Home জাতীয় একটি ছবি ও ইতিহাসের দায়

একটি ছবি ও ইতিহাসের দায়

খায়রুল আনোয়ার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও বিশ্লেষক

0

রাজনীতির মধ্যে ইতিহাসের নানা পর্বে আপসকামিতা ছিল, সীমাবদ্ধতা ছিল—এ সবই সত্য, কিন্তু একই সঙ্গে এটাও সত্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অসাধারণ অবদান ছিল এবং সেজন্য নিঃসংকোচ এবং নিরঙ্কুশ স্বীকৃতি তাঁর প্রাপ্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি অধিকাংশ বা সকল বাঙালির নেতা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। তিনি আওয়ামী লীগের নেতায় পর্যবসিত হয়েছিলেন, যার জন্য অন্য অনেকের সঙ্গে তিনি নিজে ও তাঁর দল কম দায়ী নন। তবে মুজিব হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের রাজনীতির স্বাভাবিক বিকাশকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।’

শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর দেশে অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। জাতীয় সংসদ বাতিল হয়। খন্দকার মোশতাক ৮৩ দিন এবং বিচারপতি সায়েম ১৬৬ দিন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি হন। তিনি ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সেনাবাহিনীর কতিপয় কর্মকর্তার হাতে নিহন হন। জিয়া ৪ বছর ৩৯ দিন রাষ্ট্রপতি ছিলেন। জিয়ার শাসনকাল এবং হত্যাকাণ্ড নিয়ে কামরুদ্দীন আহমদ তার ‘স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অতঃপর’ বইয়ে লিখেছেন, ‘তাঁর (জিয়ার) শ্লোগান ছিল Money is no Problem অর্থাৎ অর্থ কোনো সমস্যা নয়। যার ফলে ১৯৮০ সাল থেকেই টাকা-পয়সা কঠিন থেকে কঠিনতর সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পেতেই লাগল। তবু ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত জিয়াউর রহমানের ভাবমূর্তি ক্রমাগত বিকাশ লাভ করেছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যে। তাঁর ভাবমূর্তি ক্রমাগত অবক্ষয় শুরু হয় ১৯৮০ সাল থেকে—তাঁর পার্টির জন্য। পার্টির লোকগুলো নানা কারণে ঝগড়া-ঝাটি আরম্ভ করে। পারমিট ব্যবসা বিশেষ করে জনশক্তি রপ্তানী প্রভৃতির জন্য মন্ত্রীদের বিরুদ্ধেই অপপ্রচার আরম্ভ করেছিল তা নয়, জিয়াউর রহমানের নানদিক সম্বন্ধেও তারা বাইরে প্রকাশ না করলেও ভিতরে সমালোচনা করতো।’

শেখ মুজিব ও জিয়ার হত্যাকাণ্ড নিয়ে কামরুদ্দীন আহমদ তার বইয়ে লিখেছেন, ‘শেখ মুজিব ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন তাঁর ধানমন্ডির বাড়ি থেকে। পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী ও পরে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরেও তিনি তাঁর ধানমন্ডির বাড়ি ছেড়ে প্রেসিডেন্টের সরকারী বাড়িতে উঠে যাননি। যদিও সেই বাড়ির নিরাপত্তা রক্ষা করা সম্ভব ছিল না। তাঁর এই বাসভবনটিকে তিনি একটি ঐতিহাসিক স্থান বলে মনে করতেন। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টে ঐ বাড়িতেই তিনি নিহত হন এবং তাকে হত্যা করেছিল সেনাবাহিনীর একটি অংশ, কে তাদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল তা অবশ্য সঠিকভাবে জানা যায়নি।’ জিয়ার হত্যাকাণ্ড নিয়ে কামরুদ্দীন বলেন, ‘৩০ মে ১৯৮১ সাল জেনারেল জিয়া নিহত হলেন ভোর সাড়ে চারটায় চিটাগাং সার্কিট হাউজে। কেউ কেউ জিয়ার মৃত্যুকে নিয়তির এক অপূর্ব পরিহাস মনে করেন। মেজর জিয়া ঐ চট্টগ্রামেই পাক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন ও দেশকে মুক্ত করার জন্য হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন ১৯৭১-এ। দেশবাসীকে আহ্বান জানিয়েছিলেন দেশের মুক্তির সংগ্রামে শরিক হতে। ঠিক এক দশক পরে সেই চট্টগ্রাম শহরে তিনি নিহত হলেন। নিয়তির পরিহাস বৈকি। এ দুটো মৃত্যুর (মুজিব ও জিয়া) মধ্যে এই সাদৃশ্যের উপস্থাপনের উদ্দেশ্য নেতৃত্বের বা ব্যক্তিত্বের তুলনা নয় বরং স্পষ্টভাবে এটা তুলে ধরা যে, এ দুটো হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা একই অদৃশ্য শক্তির প্রস্তুত।’

