দুখু

নুর এমডি চৌধুরী

0

জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ থানাধীন গাবেরগাউ এলাকার মুটেমজুর পরিবারের একমাত্র সন্তান আজগর আলী। চাড়ির পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা গরুটার দিকে তাকিয়ে বড়ই মায়া হয়। আজগর আলী বুঝে চাড়িতে নিশ্চয়ই পানি নাই তাই বউকে ডাকে, বউ বউ আরে ও দুখুর মা কই গ্যালা চাড়িতে পানি দেও একটু।

দুখুর সৎ মা পরি বানু তখন শর্তা দিয়ে সুপারি কাটছিল। সুপারি শর্তা হাতে নিয়ে অমারম ঘরের পেছনের দরজা দিয়ে উঠানে আসে, কি কইলা শুনি? আমারে কার মা কইয়া ডাক দিলা। এই তোরে আমি কতবার সাবধান কইরা দিছি ঐ পোড়া কপালের মা কইয়্য আমারে ডাকবি না।

ক্যান তাও বারবার ওইড্যা কইয়্যাই ডাকস। বেশরম, বেওয়ারিশ কোথাকার। আমার নামড্যা ধইরা ডাকতে কি তোর সরম হয়। এতো সরমই যদি হয় তয় বিয়ে করছিলি ক্যান বুইড়া বেটা। আমার এতো সুন্দর একটা ফুটফুটে মাইয়া দিছে আল্লাহয় কই একবার ভুলেওতো তারে কোলে নেসনা। তার দিকে ফিরে চাসনা। আছসতো শুধু দুখু দুখু দুখু ঐ দুক্ষু-ডারে নিয়ে। তাইতো কই দুঃখ আমারে ছাড়েনা ক্যান!

আজগর আলীর প্রথম বউ বিলকিস বেওয়া ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রাক্কালে সন্তান প্রসব কালে মৃত্যু বরণ করে। মায়ের ইচ্ছা ছিল সন্তান ছেলে হলে নাম রাখবে বিজয়। তাই বিলকিস বেওয়ার রেখে যাওয়া নামটাই রাখে বাবা আজগর আলী। সন্তানের নাম মা মরা সন্তান দাদীর কাছে বড় হতে থাকে। দাদী লালনপালন কালে বিজয়ের নাম দেয় দুখু। দুখুর বয়স যখন চার বছর তখন দাদীও মারা যায়। দুঃখ কষ্টে লালনপালনের দায়িত্ব নেয় তার জেঠিমা।

নিয়তির নির্মম পরিহাস দুখুর বয়স যখন চার বছর রোড় এক্সিডেন্টে দুখুর জেঠিমাও মারা যান। এখন আর ছোট্ট শিশু দুখুকে লালনপালন করার মত কেউ রইলোনা। তখন আসগর আলী অনিচ্ছা সত্ত্বেও দ্বিতীয় বিয়ে করে বউ পরি বানুকে ঘরে তুলে আনে।

ঘরে আসতে না আসতেই সৎমা পরি বানুর শুরু করে দুখুর প্রতি নির্মম অত্যাচার। অভাগা দুখুর বয়স চার বছর থেমে আট বছরে পা দিয়েছে। সৎমা পরি বানু সাথে বেড়ে উঠা দুখুর চার বছর জীবনে যে কি পরিমাণ মাইরের স্বীকার হয়েছে তার হিসেব মেলা ভার।

উঠতে মাইর বসতে মাইর চলতে মাইর ফিরতে মাইর মাইরের যেন শেষ নেই। কাঁদতে কাঁদতে দুখু যখন অচেতন হয়ে পড়তো তার উপরও পায়ে লাত্থিগুড়ি দুই চারটে দিয়ে হলেও বেটি ক্ষান্ত হইতো।

এদিকে অচেতন দুখুর প্রতি প্রভুর যখন দয়া হইতো দুখু উঠে দাঁড়াইতো। এক পা দুই পা করে ফের মা পরি বানুর কাছে যাইতো। এত নত-শির এত চাতক চোখে চাওয়া এতো আর্তনাদ করুণ হৃদয়ের আকুতি দেখলে একজন পাষন্ডেরও মায়া হত পরি বানুর হয়না। আল্লাহ পৃথিবীর সব সৎমা গুলোর অন্তর যে কি দিয়ে তৈরী করেছেন তা কেবল তিনিই জানেন।

বোবা দুখু ফেল ফেল করে তাকিয়ে থাকতো ভাতের পাতিলের দিকে, মা পরিবানুর দিকে কারণ তার কাছে কান্নার চেয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণা ছিল ঢের বেশি। সাহস হতোনা বলবে মা’গো ক্ষিধে পেয়েছে খাবার দাও।

