Home অন্যান্য পারমিতার মমতা

পারমিতার মমতা

কবিতা কস্তা

0

আলুথালুবেশী মমতা গোগ্রাসে ভাত গেলে। ঘরে যৎসামান্য যা ছিলো, তাই কোনোরকম টেনেটুনে মিলিয়ে-মিশিয়ে দুটো ব্যঞ্জনের তরকারী রান্না করে সে। রান্না শেষ হতে না হতেই ক্ষুধার তীব্র মোচড় অনুভব করে সন্তানধারণকারী হবু মাতামহান।

সারাদিন একাই থাকতে হয় মমতাকে। পতিদেবতা কাকভোরে বের হন খাদ্যের সন্ধানে। অল্পবয়সেই সংসারে হাল ধরেছিলো বেচারা। শ্বশুরমশায়ের কখনোই সংসারে মন ছিলনা। তাই মমতার স্বামীই সংসারের হর্তাকর্তা। সংসারের ঘানি টানা অভ্যেস যার, তার তো কর্মব্যস্ততা নৈমিত্তিক সহচর।

মোটকথা কাজ ছাড়া লোকটা কিছু বোঝেনা।

মাঝে মাঝে ভারী শরীরটা মমতার কাছে এতো অপাংক্তেয় মনে হয়, তখন সবকিছু তছনছ করতে ইচ্ছে করে। কাজপাগল লোকটা তার জন্য খুব বেশি সময়ই দেয়না। একা একা থাকতে বিমর্ষ লাগে অনুক্ষণ।

সময়ও বেশি নেই। কি জানি কখন কী হয়ে যায়! মা-কে আগে ভাগে জানাতে হবে, ভাবে মমতা। তা নাহলে কখন হঠাৎ কি বিপদ এসে যাবে, জানা মুশকিল। খাওয়ার পর নিজেই হাঁটতে হাঁটতে মায়ের ডেরার দিকে পা বাড়ায় মমতা। আস্তে হাঁটে, কারণ মাথাটা ঝিম ধরে আছে, মনে হচ্ছে রাজ্যের ঘুম তার চোখে। অথচ বিছানায় গা গলাতে গেলেই ঘুম বলে, “পালাই”, “পালাই”।

শরীরের ভার বহন যখন প্রায় অসহ্য হয়ে যায়, তখনই টিমটিমে, গাঢ়ো বাদামী বর্ণের, ওজন সর্বস্ব এক স্ব-লিঙ্গ শিশু ভূমিষ্ট হয় মমতার। মাতৃত্বের স্বাদ আর অসুস্থতা খালাশ- দুইয়ে মিলে পরম পরিতৃপ্তি ফুটে অবয়বে। মমতার স্বামী আজ ছুটিতে। সদ্যপ্রসূত দুহিতাকে প্রাণভরে দর্শন করে পিতা। পিতৃত্বের আস্বাদন উপলব্ধি করে শিহরিত হয় অন্তরে। জীবনে প্রথম পিতা হওয়ার আনন্দ যেনো কাউকে বোঝাতে পারেনা। আপ্লুত জনক শিশুটিকে তাই ক্ষণে ক্ষণে আদরে ভরিয়ে তোলে তুলতুলে গালে।

হয়েছে, এতো আদিখ্যেতা করতে হবেনা। মমতার প্রায় ধমকে নড়েচড়ে বসে নব্য শিহরিত পিতা। কেন, আমার মেয়েকে দেখতে নিষেধ করো? আত্মজার জনকের ভাষ্য।

না, তা হবে কেন? কাজকর্ম সব ভুলে বসে আছো ঐ হতচ্ছাড়া মেয়ের চেহারা দেখতে গিয়ে। তা-ই বলছি।

মমতার বর কুকড়ে যায়। মেয়েকে হতচ্ছাড়া বললো কেন মমতা? মনে মনে ক্ষুব্ধ হলেও মুখে কোনো প্রতিবাদ করেনা। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে নিষ্পাপ সদ্যোজাতের মুখের দিকে। কচি হাসিমুখটার কোমল মনের আশু সংগ্রামী পরমায়ুতে সম্মতি দিতে নিজেও হেসে বলে, কি হয়েছে মামনি? ক্ষুধা পেয়েছে?

