Home সাহিত্য ভাইস চেয়ারম্যান

ভাইস চেয়ারম্যান

নুর এমডি চৌধুরী

0

আশরাফ মাহমুদ। তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান। সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। বিয়ের বয়স পার হয়েছে কবেই বিয়ে করেননি। তার নাকি কোন মেয়েই পছন্দ নয়। তাই পরিবারের পক্ষ থেকে এখন আর বিয়ের ব্যাপারে কোন আলাপ চারিতা নেই। কিন্তু বেশ দিন যাবত লোক মুখে শুনা যায় আশরাফ মাহমুদ নাকি রোজ মন্টু পাইনেতির ঘরে যাওয়া আসা করে।

মন্টু পাইনেতি হতদরিদ্র ঘরের একমাত্র সন্তান। মা জহিরন মন্টুকে পাঁচ বছর বয়সে রেখেই মারা যান। বাবা বেঁচে ছিলেন কিন্তু মন্টুর বয়স যখন ছাব্বিশ তখন কলেরায় নিমজ্জিত হয়ে বাবাও মারা যান। পরের বাড়ি কামলা খেটে খেটে বড় হয়েছে মন্টু। বাবার মৃত্যুর পর বাবার রেখে যাওয়া পানের ব্যবসায় সে নিজেকে আত্মনিয়োগ করে।

বয়সের দিক থেকে আশরাফ মাহমুদ আর মন্টু মিয়ার খুব একটা পার্থক্য নেই। মন্টু খুব হলে এক দেড় বছরে ছোট হবে। ছোট কালে দু’জনে এক সাথে প্রাইমারী স্কুলে যেতো। সে সুবাধে সম্পর্কটা বন্ধু সুলভই রয়ে গেছে।

অভাবের তাড়নায় ক্লাস থ্রী পর্যন্তই পড়ার ভাগ্য হয়েছিল মন্টু মিয়ার। তারপর গায়ে গতরে কামলা খাটাখাটি কত তার হিসেব নেই। বছরমানি কামলা খাটতো মন্টু কিন্তু মোড়লগণ মাইনে দিতো কম। তাই সে বছরমানি কামলা খাটা বাদ দিয়ে দিন হাজিরার কাজ করেছে বেশদিন তাতেও পোষাইতনা। বছর শেষে হাতে পয়সা কানাকড়িও থাকেনা। তারচেয়ে বরং বছর মাইনে কামলা খাটলে বছর শেষে কিছু জমা টাকা পাওয়া যায়। তাই তার জীবনের বেশ কাল বছরমানি কামলা খাটনই খেঁছেটে। কিছুদিন নদীর ঘাটে পারাপারের নৌনা বাইতো মন্টু মিয়া। যেকালে কাজী ঘাইটেল এর ঘাটটা বন্ধ হয়ে গেলো সেকালেই কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে তার বাপটাও মারা গেল। আপন বলিতে তার আর কেহ রইলোনা। বড় একা হয়ে গেলো। না রইলো মা, না রইলো বাবা। তাই কামলা খাটন ছেড়ে দিয়ে মন্টু বাবার পান বিক্রির পেশাটাই বেছে নিলো।

মনটু মিয়া দিনে দিনে ব্যাপারী হয়ে উঠলো। একদিকে বাবা মা হারা এতিম ছেলে অন্যদিকে বয়সে জোয়ান শান্ত শিষ্ট নম্র ভদ্র দেখে বাজারের বড় ব্যবসায়ী হিন্দু নারয়ণ বাবুর নজর কাড়লো। মন্টু মিয়াকে খুব মহব্বত করতে শুরু করলো বাবু নারায়ণ। মাঝে মধ্যে টাকা পয়সা দিয়েও ব্যবসায় সহযোগিতা করতে লাগলো। এমনি ভাবে কেঁটে গেল কয়েক বছর।

দেখতে দেখতে মন্টু একদিন সাবালক হয়ে উঠলো। তখন বাবু নারায়ণ তার বন্ধু আবেদ আলীর নাতনী বিলকিস বেওয়ার সহিত বিয়ে দিয়ে দিলো।

বিলকিস বেওয়া দেখতে খুব সুন্দরী। রূপের কি বর্ণনা দিবো। কল্পনার রাজ্যেও এরূপ সৌন্দর্য যেন হার মানায়। বিয়ের পরদিনই খুব খুশি মনে বাবু নারায়ণ এর কছে যায় মন্টু মিয়া। মনটু মিয়ার মুখে হাসি দেখেই বাবু নারায়ণের শংকা দূর হয়। বাবু তার অন্দর ঘরে ডেকে নিয়ে হাতে উপহার তুলে দেয়। বেশ কিছুক্ষণ গল্পও করে।

