তিন বছর আগে তাকে নিয়ে আমার ‘জীবনের মুখগুলি’ সিরিজে যে লেখাটি লিখেছিলাম সেটি রিপোস্ট করছি। এছাড়া আমি মাসরুরকে নিয়ে আরও লেখা লিখেছি, তার তিনটি উপন্যাস, ‘আলথুসার’, ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ ও ‘আঁড়িয়াল খা’ নিয়ে তিনটি রিভিউ লিখেছি। লিখেছি কয়েকটি আড্ডার বিবরণ। তাকে নিয়ে আমি যত লাইন লিখেছি আমার ধারণা, মাসরুরও তা সমর্থন করবেন, তত লাইন খুব কম মানুষ লিখেছেন। জন্মদিনে প্রতিভাবান মানুষটিকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই। কামনা করি কথাসাহিত্যে পরবর্তী বাংলা একাডেমি পুরস্কারটি তার হোক।
—————————————–
জীবনের মুখগুলি ৮১
মাসরুর আরেফিন
তাকে প্রথম দেখি আমার কলেজ জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আজফার হোসেনের বাসায়। তাদের দুজনের অধীত বিষয় একই- ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য। সেসময় একদল জ্ঞানসন্ধিৎসু মেধাবী তরুণ, সক্রেটিসের যেমন, (আমরা আজফারকে সক্রেটিসই বলতাম) তেমনি আজফার হোসেনের শিষ্য হয়েছিল। মাসরুর হয়তো ততটা নয়, তবে আজফারের ভক্ত ছিল সে। পরবর্তীকালে ঘটনা এমন ঘটে যে মাসরুর ও আমি দুজনেই চাকরি নিয়ে কর্ণফুলীদুহিতা চট্টগ্রামে যাই আর কী আশ্চর্য থাকি একই পাড়ায় প্রতিবেশির মতো। মাসরুরের ব্যাংকিং ক্যারিয়ারের সেই শুরু। আমরা যেখানে ছিলাম সে জায়গাটির নাম হিলভিউ, হিল না বলে তাকে টিলা বলাই ভালো, এর পাদদেশের এক দালানে মাসরুর থাকতো, টিলাটপে আমি। বহুবছর বাদে টিলাটপ নয়, হিলটপেই চলে গেছে মাসরুর, আর যে ধারায় সে লিখছে তাতে বাংলাসাহিত্যের মাউন্টেনটপে যাবে বলেই প্রতীয়মান।
একটি বিদেশি ব্যাংকে ম্যানেজমেন্ট ট্রেনি হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বীতামূলক এক পরীক্ষার আগুনের মধ্য দিয়ে, বহু শক্তিমান প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়েই সে ওই সুবর্ণ চাকরিটি পেয়েছিল। এখন তার কলম যে আশ্চর্য শক্তিতে সোনালী অক্ষর লিখছে তাতে অনেক প্রতিদ্বন্দ্বীই পিছিয়ে পড়েছে। ক্যারিয়ার তৈরির সেই সময়ে মাসরুর লেখালেখির জগৎ থেকে কিছুটা দূরে সরে গিয়েছিল, অনেক বছর আগে একটি কাব্য প্রকাশ করেই সে চলে গিয়েছিল চোখের আড়ালে। আমি ভেবেছিলাম সে তার অন্যান্য স্ফুলিঙ্গ ছড়ানো কিন্তু দাবানল হতে অক্ষম বা অলস মেধাবী কবি বন্ধুদের মতোই হারিয়ে গেল। কিন্তু কিছু বছর পরে সে আবির্ভূত হলো বিশ্বসাহিত্যের এক দিকপাল ফ্রান্স কাফকার রচনাবলী ও চিরন্তন বিশ্বসাহিত্য হোমারের মহাকাব্য ‘ইলিয়াদ’-এর জটিল ও ঢাউস অনুবাদকর্ম নিয়ে। আমি চমকে তাকালাম, দেখি দুটো অনুবাদগ্রন্থের যে ভূমিকা লিখেছে মাসরুর (অনুবাদকের কথা) তাতে তার গভীরতর পাঠ, উপলব্ধি ও জ্ঞানের দীপ্তি প্রস্ফুটিত। তখনো কি জানি মাসরুরের অস্ত্রভাণ্ডারে আর কী কী অস্ত্র জমা আছে?
