বৃহস্পতিবার, জানুয়ারি ৯, ২০২৫

সফলতা

সাহিত্য আইড়ি || ডেস্ক রিপোর্ট

আমার বিয়ের ৩ বছর আগে আমার বাবা মারা যান। বাবা যখন মারা যান তখন আমি ক্লাস 9 এ পড়ি। বাবা মারা যাওয়ার পরই আমার ২ ভাই সম্পত্তির ভাগ বন্টন করে নিল। বাবার ব্যাংকে জমানো যে টাকা গুলো ছিল। তার নমিনি দিয়েছিলো বড় ভাইকে। বড় ভাইয়া আর মেজ ভাইয়া মিলে সেগুলো ভাগাভাগি করে নিল। আমার আর মায়ের জন্য রাখলো মাঠান জমি ৩ কাঠা। আর এই বাড়িটা। যদিও এই বাড়ির ভবিষ্যৎ মালিকও আমার ২ ভাই।

আম্মা এই ৩ বছর ধরে ওই জমির ধান বিক্রি করে আমার পড়াশুনার খরচ সহ, সংসারের যাবতীয় খরচ চালাচ্ছিল। আমার বিয়ে হয়েছে আজ ২২ দিন। আজ সকালেই খবর পেলাম মা মা*রা গিয়েছেন। আমি শেষ বারের মতো মা’কে যখন দেখতে গেলাম৷ ওই বাড়িতে গিয়ে দেখি। আমার দুই ভাবি এ বাড়িতে এসে সমস্ত আলমারি, ওয়ারড্রব খোঁজা খুঁজি শুরু করে দিয়েছে। এত খোঁজা খুঁজির বস্তুটি আমার মায়ের পুরোনো গহনা গুলো। যেগুলো মা আমাকে বিয়েতে দিয়েছেন। যদিও বউভাতের পরের দিন আমার শ্বাশুড়ী সেগুলো লকারে তুলে দিয়েছেন।

বাড়ি ভর্তি লোকজনের মাঝেও আমার ভাইয়া ভাবীর এমন কাজ কর্ম দেখেও আমি অবাক হচ্ছি না। এগুলো দেখতে দেখতে এখন আমি অভ্যস্ত। আমার বিয়ের পরে দুই ভাই ভাগাভাগি করে রেখেছিলেন এক এক মাস করে মা তাদের কাছে থাকবে। এই ২২ দিন মা বড় ভাইয়ের কাছেই ছিল। এজন্য বড় ভাবি মায়ের জিনিসের প্রতি অধিক অধিকার দেখাচ্ছে।

আমি মায়ের পাশে চুপ করে বসে আছি। আশ্চর্য বিষয় হলো আমার চোখে ১ ফোটা পানি নেই। আমি কাঁদার চেষ্টা করেও কাঁদতে পারছিনা। কারণ আমার মন বলছে ঠিক হয়েছে। মা মরে গিয়ে শান্তি পেয়েছেন। দুনিয়ায় জ্বালা যন্ত্রণা থেকে তিনি মুক্তি পেয়েছেন। এই জগৎ সংসারে তার আর কোনো পিছুটান রইলো না।
মায়ের দাফন হলো বাদ আসরের সময়। আর মাগরিবের নামাজ পড়েই আমি রওনা দিলাম শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে। সেখানেও আমার জন্য অনেক কিছু অপেক্ষা করছে।
মা নেই আজ ৫ মাস হয়ে গেল। আমি ২ মাসের অন্তসত্বা। আমিও মা হবো ভাবতেই ভালো লাগার সাথে কিছু খারাপ লাগাও ভীড় করে। আর এই খারাপ লাগার ভিতরে অন্যতম হলো আমার ভাইদের স্মৃতি। আমার শ্বাশুড়ী ৩ বেলা ছেলে ছেলে করলেও আমি মেয়ের মা হতে চাই। আমি চাইনা আমি মারা যাওয়ার সময় আমার ছেলেরা দাফন কাজ ফেলে রেখে সম্পত্তির ভাগ বটোয়ারা করুক।