দুখুর মুখে মা বলে ডাকাটাও ছি রীতিমত মৃত্যু দণ্ডপ্রাপ্ত ফেরারি আসামীর মত। ভুলেও যদি মা বলে একবার ডাক দিয়েছেতো মরেছে। শাস্তির পর শাস্তি এতো শাস্তি তবু যে রাক্ষুসির মনে না। গরম খুন্তির ছেক, চোখে মুখে মরিচের পানির ছিটা, আর খুন্তির বারিতো আছেই। এতোশত যন্ত্রণা নিয়েও দুখু দু’মুঠো ভাততের আশায় সব সহ্য করে।

আজগর আলী জানে দুখুকে পরি বানু মাঝেমধ্যে দুই একটা চড়-থাপ্পড় দেয় কিন্তু এতটা যে নির্মম প্রহার করে তা কস্মিনকালেও জানতোনা আসগর আলী।

আগে যখন পুরনো বাড়িটাতে ছিল তখন বাড়ির প্রতিবেশীরা দুখুকে প্রায়ই সান্ত্বনা দিয়ে যেতো এখন যখন চরের মধ্যে বাড়ি করেছে সেখানে মানুষতো আসা দুরের কথা কাক পক্ষীর দেখা মেলা ভার।

দিন যেতে লগলো। অকৎস্যাত একদিন পরি বানুর প্রহার কালে আসগর আলী দেখে ফেললো। তীব্র প্রহার দেখে ক্ষুব্দ হয়ে আসগর আলী বউকে বেধম পেটালো। বেশদিন তাদের মধ্যে কোন কথা হলোনা।

সেবার আম কাঠালের মৌসুমে দাওয়াত দিতে আলো পরি বানু মা মালেকা বানু। মালেকা বানু খুবই রাগী মানুষ। কুটনীতিতেও সেরা।মালেকা বানু মেয়ে পরি বানুর ঘরে পা রাখতেই বুঝে গেলো মেয়েটার কিছু একটা হয়েছে। মনে মনে রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলো। মাকে কাছে পেয়ে পরি বানুও যা বলার সত্য-মিথ্যা বানিয়ে মালেকা বানুকে আরও ক্ষেপিয়ে তুললো। কুটনীতিতে সেরা মালেকা বানু মেয়ে পরি বানুকে নিয়ে এমন কুবুদ্ধি আটলো যা শুনলে একজন পাষান্ডের মনও কেঁপে উঠতো।

আসগর আলী বাড়ি এলে শাশুড়ী মালেকা বানু মহব্বত সুরে কথা বলে। শাশুড়ীর কাছে কষ্টের কথা ব্যক্ত করলে শাশুড়ী পূর্ব পরিকল্পনা মতে মেয়ে পরি বানুকে দুচারটে গালমন্দ করে। শেষে শাশুড়ী আসগর আলীকে বলে, শোন বাবা তোমাদের সংসারে এতো অশান্তি তোমাদের অশান্তি মানেতো আমাদেরও অশান্তি।

আমি তোমাদের দাওয়াত দিতে এসেছি। কয়েকদিনে কামকাজ গুছিয়ে পরি বানুকে নিয়ে চলে এসো। আর আমি দুখুকে সাথে করে নিয়ে যাচ্ছি।

মা মরা ছেলেটা আহারে! শরীরের কি আহারে শরীরের কি বেহাল দশা হয়েছে। আমি নিয়ে গিয়ে ওকে কয়েকদিনেই গান্ডর করে তুলবো তুমি কোন চিন্তা করোনা বাপু। দুখুর বাবা আসগর আলী সরল মনে খুশি হয় রাজি হয়। দুখু যেতে না চাইলেও আসগর আলী জোর করে পাঠায়ে দেয়।

ভয়ংকর পরিকল্পনা। দুখুর দুঃখ যেন মরনের ডাক এনেছে এবার। যমুনা নদীর পাড়েই মালেকা বানুর বাড়ি। অনেক বছর আগের কথা। এক ডাকাতের সরদ্দার হাতে ধৃত হয়ে সেই ডাকাতের সাথেই মালেকা বানুর বিয়ে হয়েছিল। সেই সংসারেই জন্মেছে পরিবানু। দীর্ঘ বছর ডাকাতদের সাথে থাকতে থাকতে মালেকা বানুর সরল মনটাও কঠিন হয়ে উঠেছে। এখন সে নিজের সুখের জন্য মেয়ের সুখের জন্য যত বড় কঠিন কাজ করতে কঠিন মনে হয়না। খুন গুম এসব যেন মালেকা বানুর নেশা হয়ে উঠেছে। তাই মেয়ে আয়শা বানুর সংসারে সুখ দেখার জন্য সীদ্ধান্ত নেয় দুখুকে লোক চক্ষুর আড়াল করে ফেলবে।