জিয়া হত্যাকাণ্ডের পর বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরিয়ে সেনাপ্রধান এইচ এম এরশাদ ক্ষমতা দখন করে নেন। প্রায় সাত বছরের শাসন আমলে এরশাদ দুর্নীতি ও নানা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি বিরোধী দলকে দমন করার পথ বেছে নেন। এরশাদের বিরুদ্ধে শুরু হয় ছাত্র-আন্দোলন। একপর্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলো তিন জোট গঠন করে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু করে। নূর হোসেন, সেলিম, দেলোয়ার, জেহাদ, ডা. মিলনসহ অসংখ্যা ছাত্র-যুবক-রাজনৈতিক কর্মীর রক্তের বিনিময়ে ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মুখে ১৯৯০ সালের ৫ ডিসেম্বর এরশাদের পতন ঘটে। এরশাদ বিচারের মুখোমুখি হন এবং জেল খাটেন।

১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী দল জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি থেকে বাংলাদেশ সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে যায়। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। বিএনপির এই মেয়াদে কোনো কোনো মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। মাগুরা উপনির্বাচন রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়ায়, যা ইস্যু করে আওয়ামী লীগ লাগাতার কর্মসূচি দিতে থাকে। একপর্যায়ে দেশে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ওই নির্বাচন বর্জন করে। ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছিল না। পরবর্তীকালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ওই সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস হয়। নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে এবং শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নিরঙ্কুশ বিজয় (নির্বাচনে এককভাবে ১৯৩ আসনে বিজয়ী হয়) অর্জন করে পুনরায় সরকার গঠন করে। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে বিএনপি সরকারের বিচারপতির বয়স বাড়ানোর উদ্যোগকে আওয়ামী লীগ সন্দেহের চোখে দেখে। তারা আবার হরতালসহ লাগাতার কর্মসূচি শুরু করে। দেশে অচলাবস্থার সৃষ্টি হলে সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে এবং দুই নেত্রীকে কারাগারে পাঠায়। রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্গঠন করা হয়। এ সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে ২৩০ আসনে বিজয়ী হয়ে ১৯৯৬-এর পর পুনরায় সরকার গঠন করে। শেখ হাসিনা আবারও প্রধানমন্ত্রী হন। ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও গবেষক আলী রীয়াজ তার ‘ইতিহাসের দোলাচল’ বইয়ে (২০২৩ সালের জুলাইয়ের প্রকাশিত) এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সংশোধিত সংবিধানের আওতায় নির্বাচন ব্যবস্থা এমনরূপ লাভ করেছে, যেখানে অস্বচ্ছ নির্বাচনের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের রক্ষাকবচ নেই, নির্বাচন ক্ষমতাসীন দলের ইচ্ছার অধীন হয়ে পড়েছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন তার প্রমাণ। আধা কর্তৃত্ববাদী শাসন ক্রমান্বয়ে একচেটিয়া আধিপত্যশীল কর্তৃত্ববাদে রূপান্তরিত হয়েছে। সবার অংশগ্রহণে তুলনামূলক সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিয়েছে যে ব্যবস্থা—তত্ত্বাবধায়ক সরকার—তার অবসান ঘটানো হয়েছে।’ অধ্যাপক রেহমান সোবহান সুস্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো দেশে কার্যকর নির্বাচন ব্যবস্থা তৈরি করা যায়নি। সংসদও অকার্যকর, যেখানে কারও জবাবদিহিতার ব্যাপার নেই।’

শেখ হাসিনা ২০০৯ থেকে ২০২৪-এর আগস্ট পর্যন্ত তার এ মেয়াদে হত্যা, গুম, বিরোধী দলকে দমন, লাগামহীন দুর্নীতি, পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনী ও প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে এক ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করেন। নির্বাচনী ব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশন, পুলিশ ও প্রশাসনযন্ত্রসহ রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান কার্যকারিতা হারিয়েছে। বিএনপিসহ বিরোধী দলের দীর্ঘ আন্দোলন এবং পরবর্তীকালে রক্তে ভেজা ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন ঘটে এবং তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। হেলিকপ্টারে করে তার ভারতে আশ্রয় নেওয়ার ছবি রাজনৈতিক দলগুলোকে ইতিহাসের মুখোমুখি করবে, এমনটা ভাবা বেঠিক কিছু হবে না।

বহুল উচ্চারিত সেই বাণী ‘ইতিহাসের শিক্ষা হচ্ছে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না’—এবার কি শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ গ্রহণ করা হবে? গত ৫৪ বছর বাংলাদেশের রাজনীতি যেমন গণতন্ত্র এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি, তেমনি রাজনীতিতে কোনো দর্শন সৃষ্টি করা যায়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে হোক অথবা যে কোনো উপায়ে হোক, ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতা ভোগ করা, সম্পদ গড়া—এটাই যেন রাজনৈতিক দলগুলোর লক্ষ্য। ইতিহাসের দায়মুক্তির যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, সে সুযোগ রাজনৈতিক দলগুলো গ্রহণ করে কি না, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version