সে আবির্ভূত হলো আমাদের জাতীয় জীবনে বিপুল শোকাবহ বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নিহত হওয়ার ঘটনাকে উপজীব্য করে লেখা ‘আগস্ট আবছায়া’ নামের উপন্যাস নিয়ে। আমি কেবল বিস্মিতই হলাম না, আমি ও অগ্রসর পাঠককুল মুগ্ধ হলাম। যেমন বিষয়ের গুরুত্ব, পনেরই আগস্টের প্রতি মুহূর্তের দালিলিক বিবরণ ওই প্রথম আমরা সাহিত্যে পেলাম, তেমনি তার ট্রিটমেন্ট। আর কী ভাষাপ্রবাহ মাসরুরের! তার বাক্যগঠন জটিল ও মৌলিক। সকলেই বুঝে গেল আমাদের সাহিত্যজগতে একজন শক্তিমান ফিকশন রাইটারের আবির্ভাব ঘটেছে। পরের বছর সে লিখল ফরাসী মার্ক্সবাদী দার্শনিক আলথুসার নিয়ে ওই নামেরই উপন্যাস, তাতে নিয়ে এলো লন্ডনে পরিবেশবাদীদের আন্দোলন থেকে ধানসিঁড়ি নদীর তীরতক, উঠে এলো মাসরুরের প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশের ট্রাম দুর্ঘটনা নাকি আত্মহত্যা সে প্রসঙ্গ। বাংলা সাহিত্যকে, স্বীকার করি সে-ই প্রথম নয়, একটি বিশ্বমঞ্চে নিয়ে স্থাপিত করল। আমি মুগ্ধ হয়ে সে উপন্যাসের একটি রিভিয়্যু লিখলাম। ‘প্রথম আলো’ সেটি নিয়ে তাদের পাতায় ছাপল। আমি বল্লাম, বাংলা কথাসাহিত্যের ভুবনে লুতুপুতু উপন্যাস লেখার দিন শেষ।
এ বছরেই আরেকটি মাসরুরীয় চমক প্রতিভাবান ও প্রতিবাদী রাশিয়ান কবি ওশিপ মান্দেলশতামের রাষ্ট্রপরিচালিত মৃত্যু, যা আসলে হত্যাই, কেন্দ্র করে জোশেফ স্টালিনের একনায়কতন্ত্র থেকে আন্ডারগ্রাউন্ড পৃথিবীর কদর্য খেলা, ক্ষমতাবলয় ও আমাদের বাকস্বাধীনতা থেকে শুরু করে আমরা আদৌ বাঁচব কি না সেই নিয়তি যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তাদের ‘লুস খেলা’ নিয়ে একটি গ্রটেস্কু উপন্যাস লিখে চমকে দিলেন বোদ্ধা পাঠকদের। এবার তার মঞ্চ মস্কো। প্রতীকি এ উপন্যাসে রূপকের ব্যবহার লক্ষনীয়। এরপর যা বাকি থাকে তা হলো সেই নির্মম সত্য যে ওশিপ মান্দেলশতাম ও অগুণিত নিপীড়নবিরোধী মানুষ নিহত, রাষ্ট্রীয় রোলারে পিষ্ট। আমি ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ নিয়েও একটি রিভিয়্যু লিখলাম।
এই দুই লেখার সূত্রে আমি মাসরুর আরেফিনের ঘনিষ্ঠ হলাম। আর চক্ষুশূল হলাম অনেক লেখকের যারা মনে করে আমি মাসরুরের অতিরিক্ত প্রশংসা করতে গিয়ে অন্যদের খর্ব করেছি। যদিও এটা সত্যি মাসরুর কাঁপিয়ে দিয়েছেন অনেক লেখককে, অনেকেই লেখার টেবিলে একাকী হয়ে পড়েছেন, তবু বলব মহারথীরা স্ব স্ব অবস্থানেই আছেন, তাঁদের ঋণ মাসরুরও স্বীকার করেন, কথা হলো যিনি আবির্ভাবেই ভিনি ভেডি ভিসি, তিনি এ ধারায় লিখে গেলে মহীরুহ হবেন।