এবার খুশি মনেই মন্টু মিয়া নারায়ণ বাবুকে বলে, বাবু এতো সুন্দর বউ দিলা আমি নিতান্তই খুশি। কিন্তু আমার যে বড়ড় ভয় হয় গো! যাহা তুমি দিলা তাহা কি সারা জীবন আটকিয়ে রাখিতে পারবো! মনে হয় মন্টু মিয়ার ঐশ্বরিক আত্মা সেদিন আন্দাজ করতে পেরেছিল কি হতে যাচ্ছে জীবনে। ফের বিষনঞ্চিত্তে বললো বাবু, আশীর্বাদ দিও। কেউতো আর নসীবের কথা জানেনা! বাবু নারায়ণ মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মুচকি হাসি হেসে আশীর্বাদ করে বলে এসব আজগুবি কথা ক্যান ভাবিস মন্টু।

মন্টু মিয়া এবার প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে নেয় বলে বাবু, ঘর ভাংগাচূড়া যাই আছে থাক বাবার ভিটেমাটি স্মৃতি স্বরুপ আর কিছুকাল যাক। তাছাড়া হাতে কানা কড়িও নেই তয়, উঠানের বেড়ার যে হাল যাও ছিল কলা পাতা মোড়ানো আইঠে বেড়া সেও সেদিনের ঝড়ে উইড়া নিছে। টাকা পয়সা যা ছিল বিয়ের বাজারেইতো সব শেষ হয়ে গেলো। কিছু টাকা কড়ি যদি দিতে সেরে নিতে পারতাম বেড়াটা। দু’দিন পরেই না হয় শোধ দিয়ে দিতাম।

নইলে নতুন বউ কিনা কি কয় বড়ই শরমের কথা বাবু। বাবু নারায়ণ মন্টুরে বিমুখ করলোনা। প্রত্যাশার চেয়ে ঢের বেশিই দিয়ে বিদায় করলো তাকে। মন্টু মিয়ার খুশী আর দেখে কে! পর দিনই নতুন টিন এনে উঠানটারে চারদিক দিয়ে ঘীরে দিলো।

এমন রূপবতী বউ পেয়ে মন্টু মিয়া যেন আনন্দে আত্মহারা। নতুন বউ তবু তার লাজ শরমের বালাই নেই। সবার সামনে বউ এর সাথে খুশগল্প হাসিঠাট্টা বউ যদি লজ্জা পেয়ে আঁচলে মুখ ঢাকতো মন্টু মিয়া সেই অভিমানে মেতে উঠতো।

পরম হাসি আর আনন্দেই দিন যেতে লাগলো। একদিন মন্টু মিয়ার ঘরকে আলোকিত করে এক কন্যা সন্তান এলো। স্ত্রী বিলকিস বেওয়ার আশা ছিল তার ঘরকে আলোকিত করে যেন একটা ছেলে সন্তান আসে কিন্তু কন্যা সন্তান দেখে ততটা খুশি হতে পারেনি বিলকিস বেওয়া।

প্রথম সন্তানের জন্মের পর বিলকিস বেওয়ার রূপ লাবণ্য যেন সোনালী সূর্যের আলোর ন্যায় ঝলমল করতে লাগলো। শাড়ির অন্তর ভেঁদ করে রূপ লাবণ্য যেন আলোর কনার ন্যায় বিচ্ছুরিত হতে লাগলো।

ঐদিকে আশরাফ মাহমুদ বাবার মৃত্যুর পর এই প্রথম বারের মত ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে নেমেছে। ভোটাভুটির পর এলাকাজুড়ে আনন্দ মিছিল। মানুষ আর মানুষ অনেক ভোটের ব্যবধানে আশরাফ মাহমুদ জয়ী হয়েছে। নতুন চেয়ারম্যান হয়েছে। সকলের দাবী আনন্দ উৎসব করতে হবে। বাউল গানের উৎসব হবে উৎসবের দিন তারিখ ধার্য করা হলো। যথারীতি অনেক মানুষের সমাগম হলো। সেদিন মন্টু মিয়াও স্ত্রী বিলকিস বেওয়াকে সংগে নিয়ে সাজিয়ে গুজিয়া চেয়ারম্যানের সামনে এসে হাজির হলো।

