আমার অনুপ্রেরণা মাদার টেরেসা। ১৯৯৭ সালে মাদার টেরেসার মৃত্যু আমার হৃদয়কে নাড়িয়ে দিয়েছিল।
নিরক্ষর দিনমজুর পিতার জ্যেষ্ঠ পুত্র। শৈশব কেটেছে ভয়াবহ দারিদ্র্যতার মধ্যে। বাবার দৈনিক মজুরি ছিলো তখন ১০ টাকা। অনেকেই কাজের শেষে মজুরিও দিতনা ঠিকমতো। ভাত জুটতো দু-তিন দিন অন্তর। বাকি সময় নুনজল বা লোকের বাড়ি থেকে চেয়ে-চিন্তে আনা খুদ সেদ্ধ বা পচা পান্তা। পড়শিরা চাল ডাল আলু তেল ধার দিত না যদি খেয়ে না দিতে পারি!
বাবা বই কিনে দিতে পারেনি। লোকের কাছে সাহায্য চাইতে গেলে বিদ্রূপ করে বলেছে, ভিখারির এতো পড়ার শখ কিসের? পরিচিত কিছু বিত্তবান লোকজনের বাড়িতে গিয়ে আমি ও মা তাদের পা জড়িয়ে ধরে কেঁদেছি একটি বইয়ের জন্য। বেশিরভাগ মানুষ দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। খুব কম লোকই বই কিনে দিয়েছে। দশজনের পা জড়িয়ে কাঁদলে একজন দিতো।
স্কুলের ফি দিতে পারিনি বলে স্কুল থেকে বের করেও দিয়েছিলো একবার।
বাবার সঙ্গে দিনমজুরি করার পরামর্শ দিতো পড়শিরা। কিন্তু মেধাবী এবং জেদী থাকার কারণে পড়াশুনায় ঝোঁক ছিলো সর্বদাই। স্কুলের ফার্স্ট বয় ছিলাম। ফার্স্ট বেঞ্চে বসতাম। মেধার কারণেই এবং কিছু শিক্ষকদের সহযোগিতায় পড়াশোনা করা সম্ভব হয়েছে।
স্কুলে যেতাম এক গ্লাস জল খেয়ে। মাসে পনেরো দিন জল খেয়ে তো পনেরো দিন ভাত। কবি ও বিশিষ্ট ব্যাক্তিত্ব কাজী নজরুল ইসলাম এবং আমেরিকার রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিঙ্কনের জীবনী আমাকে শক্তি জুগিয়েছে। হেরে যাইনি বিভিন্ন বাধা ও দারিদ্র্যতার কাছে। পড়ার আগহ ছিলো সবসময়ই। তবে সূর্যের আলোয়। কারণ রাতে হ্যারিকেন জ্বালানোর মতো ঘরে ছিলনা কেরোসিন তেল।
পেটের দায়ে হোটেলবয় হিসাবেও কাজ করেছি। অফিসে বকেয়া বেতন চাইতে গেলে পাইনি। বাধ্য হয়ে থানায় ডায়েরি করেছি বলে মালিক মস্তান দিয়ে মেরে বস্তাবন্দী করে রেখেছিল রাতের বেলায় রেললাইনে ফেলে দেবে বলে। – এরকম বহুবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি।
সরকারি চাকরি করে দেবে বলে কষ্টার্জিত ৫ লাখ টাকা নিয়ে চাকরি করে দেয়নি একজন। টাকা ফেরত চাইতে গেলে বন্দুক নিয়ে ধাওয়া করেছে। প্রাণ বাঁচাতে আমি দৌড়াতে থাকি। শেষে গিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিই। ঐ নদীতে আছে কুমির আবার জঙ্গলে আছে বাঘ। দু’দিন দু’রাত জঙ্গলের মধ্যে গাছে বসে কাটিয়েছি।
ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় বাবা লোকের ঘর সারাই কাজে গিয়ে হঠাৎ করে পা পিছলে নীচে পড়ে যায় ঘরের উপর থেকে। কোমর ভেঙে শয্যাশায়ী হন তিনি। বিনা চিকিৎসায় পুরোপুরি পঙ্গু হয়ে যান। বাবাই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম।
আমরা নাবালক। মা বাধ্য হয়ে লোকের বাড়িতে পরিচারিকার কাজে যোগ দেয়। মজুরি হিসাবে পেতো পচা পান্তা নতুবা দুমুঠো খুদ। তাতেও রোজ খাবার না জুটলে বিভিন্ন পুজোর নামে বাড়িতে বাড়িতে ভিক্ষা করে যেটুকু পেতো। তা’ই সিদ্ধ করে খেতাম নুন ভাত বা ফ্যান ভাত।”
