। এবার আর জাস কই ঠান্ডু মিয়ার খুশিতে যেন আকাশ ভেংগে পড়ে। এতোটাই খুশি যে ঠান্ডু মিয়া গরু জবাই দিয়ে আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবদের বিশেষ করে যারা তার সীদ্ধান্তের বিরোধীতা করেছিল তাদেরকে খুব ভালো করে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ায় দিলো। ইতিমধ্যেই সেনাবাহিনীতে মেডিকেল কোরে ডাক্তার নিয়োগের সার্কুলার হলো। ঠান্ডু মিয়া বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য বেদম খুশিতে কমান্ডার স্যারের কাছে গেল। সবিনয়ে বিষয়টি জানতে চাইলে কমান্ডার একটু রসিকতাপূর্ণ মৃদু হাসি হেসে বললেন, কেন বউকে চাকুরী দিবে নাকী? কমান্ডার জানতোনা যে ঠান্ডু মিয়ার স্ত্রী ডাক্তারী পাশ করে বেরিয়েছে। ঠান্ডু মিয়া কমান্ডারের রসিকতাপূর্ণ বাক্যটিকে রসিকতায় নিলোনা বরং কমান্ডারের কথায় ব্যপক খুশী হয়ে সন্মানের সহিত হৃদয়ে ধারণ করে বললো, স্যার যদি অভয় দেন একটা কথা জিজ্ঞেস করবো। কমান্ডার অভয় দিলেন। ঠান্ডু মিয়া গড়্গড় করে নির্ভয়ে সব কথা বলে গেলো। কমান্ডার অবাক হল। অবাক হল এই ভেবে যে, একজন সাধারণ সিপাহী হয়ে কতবড় স্বপ্ন তার মনে। মনে মনে খুশি হলেন কমান্ডার। ভাবলেন, স্বপ্নতো সবারই দেখার অধিকার আছে। ঠান্ডু মিয়া দেখবেনা কেন? ঠান্ডু মিয়ার তরতর করে বলে যাওয়া আবেগঘন কথাগুলো কমান্ডারের হৃদয়কে স্পর্শ করলো। কমান্ডার মনে মনে সীদ্ধান্ত নিলো ঠান্ডু মিয়ার স্ত্রীর যাতে চাকুরীটা হয় সে ব্যাপারে সাধ্যমত চেষ্টা করবেন তিনি। পৃথিবীটা সত্যিই এক বিচিত্র নাট্যশালা। মানুষ চলে সময়ের গতিতে জীবনের প্রয়োজনে। এই যে মানুষের প্রতিনিয়ত চলা প্রতিনিয়ত কথা বলার সমষ্টি কিন্তু প্রভুর দরবারে এক একটা ঐশরিক উপন্যাস। যার একমাত্র দ্রষ্টা প্রভু স্বয়ং নিজেই।

কমান্ডার সত্যিই অনেক চেষ্টার পর ঠান্ডু মিয়ার মনের বাসনাকে মিটিয়ে দিলো। স্ত্রী আনোয়ারার চাকুরী হল সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে। ঠান্ডু মিয়ার হৃদয়ে আনন্দের জোয়ার বইতে লাগল দ্বিগুণ মাত্রায়। আনোয়ারাও যথেষ্ট সাহসিকতার সাথে ট্রেনিং শেষ করে নিলো। একজন সাধারণ সৈনিকের বৃহৎ প্রাপ্তিতে পুরো ক্যাম্পজুড়ে বিশেষ করে ঠান্ডু মিয়ার কলিগদের মনে আনন্দের জোয়ার বইতে লাগলো। বেশ দিন কেঁটে গেল। এদিকে সম্মানে সম্মানে সেলুটে সেলুটে আনোয়ারার মনে অহমিকার দালান তৈরী হতে লাগলো। দিন যতই যেতে লাগলো স্ত্রী আনোয়ারার সহিত ঠান্ডু মিয়ার দূরত্ব ততই বাড়তে থাকলো। ঠান্ডুমিয়া ফোন করলে এখন আর আগের মতো আনোয়ারা ফোন ধরেনা। ধরলেও বিরক্তবোধ করে ফোনটা রেখে দেয় বলে, এই মিটিং সেই মিটিং ইত্যাদি ইত্যাদি। একপর্যায়ে দুরত্বের মাত্রাটা এতোটাই বেড়ে গেলো যে, মাঝে মধ্যে ডিভোর্স এর কথাও আনোয়ারার মুখ থেকে উচ্চারিত হতে লাগলো। এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হলো, ঠান্ডুমিয়ার ছায়াটা পর্যন্ত আনোয়ারা সহ্য করতে পারলোনা। এমনও সময় পার হতে থাকল দিন যায় সপ্তাহ যায় মাস যায় কারও সাথে কারও কথা হয়না।