সবুঝ হবার পরে পারমিতা, মানে মমতার কন্যা মমতার একচ্ছত্র আধিপত্যের আঁধার যেনো। মেয়েকে একরত্তি না হলে তার চলেই না। মেয়েও মায়ের ছোঁয়া ছাড়া কিছুই বোঝেনা। পরমত লেন-দেন আতিশয্যে মা- মেয়ে জড়াজড়ি করে ঘিরে ফিরে বেড়ায়। এর বাইরে অন্য দুনিয়ার জ্ঞান তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে।

পারমিতা রাস্তা দিয়ে হেঁটে পাঠশালা বা প্রার্থনাগৃহে গেলেও মাথা নিচু করে ভদ্রোচিত যেতেই চেষ্টা করে। তবুও, ইস্ কি কয়লা! আস্ত একটা শকুনি। কিংবা, ওরে দেখ দেখ ভুতের মাসি, হা হা হা হা। পারমিতা ভ্রূক্ষেপ করেনা। পাত্তা না দিতে চাইলেও অপমানের ভাষা মন থেকে মোছেনা বিবেক যতক্ষণ জেগে থাকে। মনে মনে ক্ষুব্ধ হলেও প্রকাশ করার অবকাশ তার নেই। কারও সাথে এতটুকু সখ্যতারও সুযোগ নেই তার! নিজেকে ‘অভাগাও ভাবতে পারেনা ভাগ্যবিড়ম্বিত মেয়েটি। কারণ এতো বোঝার বয়স হয়নি তার। বুঝতে পারার সুযোগও বৃথা !

মমতার অনুমতি ছাড়া পারমিতা কোথাও যেতে ঠিক সাহস করেনা, পাছে মা রাগ করেন। পাড়ার ছেলে-বুড়ো সবাই মিলে মোহনবাবুর বাড়িতে টিভি দেখতে যায় দল বেঁধে। প্রথম প্রথম পারমিতারও ইচ্ছে হতো। তবে মায়ের অনুমতি ছাড়া যাওয়ার চিন্তাই করতে পারেনা, পাছে মা বিরক্ত হন। তবে ছোট ভাইবোনেরা যাওয়ার অনুমতি যেন পেয়েই আছে। তাদের তা নতুনভাবে নেবার প্রয়োজন কি!

গান শুনতে, গান গাইতে কিংবা এসব কৃষ্টিগত বিষয়ে সুপ্ত সাধ জাগে পারমিতার। কিন্তু বাস্তবায়ন সম্ভব নয় সংসারের চাপে। অবধারিতভাবেই ছোটদের সুবিধা-অসুবিধার চিন্তায় মাথা বুঁদ হয়ে থাকে। আর বাড়িতে মায়ের কাজ! সেতো আছেই। ধান ভানা, ঘর-দোর পরিষ্কার করা, থালাবাসন মাজা, গরু ছাগলের দেখাশুনা, ঘাস কাটা, মাছ ধরা, বড়শি বাওয়া, মলন দেয়া, ধান সিদ্ধ করা, লাকড়ী কুড়ানো, ঝড়ের দিনে আম কুড়ানো টুকরী পূর্ণ করে, ঘর-দোর লেপে পুছে রাখা, উৎসবে ঘরের দেয়ালে রঙ-রেরঙের নকশা আঁকা, ছোট ভাইবোন বিষয়ক নানা কাজে মা কে সাহায্য করা, সব্জি লাগাতে ও গাছের পরিচর্যা করে সাহায্য করা- এমনি আরও অনেক কাজের বাস্তব অভিজ্ঞতা রয়েছে পারমিতার, যা অল্প বাক্যে পূর্ণ প্রকাশ দুরূহ। কাজ করে দেয়ায় মাও খুব খুশি। এইটুকুই চাওয়া কিশোরী গ্রাম্য এ কন্যাটির! কতো সহজ- সাধারণ্যে সব ভাবনার দুয়ার!

ছোট ভাইবোনেরা দুর্দান্ত ফলাফল করতে পারে লেখাপড়ায়, অথচ কোনোরকম সেকেন্ড ক্লাস পেয়ে নামমাত্র শোককাতরতা শেষে ঝরঝরে হয়ে যায় তনয়া। আবার কাজ ও কাজ। বিনিময়ে অপারগতায় লাঞ্ছনা-গঞ্জনা, পাড়ায় ও কাজে যাওয়ার রাস্তায় টিপ্পনী, স্কুল সহপাঠীদের তিরস্কার ( সঠিক ও সুন্দর পোশাকসজ্জা না থাকায় )- এসবই তার আশীর্বাদের আকাশে বর্ষণ।

সদ্য যুবা নাম ধরে পারমিতা প্রতিবাদী হয় ক্ষেত্রবিশেষে, আর তখনই মা তেড়ে আসেন। অশালীন কথা বলতেও দ্বিধা নেই জননীর। মনে মনে ভাবে পরম (পারমিতা) কেমন মা? সন্তানের ব্যথার কারণও বুঝতে চাননা! খুব অপরাধ করেছি বলে মনে হয়না। তবুও তিনি এমন? খাঁটি কথা সহ্যই করতে পারেন না!