– কমল কৃষ্ণ কুইলা।
(অবিভক্ত বাংলার.. পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বৈকুণ্ঠপুর গ্রামের দিনমজুর বাবার জ্যেষ্ঠ নন্দন, যোগ্য উত্তরসূরী কমল কৃষ্ণ কুইলা। শৈশবে গ্রামের সবাই যাকে ‘বাপি’ নামে চিনতো।)
বাপী তথা কমল অর্থ পদ্ম (গোবরে পদ্ম অভীধা যার শিরোপম) সেই সুযোগ্য আগামীর কর্ণধার কঠিন জীবন সংগ্রামকে প্রতিষ্ঠানে রূপদান করেছেন।
গান্ধীজির “DO OR DIE” নীতি অনুসরণ করে যিনি পথ পাড়ি দিচ্ছেন, তিনিই কমল কৃষ্ণ কুইলা। যার বর্ণময় জীবন রূপকথাকেও হার মানায়। পিতা, হরিপদ কুইলা। মাতা, বীনাপাণি দেবী।
পারিবারিক চরম দারিদ্র্যতার কারণে যাঁর শিক্ষাজীবন পদে পদে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। হাল ছেড়ে দেননি। দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চালিয়ে গেছেন। কোনো গৃহশিক্ষক ছিল না তাঁর। নিজেই ছিলেন নিজের শিক্ষক। বন্ধুবান্ধব ও শিক্ষকদের সহযোগিতা নিয়ে পড়াশোনা সমাপ্ত করেছেন।
উচ্চশিক্ষার খরচ চালাতে গিয়ে তাঁকে কখনও টিউশনি কখনওবা রাজমিস্ত্রীর সঙ্গে জোগাড়ে হিসাবে কাজ, এমনকি বাড়ি বাড়ি সেলসম্যানের কাজও করতে হয়েছে। লজ্জা পাননি কোনো কাজে। হাসিমুখেই হজম করেছেন অন্যান্য শ্রমিকদের দুর্ব্যবহার ও কটুক্তি।
কর্মজীবনের প্রথম দিকে কলকাতায় এসে প্রায় দু’মাস রাত কাটিয়েছেন রেলষ্টেশনে। পকেটে সম্বল বলতে ছিল মাত্র দু’টাকা।
সেলসম্যানের কাজ করতে করতেই একদিন আলাপ হয় প্রখ্যাত অভিনেতা ও পরিচালক সুখেন দাসের সঙ্গে। তাঁর হাত ধরেই চলচ্চিত্র জগতে সাময়িক প্রবেশ ও তাঁর কাছে কাজ শিখে বিভিন্ন ছবি ও মেগা সিরিয়ালে নিয়মিত কাজ করেছেন কমলবাবু। পরিচালক অঞ্জন চৌধুরীর বাড়িতেও ছিলেন বেশ কিছুদিন জি-বাংলায় ‘এরাও শত্রু’ মেগা সিরিয়ালে কাজ করার সময়।
এখানেই শেষরক্ষা হয়নি। লবিবাজীর শিকার হয়ে কমলবাবুকে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কাজ ছাড়তে হয়। চলচ্চিত্র জগতকে গুডবাই জানিয়ে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় যোগদান করেন সমাজকর্মী হিসাবে। সেখানে দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে কাজ করার সুবাদে প্রচুর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন তিনি এবং সাংগঠনিক কলা কৌশল রপ্ত করেন।
পরবর্তীকালে “আলো ট্রাস্ট” নামে নিজে একটি সামাজিক সংগঠন তৈরি করেন। যার প্রতিষ্ঠাতা, চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ট্রাস্টি কমলবাবু স্বয়ং। এই সংগঠনের মাধ্যমে সারা বাংলা জুড়ে সারাবছর ধরে বিভিন্ন প্রকার সমাজসেবামূলক কাজ করে চলেছেন তিনি। পৌঁছে গেছেন আসাম, ত্রিপুরা ও ওড়িশায়। ইতিমধ্যে পৃথিবীর ছটি দেশে ( ভারত, বাংলাদেশ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও জার্মানি ) তিনি পৌঁছে গিয়েছেন ‘আলো ট্রাস্ট’কে নিয়ে। আগামীদিনে পৃথিবীর আরও একাধিক দেশে “আলো ট্রাস্ট” এর আলো নিয়ে পৌঁছে যেতে চান তিনি।