আমার স্বামী এনাজের ভাব গতি ও পাল্টে গিয়েছে। ও প্রায়ই আমার কাছে এসে গল্প করে তার বন্ধুরা শ্বশুর বাড়ি থেকে কি কি পেয়েছে, শ্বশুর বাড়িতে তাদের কত যত্ন হয়। তাদের থেকেও ভালোও চাকরী করেও সে সে সবের তুলনায় কিছুই পাইনি। মাঝে মাঝে তো বলেই বসে
“এই এতিমের বাচ্চাটাকে বিয়ে করায় আমার জীবনের বড় ভুল। এই ফকিন্নিটাকে ঘাড় থেকেও নামাতে পারিনা।”
প্রতিবেশী নিলু আন্টি এসে যখন তার সুনিপুণা বৌমার গল্প করেন তখন আমার শ্বাশুড়ির মুখ লজ্জায় লাল হয়ে যায়। কারণ তিনি কারোও সামনে বড় বড় লেকচার দিতে পারেন না। মাঝে মাঝে তিনিও পাড়া প্রতিবেশী আন্টিদের কাছে বলেই বসেন।

“বুঝেছেন ভাবী আমরা তো জিনিসের লোভে বউ এনেছি আখিরাতের জন্য। কারণ এতিমের মাথায় হাত বুলালেও আল্লাহ খুশী হন।”

আফসোস লাগে আমার মায়ের ৭ ভরি গহণা তাদের কাছে সামান্য। আমি কিছু বলিনা কেবল মুচকি হাসি। কারণ আমার যাওয়ার কোনো যায়গা নেই। যে ভাইয়েরা ইদের সময় বোনকে দাওয়াত কর‍তে ভুলে যান তাদের কাছে গেলে যে ঠাই পাবোনা তা তো বোঝায় যায়।
এত কিছুর মাঝেও আমি ২ যমজ কন্যা সন্তানের জন্ম দিলাম। কিন্তু একজন জীবিত থাকলেও আরেক জনকে বাঁচানো যায় নি। বাচ্চা ডেলিভারির দিন।আমার স্বামী, শ্বাশুড়ি টাকার অভাবে আমাকে হাসপাতালে নিতে পারেন নি। তারা লক্ষ টাকা খরচ করে আসবাব কিনতে পারেন।কিন্তু ছেলের বউকে হাসপাতালে নিতে পারেন না।
৪১ দিনের দিন আমি সুস্থ হয়ে ঘর ছাড়লাম। ঘর ছাড়লাম মানে পালিয়ে এলাম। রাতের অন্ধকারে শ্বাশুড়ির লকার থেকে আমার মায়ের ৭ ভরি গহনা নিয়েই আমি পালিয়ে গেলাম। কারণ আমি এবার বাঁচার মতো করে বাঁচতে চাই।

দীর্ঘ ৫ বছর পর,আমার মেয়ে অনিমা আজ ৫ম বছরে পা দিয়েছে। আমি আমার মায়ের নামটায় আমার মেয়েকে দিলাম। আজ আমার এম.এ ফাইনাল ইয়ারের রেজাল্ট দিলো। আমি ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট হয়েছি।
সব থেকে বড় কথা আমি বাংলাদেশের একজন সফল উদ্দোক্তা হিসাবে “সাহসী নারী” এওয়ার্ড পেতে যাচ্ছি। মায়ের সকল গহনা সেদিন বন্দক রেখে আমি ব্যাবসা শুরু করেছিলাম। আজ আমার নিজের ২ টা শো রুম আছে। আজ আমি সফল।

আমার সফলতার খবর শুনে আমার সাথে আমার ভাইয়েরা, ও স্বামী,শ্বাশুড়ি যোগাযোগ করেছিল। কিন্তু দূর্দিনে যারা পাশে থাকেনি সুদিনেও আমি তাদের চাইনা।
আজ আমি একা বাঁচতে শিখেছি। মেয়েকেও শেখাবো কিভাবে একা বাঁচতে পারে।

- Advertisement -spot_img
আরও সংবাদ
- Advertisement -spot_img
এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here