একে-তো রূপের ঝলকানি তার উপর সাজগোজ এমন রূপের ঝলক দেখে চেয়ারম্যান বাকহীন, রুদ্ধ হয়ে পড়েছে। বিলকিস বেওয়ার আপাদমস্তক বেশক্ষণ চেয়ারম্যান অবলোকন করলো। ভাবলো, গোবরে দেখি পদ্মফুল ফুঁটেছে। কার মাঝে কিসের অবস্থান দিছোগো তুমি খোদা। তোমার নীলা বুঝা বড় দায়। কোথায় মন্টু আর কোথায় বিলকিস। এ যেন আকাশ আর পাতালের খেলা।

সত্যিই তাই। এতোটাই রুপ যৌবনের ঝলকানি ফুটে উঠেছিল যে, যেন নিমিষেই চেয়ারম্যান এর মন কেঁড়ে নিলো বিলকিস বেওয়া। সেদিন নিজ হাতে চেয়ারম্যান বাহারি খাবার খাওয়ায়েছিল বিলকিস বেওয়াকে। বিলকিস বেওয়াও কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিলো। তাই সেও চেয়ারম্যানের ন্যায় উতাল তরংগে ভাসতে লাগলো।

কথায় বলেনা-নারীর মন আকাশের রঙ ক্ষণে ক্ষণে হয় পরিবর্তন। বিলকিস বেওয়ার মনেও তাই দেখা দিলো। মনে মনে নিজের ভাগ্যের প্রশংসা করতে লাগল। চেয়ারম্যানের নজর কাড়া সেকি কম ভাগ্যের বিষয় গো! আপন মন রাজ্যে বিলকিস বেওয়া স্বপ্নের জাল বুনতে লাগলো।

যখন চেয়ারম্যান এর সন্মোখ থেকে বিলকিস বেওয়া চলে যাবে বলে মনস্থির করলো ঠিক তখনই যে মায়াবী একটা চাহনি চেয়ারম্যানের দিকে ছুড়ে দিয়েছিল যে আর তাতে সত্যিই চেয়ারম্যানের মস্তিষ্কে এক ভুমররা উদয় হয়েছিল। সেদিন অনেক ব্যস্ততার ছিল চেয়ারম্যানের তাই অন্তরের প্রেম শিকলে বাঁধিয়া প্রেমিকাকে বিদায় করিল।

প্রেমে কি শুধু চেয়ারম্যানে পড়েছে? না, প্রেমে পড়েছে বিলকিস বেওয়া। নারী লোভী, নারী ছলনাময়ী, নারী স্বার্থ মোহ আর মহা মায়াবিনী। বিলকিস বেওয়াও তার ব্যতিক্রম রইলোনা। আর ওদিকে চেয়ারম্যান এর অন্তর চোখে বিলকিস বেওয়ার লাবণ্যময়ী রূপের ঝলকানি বারবার ঝলক বাতির মত ঝিলিক ঝিলিক দিতে থাকল।

হায়রে বিচিত্র মন! হায়রে বিচিত্র জীবন! হায়রে বিচিত্র সংসার! সেদিন দেখেছিলাম সুখের ঘরে কিভাবে জ্বলন্ত আগুনের স্তূপ বাসা বাঁধে নিমিষেই। কিভাবে তছনছ হয়ে যায় সাজানো একটি সংসার। কস্মিনকালে যে মানুষটি ভাবেনি জীবনের উত্থান পতনের কথা আজ অকৎস্যাত তার জীবনে কালবৈশাখীর ঝড় নেমে এসেছে তছনছ করে দিতে বসেছে একটা সুন্দর সাজানো বাগান।

সেদিনের পর থেকে রোজ সকাল বিকেল চেয়ারম্যান বিলকিস বেওয়ার কাছে আসে যায়। বিলকিস বেওয়াও দিনে দিনে স্বামী সন্তানের প্রতি বিরূপ আচরণ করতে শুরু করে। বড় মেয়ে বেশ বড় হয়েছে এখন সে সব কথাই বুঝে । বাবা মন্টু মিয়া সারাদিন বাহিরে থাকে রাতে বাড়ি ফিরার পর মেয়ে বাবাকে সব কথা ফিসফিস করে কানে কানে বলে দেয়। বাবা কিছু বলতে গেলে বিলকিস বেওয়া যে বিভিশিখাময় আচরণ করে তাতে মন্টু মিয়া ভাবে যেভাবে চলছে সেও ভালো অন্তত মেয়েটার জীবনে যেন ঝড় না আসে।