ইতিমধ্যে দু’জনের সম্পর্কে অশনি সংকেত শোনা গেল। ঠান্ডু মিয়া নিরুপায় হয়ে পড়লো। এতদিন অনুমান করছিল যা স্ত্রী আনোয়ারা সম্পর্কে সেদিন ঠিক তাই ফলল। নিজ চোখে ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করার পর ঠান্ডু মিয়ার আর বাঁচতে ইচ্ছে করলোনা। ক্যাপ্টেন মামুন পাটোয়ারীর সহিত আনোয়ারার প্রেম রীতিমতো চলতে লাগল। ঠান্ডু মিয়া মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল ভবিষ্যতের স্বপ্নগুলো তার দুমড়ে মুচড়ে একাকার হয়ে গেল। চাকুরীর বয়স তার বেশ হয়েছে কোন প্রমোশন নেয়নি ঠান্ডু মিয়া। ভেবেছিল স্ত্রী আনোয়ারার যেদিন চাকুরী হবে সেদিনই সে চাকুরী হতে অব্যাহতি নিবে। কিন্তু অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকিয়ে যায়। ঠান্ডু মিয়ার অবস্থাটাও তাই হলো। চলমান নির্মম অমাবস্যার কালো রাত্রির জীবনে আরেকটা দুঃসংবাদ এসে যোগ হলো। স্ত্রী আনোয়ারা তাকে ডিভোর্স দিয়েছে। কথাটা শুনার পর রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়ল ঠান্ডু মিয়া। জীবন বিপন্নতা লক্ষ করে ইউনিট কতৃপক্ষ তাকে সিএমএইচ এ ভর্তি করালো।অবিরত মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে লাগলো ঠান্ডু মিয়া। এতো দুঃসংবাদ এতো এতো অপমানের কালিমা সহ্য করে কিভাবে একটা প্রাণ বাঁচতে পারে। চিকিৎসকদের অক্লান্ত চেষ্টায় যদিও একটু সুস্থতা ফিরে পেলো দু’দিন যেতে না যেতেই আরেকটা দুঃসংবাদ প্রাণে এসে ধাক্কা দিলো। আনোয়ারা মামুন পাটোয়ারীকে বিয়ে করেছে এবং খুব জাকজমক করে। বিস্ময়কর বিষয় হলো যে এবার আর ঠান্ডু মিয়া নিজেকে বিচলিত করে তুললোনা। নিজেকে শক্ত শিকলে বাঁধার জোর চেষ্টা করে অনেকবার আত্মহত্যা করার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলো ঠান্ডু মিয়া। মনে মনে সীদ্ধান্ত নিলো ওর শেষ পরিনতিটাকে নিজ চোখে দেখে যেতে চায়। আকাশের মালিকের দিকে তাঁকিয়ে বলল, প্রভু সুখ চাইনা জীবনে, সম্পদ চাইনা, সম্মানও চাইনা তোমার কাছে শুধু এতটুকু ফরিয়াদ তিল তিল করে জমানো স্বপ্নকে আমার যে ধূলিস্যাৎ করে দিলো, চুর্ণবিচুর্ণ করে দিলো আমি শুধু তার জীবনের ভাঙনটা দেখে যেতে চাই! দেখাবেতো প্রভু? সহস্র নীরব যন্ত্রণা আর দাহ নিজেকে অতিষ্ঠ করে তুলছিল তাই ঠান্ডু মিয়া চাকুরি হতে অব্যহিত নিয়ে চলে গেল নিজ গ্রামে। সেখানে গিয়েও হাজারও অপবাদের যন্ত্রণা সহ্য করতে হলো তাকে। আত্মীয় স্বজনদের নানা কটুক্তি কাছের আপনজনদের অকথ্য গালমন্দ সহ্য করেই দিনাতিপাত করতে লাগল ঠান্ডু মিয়া।

