Home অন্যান্য লম্বা চুলের বিডম্বনা

লম্বা চুলের বিডম্বনা

নুর এমডি চৌধুরী

0

আমি সিনেমা পাগল ছিলাম। পারিতো বিশ কিলো হেটেও সিনেমা দেখতাম। জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ থানাধীন গুনারীতলা গ্রামে জন্ম আমার।

বাবা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ছিলেন। সংসারের অবস্থাটাও ছিল ঢের ভালো। রোজ আট দশজন কাজের লোক লেগেই থাকতো কাজে। পাটের মৌসুমে পুরো বাড়ি জুড়ে পাটের ছড়াছড়ি ধানের মৌসুমে ধান গম সরিষা কাচামরিচ ইত্যাদি ইত্যাদি।

সংসারে সবার ছোট ছিলাম সে কারণেও আদর ছিল বেশ। আর মায়ের আদর যারতো কোন তুলনাই নাই।সেকারণে বাবার পকেটে তেমন হাত দেওয়া লাগতোনা। আমার সকল চাহিদার মুল সঞ্চালক ছিলেন আমার মা। আজও মা’কে আমি অনেক ভালোবাসি।

ছাত্র হিসেবে ভালো ছিলাম বটে তবে ঐ যে তিনজনের ভিতরে ফাস্ট বয় কিংবা নাই দেশে বুট কালাই সন্দেশ। এ কারণে হয়তো স্কুল পাড়ায় মহল্লার লোক সকল আদরও করতেন বেশ! বিশেষ করে প্রধান শিক্ষক গিয়াসউদ্দিন স্যারের এতোটাই প্রিয় ছিলাম আমি প্রকাশের ভাষা নেই।

পড়া লেখা যা করতাম তার অধিক গল্প উপন্যাস কিংবা বাবার আলমারিতে থাকা বেহেশতের জেওর, বুখারী শরীফ, আবু দাউদ শরীফ, তিরমিজি শরীফ মুসলিম শরীফের অসংখ খন্ড, তকদীরের বিশ্বাস নানা আংগিকের বই রীতিমতো পড়তাম।

বন্ধুরা মিলে বাড়িতে কেরাম কিনেছিলাম। সারা দিন কেরাম খেলতাম বাজি ধরে। আবার বল খেলা ছিল আমার সেরা নেশা। যত বড় কাজ হোক বল খেলার চেয়ে বড় কাজ আমার যে আর কিছু ছিলোনা সে কথা আমার মা জানতেন বাবাও জানতেন। তাই তাদের কোন কাজ আমাকে দেবার আগে সময়ের কথা ভেবেচিন্তে কাজটা দিতেন। নইলে নির্ঘাত অপমানিত হতেন। বস্তুত এতোটাই পাগল ছিলাম যে, কোন প্রহারই তার উর্ধে ছিলোনা।

সিনেমার তারকা ওমর সানী আমার প্রিয় ছিল। ফুটবলার তারকা ক্যানিজিয়া ছিল আমার ভীষণ ভীষণ ভাবে প্রিয় আইডল। তাই উভয়কে ফলো করতে গিয়ে একটা জিনিস বেছে নেই লম্বা চুল রাখা।

চুলের প্রতি চুলের নানান কাটিং স্টাইলের প্রতি আমি অগাধ দুর্বল ছিলাম শিশুকাল থেকেই। তৎকালীন সময়ে এমন কোন কাটিং ছিলোনা যা আমার চুলেতে পড়েনি।

সবিশেষ লম্বা চুলে তাক লাগাতে শুরু করলাম খেলার মাঠে। স্টাইকারে খেলতাম। মাঝেমধ্যে মাঝমাঠ থেকে বলকে কবজি করে দৌড়াতাম দৌড়াতাম আর উৎসুক জনতা ক্যানিজিয়া..ক্যানিজিয়া গোল.. গোল.. গোল অসীম উৎসাহ ধ্বনিতে মুখরিত হতো কোত্থেকে যে শক্তি সাহস বুদ্ধি শরীরে এসে ভর করতো ভেবেই পেতামনা।

লং-টার্ম লং-রান শর্ট-কীক হাকিয়ে বলকে ঠেলে দিতাম চতুর গোলকীপারকে তাক লাগিয়ে গোলবারের ভিতরে। প্রফুল্ল জনতার করতালি আর অভিবাদনে মুগ্ধ হতাম। উত্তর পাড়ার লাজুক খ্যাত এই ছেলেটি কিভাবে যে হয়ে উঠতো চঞ্চল অস্থির দুরন্তপনায় দর্শক গ্যালারিতে জাগিয়ে তুলতো মুহূর্মুহু আনন্দ ধ্বনি। পরনের জার্সি খুলে জনতার উদ্যেশ্যে নেড়ে নেড়ে বিকিয়ে দিতো ভালোবাসার সৌরভ।