ছোট ছোট ধাক্কা খেতে খেতে, বিষণ্ণ সহচর পেতে পেতে, আস্তে আস্তে বাইরের মানুষের সাথে পারমিতার সখ্য হয়ে ওঠে। বুঝতে শেখে জীবনের মাহাত্ম্য, তাই বলতেও শেখে দ্বিগুণ গতিতে। কিন্তু সত্যভাষী ও প্রতিবাদী অন্যরকম দুহিতাকে মা চিনতে চেষ্টা করেন না। তার প্রত্যুত্তর মেনে নিতে কষ্ট ভাবেন। মোট কথা মমতার মুখের ওপর কেউ কথা বলবে, এটা মমতা কিছুতেই বরদাস্ত করবেনা। তাই সে ভাবতে থাকে, মেয়ে এতো সাহস পায় কোথা থেকে? কার বুদ্ধিতে এতো নির্লজ্জতা? পারমিতাকে দাবিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টায় বিফল মনোরথে মমতা অন্য সন্তানদের সাথে গুপ্তভাবে আলাপ করেন পারমিতার দুঃসাহসি আচরণের কথা। পারমিতা ন্যায়ের পক্ষে, অথচ মমতা ভাবে মেয়ে উচ্ছ্বন্যে যেয়ে, পরমানুষের বুদ্ধি পেয়ে- তাকে কষ্ট দিচ্ছে। তার মনে মেঘের কারণ হচ্ছে।

গভীর দুঃখে মগ্ন হয়ে, দুঃখের শূলে বিঁধে পরম ভাবে – অসংলগ্নতাগুলো মাকে কোনো কষ্ট দেয়না বরং এসব কৃত অন্যায়কে তিনি অবলীলায় উচিত কর্ম ভাবেন? মাথা ধরে যায় তার। মেলাতে পারেনা বিবেকের হিসাব, জবুথবু হয়ে যায় সব কথা ও কাজে।

মমতা বাঙ্ময়তায় যেন তাকে শুনিয়ে, শাসিয়ে শাসিয়ে পারমিতার অন্যায়ের, মাকে কষ্ট দেয়ার দোষে দোষী সাব্যস্ত করতে থাকে। প্রতিজন ভাইবোনের কাছেই তা বোঝানোর উপযুক্ত স্থানে পরিণতি পায় অনায়াসে। অথচ পরম যে জেনে বুঝে কোনো অন্যায় করছে তা নয়। ব্যক্তিত্ব্যর দৃঢ়তা, সময়ের সাহসী সওয়ার তাকে দেখায় নতুন দিগন্ত।

ধীরে ধীরে পরিবারের নানা প্রতিকুল আচরণে- স্পষ্টবাদিতা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে যাওয়ার বিষয়গুলো বিরোধী হয়। নিজের কাছের মানুষেরা ভুল বোঝে সরিয়ে দেয়, সকল সম্ভাব্যতার দুয়ার বন্ধ হতে থাকে। কেন, কিভাবে, তা বুঝতে থাকে পরতে পরতে, কিন্তু কবি নীরব।

একদিন দেখে ভাইবোনেরা তার থেকে দূরত্ব রেখে যায়। যতটুকু প্রশ্ন, ততটাই উত্তর কেবল দিয়ে যায়। আড়ালে ভাবে ওরা, আবার সপ্রকাশ করে এইভাবে, “যেমন মা-বাবাকে কষ্ট দিয়েছে, তেমন এখন ফল দেখুক। খুব উচিত হয়েছে। দেখুক মা-বাবার মনে কষ্টের মজা!

বড় হতে গিয়ে বাবা-মার বাধ্যতার ভীড়ে যে হারিয়েছে জীবনের অনেক মূল্যবান বিদ্যা, ক্ষয়েছে অমূল্য সময়ের ঐশ্বর্য, ত্যাগ করেও ত্যাগী না হয়ে অপরাধী সমন খেতাব! সে নরাধমের আজ অভিশাপে ক্ষয়! ভাবনার বিহ্বলতায় সঙ্কোচও সঙ্কুচিত হয়ে যায় পারমিতার। ভয় বাহু আছড়ে পড়ে মগজে। মা-বাবা বিপক্ষে বাক্যচয়ন যে মহা-অন্যায়, বৃহৎ গুণাহ্

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version