১৯৯১ সাল। বড় ভাই সেনাবাহিনীতে থাকার সুবাধে যশোহর ক্যান্টনমেন্টে ঘুরতে যাই। সেখানে কয়েকদিনেই বেশ বন্ধুবান্ধব তৈরী হয়। তারা কেউ সেনাসদস্য কেউ আবার আমার মতই বেড়াতে আসা অতিথি। সেনা সদস্য বন্ধুদের সাথে যতক্ষণ কথা হতো তা শুধু তাদের কেন্টিনে বসেই একদিন শুক্রবার বিকেলবেলা আমরা ক’জন একটু ক্যান্টনমেন্টের ভিতরটাতেই ঘুরে দেখবো বলে সীদ্ধান্ত নিলাম এবং যথারীতি বের হলাম। যে রোডটা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম সেটা অফিসার্স কোয়ার্টার রোড়। একটু সামনে এগুলেই জেসিওস কোয়ার্টার। হাতের ডানে বিস্তর খেলার মাঠ। দূরে চোখ গেলেই বিমানবন্দর। অনেক বিমান উঠানামা করছে। আমরা যখন অফিসার্স কোয়ার্টার রোডটা ধরে হাটছিলাম দুইশো গজ সামনে এগুতেই সেনা সদস্য বন্ধুরা অকস্মাৎ আমাদেরকে থামিয়ে দিলো এবং বললো, শোন শোন দাঁড়াও একটা ঐতিহাসিক জায়গা দেখে যাও। মর্মান্তিক স্মৃতি বিজড়িত স্থান এটি। ঐ যে দেখছো লাল ফিতায় বেষ্টনী দিয়ে ঘীরে রাখা জায়গাটুকু ওটাই ঐতিহাসিক স্থান। একদিন একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল এখানে। একজন অফিসার স্পটেই মারা গিয়েছিল। ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল সেদিন তার দেহের মাংসপিণ্ডদ্বয়। তারপর ফের সম্মোখপানে এগোতে থাকি আমরা। হাঁটতে হাঁটতে ওরা বলে দিলো ওখানে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো নিষেধ আছে। তবে ঐতিহাসিক ঘটনাটি কি তার বিস্তারিত শোনার তীব্র বাসনা আমার মনে ঘুরপাক খেতে থাকলো। হাটছি হাটছি আর কিছু কিছু জিজ্ঞেস করছি জানছি। কিন্তু যতই জানছি ততই জানার আগ্রহটা বেড়ে যাচ্ছে। একসময় ছোট্ট একটা চায়ের দোকানের সামনে এসে থামলাম আমরা। খোলামেলা জায়গা। বিস্তর গাছের ছাঁয়ার নীচে ব্যাঞ্চ পাতানো। দখিনা বাতাস শোঁশোঁ শব্দে বইছে।

গল্পটা যাতে শেষ অবধি শুনতে পারি তাই একটু বুদ্ধি খাটালাম। কিছুটা দুরের ঐ বড় দোকান থেকে বেশ কিছু খাবার কিনে আনলাম। সাথে বাদামও নিয়েছিলাম পাঁচ টাকার। পাঁচ টাকার বাদাম মানেতো সেকালের অনেকগুলো। ওরা প্রথমে এতোগুলো খাবার দেখে রীতিমতো রেগে গিয়েছিল। তারপর আড্ডাটা ধীরে ধীরে যখন জমে উঠল আনোয়ারা ঠান্ডু মিয়ার জীবনে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনাগুলো আমার শুনা হয়ে গেলো। মনটা মনের অজান্তেই কেঁদে উঠল। আনোয়ারা আর মামুন পাটোয়ারীর বিয়ের পর দু’জনেই অফিসার্স কোয়ার্টারে থাকত। একদিন ভোরে মামুন পাটোয়ারী নিজেই কার ড্রাইভ করে ব্যক্তিগত কাজে বেরিয়েছিলেন। সেদিন স্ত্রী আনোয়ারা তিনতলার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আনন্দ চিত্তে হাত নেড়ে নেড়ে মামুন সাহেবকে টাটা দিচ্ছিলেন। মামুন সাহেবও হাতটা বের করে যখনই নাড়ছিলেন অকস্মাৎ একটা রট বোঝাই ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মামুন পাটোয়ারীসহ গাড়িটাকে দুমড়ে মুচড়ে একাকার করে দেয়। ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মামুন পাটোয়ারীর দেহখানি।

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version