আমার প্রতিটি খেলায় দর্শক সারিতে দাঁড়িয়ে খেলা উপভোগ করতেন আমার বাবা। একটা গোল দিলে দেখতাম বাবাও অপরিসীম খুশি হয়ে হাসছেন। আর বাবার এই আনন্দ হাসিটা খেলার মাঠে যে কত বড় একটা প্রেরণার উৎস ছিল তা আমি নয় শুধু প্রতিটি খেলোয়াড়ের জন্যই তাই। তিনি থাকতেন আমার প্রথম প্রেরণার উৎস। আজ বাবা ইহধামে নেই। বাবা তোমাকে অনেক মিস করি। তোমার মত বাবা পাওয়া সত্যিই বিরল।

আমার বাবা চাইতেন ছেলে আমার হোক এক্সট্রা অর্ডিনারি একদম স্পেশাল কিছু। আমি হতে পারিনি। পরিকল্পনাহীন জীবন দিকহীন সমুদ্র নাবিকের মত শুধু এগিয়ে যাওয়া এগিয়ে যাওয়া গন্তব্যহীন অসীমপানে।

আমার প্রতিটি কাজের উপর বাবার সাপোর্ট ছিলো বেশ। স্কুল পড়ুয়া ছাত্র অবস্থায় অসহায় ছাত্রদের পড়ালেখায় সহযোগিতার কথা ভেবে গ্রামের দরিদ্র মেয়েদের বিয়েতে কিছু সাহায্য অনুদানের কথা চিন্তা করে বন্ধুরা মিলে গঠন করেছিলাম সানফ্লাওয়ার ছাত্রকল্যাণ সংসদ।

তহবিল গঠনকল্পে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম। পরপর দুইবার। প্রথমবারে প্রধান অতিথির আসনে আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলাম ব্যারিস্টার আব্দুস ছালাম তালুকদারের সন্তানতুল্য ভাতিজা শাহীন তালুকদারকে। দ্বিতীয়বার প্রধান অতিথির আসনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান বিশিষ্ট ব্যবসায়ী দানবীর সমাজসেবী বর্তমান বাংলাদেশে ধনীদের স্থলাভিষিক্ত ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান জনাব হাসান মাহমুদ রাজা মিয়া।

নব্বই দশকের কথা। ভেবেছিলাম উনার মত বিশিষ্ট ব্যক্তি কি আর ক্ষুদ্র আয়োজনে সাড়া দিবেন। অপ্রস্তুত ছিলাম। আসরের নামাজের কিছুক্ষণ আগে বড়ভাই ফায়জুল ইসলাম লাঞ্জু ভাই খবর দিলেন রাজা মিয়া এসে পড়েছেন। বাজারের বড় মসজিদে নামাজ শেষে আমাদের প্রোগ্রামে যোগ দিবেন।

আমরা দ্রুত বসার জন্য একটা বড় পরিষরের রোম নিলাম। নামাজ শেষ করলেন এবং এলাকার ময়মুরুব্বিদের সহিত কুশল বিনিময় করলেন। মসজিদ ও এতিমখানার জন্য তিনি নগদ এক লক্ষ টাকা দান করলেন।

তারপর আমাদের প্রোগ্রামে উপস্থিত হলেন। সাথে এলাকার ময়মুরুব্বিদেরকেও উপস্থিত করলাম। সংগঠনের সভাপতি ছিলাম সেই সুবাধে আমাকে সভাপতির আসনে বসানো হলো।

সুন্দর আলোচনা হলো। আমি আমাদের সংগঠনের উদ্যেশ্য উপস্থাপন করলাম। জনাব রাজা মিয়া খুশি হয়ে নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা দান করলেন।

এভাবে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সামাজিক নানা উন্নয়নমুলক কাজে যোগদান করি। গ্রামের মানুষের নানামুখী সমস্যার কাজে অবস্থান করি। এমনকি বিচার শালিসির ক্ষেত্রে কোথাও কোন অনিয়ম সংগঠিত হলে আমরা সংগঠন এর সবাই মিলে প্রতিহত করি।