অল্পদিনেই পাড়া মহল্লায় জুড়ে চেয়ারম্যান আর বিলকিস বেওয়ার কুকর্মের কথা ছড়িয়ে পড়লো। এমন মান ইজ্জত লুটে যাওয়া কথা শুনার পর চেয়ারম্যানের বড় ভাই আফতাব মাহমুদ প্রতিবাদী হলে তাকেও চেয়ারম্যানের মুখ থেকে অনেক কটু কথা শুনতে হল। বিলকিস বেওয়ার রুপ যৌবনে চেয়ারম্যান এখন এতোটাই মরিয়া হয়ে উঠেছে যে বিলকিস বেওয়া হীনে সে অন্ধ, দিশেহারা, মাতাল।

বিলকিস বেওয়াকে যে তার চাইই চাই।
যে কিনা সমাজের শীর্ষমনি। যার দ্বারা কিনা সমাজের অপকর্ম দূর হবার কথা আর সেই কিনা হয়ে উঠেছে অপকর্মের হোতা। কার সাধ্য আছে চেয়ারম্যান এর বিরুদ্ধে কথা বলবে।
প্রেম ভালবাসা তো অপকর্ম নয়। অপকর্ম সময়ের, অপকর্ম পরিস্থিতির। এটাকে প্রেম বলেনা এটা পরকীয়া। ইসলামে এর শাস্তিও ব্যপক। যে প্রেম যে ভালবাসার সহিত জড়িয়ে রয়েছে কতটি প্রাণ তাদের কি হবে। প্রতিনিয়ত সন্তানের সামনে ডেকে এনে মন্টু মিয়া স্ত্রীকে বুঝায়। কান্নারত চোখে অনুনয় বিনয় করে কিন্তু বিলিকিস বেওয়া যেন তাতেআরও রাগে অগ্নিশর্মা হয়।

“হায়রে বিধাতা! হায়রে জগত পিতা!
একি পাষণ্ড খেলা তুমি খেলো
খেলবেই যদি এমন নিষ্ঠুর খেলা
সন্তানের দশাটা কি বলো!

কে নিষ্পাপ শিশুটাকে মায়ের মমতা দেবে। কে তুলে দেবে একমুঠো ভাত। এখন পরিস্থিতি এতোটাই নাজুক হয়েছে যে, কেউ কাউকে ছাড়া বাঁচতে পারছেনা। তাদের চোখে যেন কোন লাজ সরম নেই। না চেয়ারম্যানের, না বিলকিস বেওয়ার। ভালবাসায় তারা এখন দু’জনেই অন্ধ।

যেদিন মন্টু মিয়া বুঝতে পেরেছিল বিলকিস বেওয়া আর চেয়ারম্যানের প্রেমের গভীরতা অনেক দূর এগিয়েছে সেদিন থেকেই সমাজের গণ্যমাণ্য ব্যক্তিবর্গের কাছে গিয়েছে। বারবার অনুনয় বিনয় করে কেঁদেছে কিন্তু কেউ তার ডাকে সাঁড়া দেয়নি। কেউ এতটুকু সান্ত্বনার বাণীও শুনাতে আসেনি যে বিন্দুমাত্র কষ্ট তার হৃদয়ে লাঘব হবে। বরং তার বোকে লুকিয়ে থাকা কষ্টকে কথার খোঁচা দিয়ে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে তারা।

কেউ বলেছে ছিঃছিঃ এমন বউকে নিয়ে এখনও ঘর করিস? কেউ বলেছে তালাক দেসনাই এখনো? আবার কেউ বলেছে বিষ খেয়ে মরতে পারিসনা হারামজাদা। কত কবিরাজ, কত হুজুর কত পানি পড়া এটা সেটা কত কি যা আনা হয়েছে টাকার মত শুধু টাকাই গেছে বিলকিস বেওয়ার মক্ন ফিরেনি।

হঠাৎ একদিন গভীর রাতে বিলকিস বেওয়া সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সন্তানের মায়াকে পদদলিত করে চেয়ারম্যানের হাত ধরে পালিয়ে যায়। আর এদিকে মুখ থুবড়ে মেজেতে পড়ে থাকে মন্টু মিয়া মন্টু মিয়ার একমাত্র নেয়ে রেবেকা।

কি পাষণ্ড মা। কি নিষ্ঠুর মা। পৃথিবীতে এমনও মায়ের জন্ম হয় যে কিনা নিজ হাতে সন্তানকে গলা টিপে হত্যা করতে পারে। এ যে তার চেয়েও পাষবিক, তার চেয়েও নির্মম, তার চেয়েও কঠিন বাস্তবতা। কে শুনে সন্তানের বোক ফাঁটা আর্তনাদ, হৃদয়ের করুণ আকুতি। কে দেখে মন্টু মিয়ার চোখের অগ্নিঝরা জ্বল।