মাসরুরের শক্তির একটি জায়গা হলো বিশ্বসাহিত্য নিয়ে তার গভীর ও সুবিস্তৃত পাঠ। পাঠ থেকে যে উপলব্ধি তা হলো মনন ও মেধার পরিচায়ক। এর অপ্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে তার লেখায়, মাসরুর নিজেও তা অস্বীকার করেন না, কিন্তু তাতে ঋদ্ধ হয় তার লেখা, উপকৃত হয় বাংলা সাহিত্য। আমি যতবারই মাসরুরের সাথে কথোপকথন করেছি ততবারই বিস্মিত হয়েছি শুধু বিশ্বসাহিত্য নয়, বাংলাসাহিত্য নিয়ে তার পাঠ, পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনার পাণ্ডিত্য দেখে। আমি তার গদ্যে বোর্হেসীয় দালিলিকতা (documentation), মার্কেসীয় জাদুবাস্তবতা, কাফেস্কীয় নিরাসক্তি এবং জয়েসীয় স্ট্রিম অফ কনশায়েন্স দেখতে পাই। তার সাথে প্রতিটি আলাপন ভরে ওঠে সাহিত্যের দশদিগন্ত ছোঁয়া উজ্জ্বলতায়।
শুধু কথাসাহিত্য নয়, মাসরুর মেধার ঝলক দেখিয়েছে কবিতাতেও। নিটোল, সংহত ও পরিমিত নয় তার কবিতা, তাকে ঝর্ণাধারা বললে কম বলা হবে, বরং নদীর প্লাবনের মতো বল্গাহীন বলাই সমীচীন। মাসরুরের কবিতা মনে পড়িয়ে দেয় কবিগুরুর শেষ জীবনের ফ্রি ভার্সে লিখিত পুনশ্চ পর্বের কবিতার কথা। জীবনের অভিজ্ঞান, পঠনপাঠনজনিত প্রজ্ঞা ও অবলোকনের স্বাতন্ত্র্য মাসরুরের কবিতাকে আঙ্গিকের বিচারে আলাদা করেছে। তার দেখার চোখ ও দর্শন নিজস্ব। আমার মনে হয় অভিজ্ঞান নিয়ে মাসরুর কখনো গদ্য লিখছে, কখনো পদ্য লিখছে। ‘পৃথিবী এলোমেলো সকালবেলায়’ ও ‘পরিস্থিতি যেহেতু আগুন হয়েই আছে’ মাসরুরের কবিতার দুটো বই একেবারেই আলাদা স্বাদ দেয় আমাকে। ছন্দ মাপতে বসা আর পরিমিতি খুঁজতে বের হওয়া প্রথাগত সমালোচক হয়তো মাসরুরের কবিতা পাঠে নিরাশ হবেন, কিন্তু কবিতার মণিমুক্তো নিয়েই বাড়ি ফিরবেন।
লেখালেখির বাইরে মাসরুরের ব্যক্তিত্বের অনেকগুলো দিক আমার ভালো লাগে। এর একটি হলো সত্যকথন, গ্রিকরা যাকে পার্হেসিয়া বলে। সত্য বলার এই সৎসাহস এখন বাংলাদেশে ৯৫% বুদ্ধিজীবীর নেই। সত্য বলতে গিয়ে মাসরুর মাঝে মাঝে নিজের ঈর্ষণীয় ক্যারিয়ারকেও বিপদে ফেলে। পার্হেসিয়ার হাত ধরেই সে বলে দেয় তার বাবা একজন ছাপোষা ফুড ইন্সপেক্টর ছিলেন, অভাব অনটনের ভেতর সে বড়ো হয়েছে। কোনোরূপ ভণিতা করে না। তার চরিত্রের আরেকটি বিরল দিক হলো বিনয়। আমি যতবার তার অফিসে গিয়েছি, মাসরুর আমাকে লিফট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছে।
মাসরুর যে অসম্ভব মেধাবী তা তার শত্রুরাও স্বীকার করেন। প্রথার বাইরে এসে এক প্রবহমান ও শক্তিশালী গদ্যের দৃষ্টান্ত তৈরি করে মাসরুর এখন অনেক ভূতপূর্ব লেখকবন্ধুর প্রকাশ্যে না হোক আড়ালে শত্রু। তাতে ক্ষতি নেই, মাসরুরের কলম ধারলো হবে, আর তা যদি ধারালো করে তার ‘শত্রু’দের কলমও, তবে আখেরে বাংলা সাহিত্যেরই লাভ