অষ্ট আশির বন্যার সময়। সারা গ্রাম তখন পানিতে ডুবে থৈথৈ। সম্পর্কে আমার চাচাতো বোন সে কলেরায় আক্রান্ত। এমনই অবস্থা যে তার স্বামী পর্যন্ত সন্তানদের নিয়ে পালিয়েছে। মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে আছে মেঝেতে।

সেসময় ঘরে ঘরে কলেরা রোগীর ব্যপক প্রাদুর্ভাব। তাই আমাদের সাথে সেলাইন রাখতাম প্রচুর। খবর পাওয়া মাত্র কালক্ষেপণ করলাম না। দৌড়ে গেলাম। সাথে রাখা সেলাইসন খাওয়ানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু রীতিমতো ব্যর্থ হলাম।

উপায়য়ান্তা না পেয়ে বন্ধু চারজন প্রয়াত বিপলব সরকার, প্রয়াত ওয়াহাব, বন্ধু রাজ্জাক বর্তমান পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর এই চারজন মিলে তাৎক্ষণিক ভেলায় উঠালাম। তখন রাস্তার উপরেও এক কোমর পরিমান পানি। প্রায় ৪ কি/:মি: পথ ভেলা ঠেলেঠেলে থানা সদর হাসপাতালে ভর্তি করলান।

আল্লাহর কাছে বন্ধুরা মিলে সরল প্রাণে প্রার্থনা করলাম হে আল্লাহ আমাদের আশা টুকু নিরাশ করিওনা। সত্যিই সেদিন আল্লাহ আমাদের চার বন্ধুর ফরিয়াদ শুনেছিলেন। একটানা এক সপ্তাহ চিকিৎসার পর তাকে বাড়ি ফিরে আনতে পেরেছিলাম হাসি মুখে।

আগেই বলেছি আমার প্রতিটি কাজের উপর আমার বাবার আস্তা আর সমর্থন ছিল। কিন্তু যখন থেকে মাথার চুল বড় রাখতে শুরু করলাম তখন থেকে আমার বাবার আমার উপর একটু একটু রাগ। মাঝে মধ্যে মা’কে আমার ব্যপারটা নিয়ে বকাও দিতো।

দিন যেতে থাকে বাবার রাগ প্রকট থেকে প্রকটতর হয়। আমিতো জানিনা কিংবা বুঝিওনা। যখন বড় চুলের প্রতি আমার নেশা গাঢ় হয়ে উঠে তখন আমার বাবা লোক মারফত চুল ছোট রাখার আদেশ দিলেন। বাবার স্নেহের প্রতি আস্তা রেখে আমি আর বিষয়টিকে খুব সিরিয়াস ভাবে নিলামনা।

একদিন বাবার খুব প্রিয় মানুষ সম্পর্কের ভাগিনা অর্থাৎ আমার ফুফাতো ভাই। ফুফাতো ভাইদের মধ্যে উনিই সবার বড়। আমরা উনাকে বেশ ভয় পেতাম। এবং উনিও রিজার্ভ থাকতেন সবসময়। কম কথা বলতেন। মাটির দিকে সব সময় নজর দিয়ে চলতেন। গ্রামের মোড়লও।

একদিন রাস্তায় চেয়ার পেতে বসে আছেন তিনি। গ্রামের মুড়ল বলে কথা। ভাবগাম্ভীর্যে ভরা। আমি সালাম দিয়ে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিলাম। জোরালো কন্ঠে খাস বাংলায় ধমকের স্বরে, এই ছ্যাড়া -এই, এদিক আয়। কাছে গেলাম। খুব নাকি শেয়ান হইছস? মুরুব্বি মানসনা? বাপের ইজ্জত বুঝসনা? গেরামের সবাই তারে সম্মান করে আর তুই ছেলে হয়ে কথা শোনসনা কথাটা কি সত্যি?

আমি আগা মাথা কিচ্ছুই বুঝতেছিনা। প্রতিত্তোর করার সাহসতো দূরে থাক ছেড়ে দিলে বাঁচি। কিন্তু ছাড়ার কোন নিশানা নেই। অনেক কথা বলার পর পকেট থেকে একশ টাকার একটা নোট বের করলো। হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো।

এই নে, সোজা সেলুনের দোকানে যাবি। বলবি আর্মী কাটিং দিয়ে দিতে। আর আমি এখানেই বসা রইলাম। তুই চুল কেটে যতক্ষণ না আসবি আমি কিন্তু ততক্ষণ এখানেই বসা থাকবো। অতঃপর…

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version