সেদিন সমাজের সকলেই কতনা তিরস্কার করেছিল মন্টু মিয়াকে। কতনা থুথু ছিটিয়েছিল ঊর্ধ্বাকাশে চেয়ে। যে যেভাবে পেরেছিল সেভাবেই মন্টু মিয়ার কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়েছিল। এক পর্যায়ে এমনই পরিস্থিতি উদ্ভব হইলো যে, মন্টু মিয়ার জীবন মরণের প্রশ্ন হইয়া দাঁড়াইলো।

নিয়তি ফের চোখ তুলে তাঁকিয়েছিল। কাউকে ছাড়া কি কেউ বাঁচেনা? নিশ্চয়ই বাঁচে। বাঁচে, নিয়তির অপার মহিমায় বেঁচে থাকে ঠিকই। কিন্তু দাগ থেকে যায়। যে দাগ অতি কষ্টের কোন দিন মুছেনা, কোনদিন মলিন হয়না। সে দাগ যে চিরায়ত অভিশপ্তের।

সন্তানের মুখপানে চেয়ে যেন মন্টু মিয়া চোখ তোলে তাকাইতেও পারেনা। হৃদয় বিদারক কষ্টে দু হাত তোলে শুধু কায়মনোবাক্যে প্রভুর কাছে প্রার্থনায় করে। হে প্রভু! তুমি এর বিচার করিও! যে আমার সুখের সংসারে দুঃখের আগুন দাও দাও করে জ্বালিয়ে দিলো তুমি তার বক্ষে তুষের অনল জ্বালিয়ে দিও প্রভু। জালিয়ে দিও!

সুখতো আমি চাইনি এতোটা যতোটা তুমি আমাকে দিয়েছিলে। একসময় ভেবেছিলাম আমিই বুঝি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখী মানুষ । এখন ভাবি আমার মত দুঃখী দুনিয়ায় আর কেউ নেই! অসহায় সন্তানের মুখ পানে চাহিলে আমার যে কি যন্ত্রণা তা কেবল তুমি ছাড়া কেউ বুঝবেনা প্রভু।

সময় চলছ্র তার নিয়মে। মন্টু মিয়া কষ্টে কষ্টে যন্ত্রণা সইতে সইতে মরণাপন্ন অবস্থা যখন খবর পেয়ে ছুটে আসে বাবু নারায়ণ। ব্যবসার কাজে কলকাতা থাকলে খবর পেয়ে আর দেরি করে নাই। এসেই মন্টু মিয়ার বাড়ি যায়। মন্টু মিয়া বাবুকে দেখেই ভূত দেখার মত চমকে উঠে। বাবু, বাবু বলে জড়িয়ে ধরে বাবুকে। অনেকক্ষন হাউমাউ করে কাঁদে মন্টু মিয়া। অনেকক্ষণ বাবুও দু’চোখে জল ফেলে। এরপর বাবু তার সাধ্যমতো সান্ত্বনা দিতে দিতে বেশ শান্ত করে তুলে তাদের।

শুধু সান্ত্বনাই নয় সেদিনের পর থেকে বাবুর স্নেহ মায়া মমতার পরশ বুলিয়ে মন্টু মিয়া ও তার মেয়ে রেবেকার মনে মৃদু হাসির সম্ভাবনা আনে। মনের কষ্ট দিনে দিনে লাঘব হতে থাকেে। পরিবারের মাঝে ফের স্বচ্ছন্দতাও ফিরে আসতে থাকে। মেয়েটা যেন এখন আর খুব একটা মায়ের কথা ভেবে কষ্ট পায়না। কেউ জিজ্ঞেস করলে যেন দিব্বি বলে দিচ্ছে মা মরে গেছে।

বাস্তবতা যেন এখন মন্টু মিয়া বুঝতে শিখেছে। সব দিক ভেবে বাবু নারায়ণ ফের মন্টু মিয়াকে বিয়ে করায়ে দেয়। দিনে দিনে সৎ মা আর সৎ মা থাকেনা। যেন হয়ে উঠে আসল মা। তার পর হয়তো কোন একদিন সৎ মা’র ঘরে তার আপন সন্তানের আবির্ভাব হবে। দিনে দিনে হয়তো রেবেকার জীবনে ফের নেমে আসবে তমিস্রার কালো রাত্রি। নয়তোবা…।

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version