যমুর তীর। তীরে দাঁড়াতেই চোখে পড়ে ধু ধু দূরে যমুনার গর্ভে বিস্তর বালুর চর। সন্ধ্যে হওয়ার সাথে সাথে ডাকাত দলের ক’জনকে নৌকা রেডি করতে বলে মালেকা বানু। তারপর দুখুকে তারা নৌকায় উঠায়।

দলবল মিলে দুখুকে ফেলে আসে ঐ ধুধু বালুচরে। পৃথিবীটা যেন উলোটপালোট হতে থাকে। নিস্পাপ বালক দুখু কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছে। সকাল হলে ঘুম ভাংগে দুখুর। ফের বাবা বাবা বলে চীৎকার করতে থাকে। রীতিমতো ক্ষুধার্তও ও তৃস্নার্ত দুখু।

গুনারীতলা গ্রাম। গ্রামের উত্তর পাড়ার ওয়াজেদ আলী নামের এক ফেরিওয়ালা ছিল। মাসে একবার বগুড়ায় যেতো। একসাথে অনেক খেলনা সামগ্রী ফিতা, চুড়ি, আলতা পাইকারি দরে কিয়ে নিয়ে আসতো বগুড়া থেকে আর সারা মাস ভরে তা বিক্রি করতো।

সেবার মাস না ফুরাতেই ওয়াজেদ আলীর খেলনা সামগ্রী শেষ হয়ে গেছে। তাই বগুড়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছে ওয়াজেদ খুব ভোর বেলায়।

যমুনার ঘাট থেকে প্রায় পাঁচ কিলো পথ পায়ে হেটে আসতে হয়। একসময় ওয়াজেদ আলী যমুনার তীরেই বসবাস করতো সে সময়েই তার একটা ডিংগি নৌকা ছিল। নৌকাটি এখনো আছে।

যথারীতি দুই ঘন্টার পথ পায়ে হেটে এসে ডুবিয়ে রাখা নৌকাটা উঠায়ে পানি সেচে সব ঠিকঠাক করে ওয়াজেদ আলী সারিয়াকান্দি ঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

যমুনা তখন শান্ত। উথাল পাথাল ঢেউ ছিলোনা। তবু ছোট ডিঙি নৌকা আর মাঝি বলতে ওয়াজেদ আলী একা। তাই সাবধানতার জন্য একেবারেই ওপাড়ের চরের কিনার ঘেষে নৌকা বেয়ে চলছে ওয়াজেদ আলী। হঠাৎ দেখতে পায় একটা শিশু নদীর কিনারায় বসে হাওমাও করে কাঁদছে। ওয়াজেদ আলী দ্রুততার সাথে কাছে যায়। ছেলেটাকে নৌকায় উঠায়। অনেক কিছু জানতে চায় ছেলেটার কাছ থেকে কিন্তু ছেলেটা যেন নির্বাক।

ছেলেটাকে সাথে থাকা পানির জগ থেকে পানি ঢেলে খাওয়ায়, সাথে থাকে কিছু ভাত ছিল তাও খাওয়ায়। শরীরটা গামছা ভিজিয়ে মুছিয়ে দেয়। অল্পক্ষণের মধ্যেই দুখু নৌকাতেই ঘুমিয়ে যায়।

ওয়াজেদ আলী দুখুকে সংগে নিয়ে বাড়িতে আসে। যমুনার তীরে কুড়িয়ে পাওয়া ছেটিকে দেখতে পাড়ার লোক সকল জমায়েত হতে থাকে।

খবরটি পরবর্তীতে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এর কানে পৌঁছিলে চেয়ারম্যান ওয়াজেদ আলীকে তলব করে। সবকিছু জেনে চেয়ারম্যান ছেলেটিকে নিজের কাছেই রেখে দেয় এবং সন্তান আদরে মানুষ করতে থাকে।

চেয়ারম্যান এতোটাই দরদ করে যে নিজ সন্তানের চেয়েও দুখুর প্রতি তার মায়া থাকে বেশি। পড়া লেখার জন্য চেয়ারম্যান ঢাকায় তার বড় বোনের বাসায় পাঠিয়ে দেয় দুখুকে। দুখু রীতিমতো পড়া লেখায় মনোযোগী হয়।

একসময় পড়ালেখা শেষ করে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসার পদে চাকুরী নেয় দুখু। ট্রেনিং শেষে ছূটি আসে চেয়ারম্যান এর বাড়িতে।
চেয়ারম্যানকে তার জীবনের ঘটে যাওয়া সব কিছু খুলে বলে। বলতে বলতে কান্নায় ভেংগে পড়ে দুখু।

বাবার স্মৃতি স্মরণে বাবাকে দেখার জন্য ব্যকুলতা প্রকাশ করলে চেয়ারম্যান তাকে খুজে বের করার কথা দেয়। খুজতে খুজতে একদিন দুখুর বাবার পরিচয় মিলে কিন্তু ততক্ষণে দুখুর বাবা আসগর আলী ইহধাম ত্যাগ করেছে।

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version