এছাড়া প্রতি বছর ট্রাস্টের সমাবর্তন উৎসবের মধ্যে দিয়ে তিনি শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, সমাজসেবাসহ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিরলসভাবে কাজ করে চলা গুণীজনদেরকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত করে থাকেন।
পাশাপাশি লকডাউনের সময় অভুক্ত ও কোভিড আক্রান্ত মানুষের বাড়িতে রান্নাকরা ও শুকনো খাবার, অক্সিজেন তথা ঔষধ পৌঁছে দেন। আমফান, ইয়াসসহ নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগে সুন্দরবন তথা বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া থেকে শুরু করে রক্তদান শিবির, স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবির আয়োজন, বৃক্ষরোপণ, পিছিয়ে পড়া এলাকায় দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের পুস্তকসহ শিক্ষা সামগ্রী প্রদান, বিভিন্ন অনাথ আশ্রম পরিদর্শন এবং অন্নদান, বস্ত্র বিতরণ, স্কলারশিপের ব্যবস্থা, জেলা রাজ্য জাতীয় স্তরে সাহিত্য সাংস্কৃতিক উৎসব ও প্রতিযোগিতার আয়োজন করা ইত্যাদি সামাজিক কাজ আলো ট্রাস্টের চেয়ারম্যান হিসাবে স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে নিয়ে করে চলেছেন নিয়মিতভাবে।
এছাড়াও ‘প্রতিভা প্রোডাকশন’ নামে তাঁর একটি প্রোডাকশন হাউস রয়েছে। যেখানে নিজের লেখা কবিতা, গান, গল্প, চিত্রনাট্যসহ অন্যান্য লেখকের লেখা নিয়ে একাধিক ভিডিও অ্যালবাম ও শর্ট ফিল্ম বানিয়েছেন তিনি।
“দিগন্ত” নামে একটি ষাণ্মাষিক পত্রিকাও সম্পাদনা করছেন। “দিগন্ত প্রকাশনী” নামে একটি প্রকাশনা তাঁর নিজস্ব। যেখান থেকে ইতিমধ্যেই নিজস্ব লেখা নিয়ে “অঙ্কুরোদ্গম” ও “অসুখ” কাব্যগ্রন্থসহ অন্যান্য কবিদের কাব্যগ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিভা নিউজ, প্রতিভা একাডেমি, প্রতিভা কন্সালট্যান্সীও তাঁরই প্রতিষ্ঠান।
মানুষের অধিকার রক্ষায় প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘হিউম্যান রাইটস প্রোটেকশন কমিটি’, যা সমগ্র দেশজুড়ে কাজ করে চলেছে। বিভিন্ন ব্যক্তি, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বা ব্যবসায়ী সংগঠন বা রাজনৈতিক দলের জন্য স্ট্র্যাটেজিও রচনা করে দেন তিনি।
ভাবা যায়! একসময়ের চালচুলোহীন ব্যক্তিটি, কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায় ও মেধার সৃজনি ধরে সোৎসাহে অকৃত্রিম আবহে গড়েছেন নিজেকে। পরিণত হয়েছেন স্বয়ং একটি প্রতিষ্ঠানে। বতর্মান বহু ব্যক্তি ও সংগঠন তাঁর পরামর্শ ও রণকৌশল অনুযায়ী সফলতার সঙ্গে এগিয়ে চলেছে।
লড়াইয়ে জিতে তিনি সমাজকে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, শূন্য হাতেও জীবনযুদ্ধে সাফল্যের শিখর ছোঁয়া যায়।