একটি সেতুর জন্য দীর্ঘদিন ধরে দপ্তরে দপ্তরে ধরনা দিয়েছে নরসিংদী সদরের আলোকবালী ইউনিয়নের মানুষ। কাজ হয়নি। শেষ পর্যন্ত সবার উদ্যোগে নির্মিত হয়েছে ৩৫০ ফুট দৈর্ঘ্যের কাঠের সেতু। এটি সাত গ্রামের ৪০ হাজার মানুষের যাতায়াত সহজ করেছে।
নরসিংদী সদরের আলোকবালী ইউনিয়নের সাতটি গ্রামে ৪০ হাজার মানুষের বাস। উপজেলা থেকে ইউনিয়নকে সম্পূর্ণ আলাদা করে রেখেছে মেঘনা নদী। ইউনিয়নের গ্রামগুলোর ভেতরে বয়ে গেছে মেঘনার শাখা নদী। এর মধ্যে এক পারে আলোকবালী গ্রাম, অন্য পারে কাজিরকান্দি।
ওই নদীতে একটি সেতুর স্বপ্ন দেখছিল ইউনিয়নবাসী। নদীর এক পাশে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যসেবা কমপ্লেক্স, বড় বাজার ও চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অন্য পাশে আলিম মাদরাসা। শিক্ষার্থীসহ গ্রামবাসীকে খেয়া দিয়ে এক পার থেকে অন্য পারে যেতে হতো।
লোক বেশি হলে খেয়ায় ধরত না। অপেক্ষা করতে হতো। শিক্ষার্থীদেরও যথাসময়ে বিদ্যালয়ে পৌঁছতে সমস্যা হতো। আর রোগীদের দুর্ভোগের কথা তো বলাই বাহুল্য।
অন্যদিকে রাত ৯টার পর পাওয়া যেত না খেয়া। কখনোসখনো দুর্ঘটনাও ঘটত।
দীর্ঘদিন ধরে দপ্তরে দপ্তরে সেতুর জন্য ধরনা দিয়ে আসছিল এলাকাবাসী। রাজনীতিবিদরা ভোট চাইতে এলেই প্রথমে সেতুর কথা বলতেন। তাই এলাকাবাসী আশায় বুক বেঁধেছিল।
সেতু হচ্ছে—দুইবার এমনটা শুনেছিলও তারা। একবার চাউর হয়েছিল, বাজেট পাস হয়েছে। এইতো কাজ ধরা হবে। হাসি ফুটেছিল মুখে মুখে। অবশ্য সেই হাসি মিলিয়ে যেতে বেশি সময় লাগেনি। কিন্তু এবার আর অন্যের মুখাপেক্ষী নয়, এলাকাবাসী নিজেদের প্রচেষ্টায় নির্মাণ করেছে ৩৫০ ফুট কাঠের সেতু। সেতুটি দেখতে এখন দূর-দূরান্তের মানুষ সেখানে ভিড় জমাচ্ছে।
যেভাবে শুরু
এবার ঈদুল ফিতরের পরদিন আলোকবালী ইউনিয়ন সমাজকল্যাণ যুবসংঘের সিনিয়র কয়েকজন সভায় বসেন। তাঁরা এখানে সেতু করতে চাইলেন। তাঁদের একজন সংগঠনটির সহসভাপতি আবু মুহাম্মাদ সাদ্দাম। তিনি বললেন, ‘আসুন, সবাই মিলে কাজ করি। আপনারা তহবিল গঠন করুন। বাকি টাকা আমি দেব।’ সদস্যরা সাহস পেলেন। সদস্যরা মাওলানা রবিউলদের ধরলেন। তাঁরা খুশিমনে জমি দিতে রাজি হলেন। প্রকৌশলীর কাছে জানতে পারলেন, স্টিল দিয়ে সেতু বানাতে ৫০ লাখের মতো খরচ পড়বে। লোহা দিয়ে বানালে লাগবে কোটি টাকা। পরে তাঁরা ঠিক করলেন, গজারি কাঠ দিয়েই বানাবেন। সেতু বাস্তবায়নের জন্য সহসভাপতি সাদ্দামকে আহ্বায়ক করে কমিটি করলেন। পরে ইউনিয়নবাসীকে নিয়ে সভা ডাকলেন। প্রচুর লোক হলো সভায়। সবাই রাজি হলো। সেদিন সাদ্দাম দিলেন এক লাখ টাকা। বৈঠকে উপস্থিত এলাকাবাসীর কাছ থেকে পেলেন ৫০ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে কাজ শুরু করেন। বাকিতে নিয়ে আসেন গজারিগাছ।
সদস্য ও সাধারণ ছাত্ররা টাকা তুলতে বাড়ি বাড়ি গেলেন। প্রবাসীদের বললেন। প্রায় সবাই স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দিলেন। নারীরা ডিম-হাঁস-মুরগি বেচা ৫০ থেকে ১০০ টাকা দিলেন। অবশ্য তরুণদের এই উদ্যোগ নিয়ে কেউ কেউ হাসাহাসিও করল। মশকরা করে বলল, ‘সরকার করতে পারে নাই, চেয়ারম্যান পারে নাই, পোলাপাইন নাকি ব্রিজ করব।’ কিন্তু তরুণরা হাল ছাড়েনি।
২১ লাখ টাকায়
যেদিন সেতুর কাজ শুরু হলো, চারদিকে রব উঠল। দল বেঁধে এলো নারী-পুরুষ, তরুণ-তরুণী, ছাত্র-ছাত্রী ও কিশোর-কিশোরী। প্রতিদিনই লোকজন ভিড় করল। কেউ কেউ মিস্ত্রিদের কোমল পানীয় দিল। কেউ দিল বিস্কুট, মুড়ি-চানাচুর। কেউ বাড়ি থেকে পিঠা বানিয়ে নিয়ে এলো।
৩৫০ ফুটের সেতুটি ৭ ফুট প্রশস্ত। গজারিগাছের ১০০ পিলারের ওপর সেতুটি দাঁড়িয়ে আছে। পাইলিং করে পিলারগুলো বসানো হয়েছে। একটি পিলার থেকে আরেকটি পিলারে নাইজেরি কাঠ দিয়ে টানা দেওয়া হয়েছে। কাঠ দিয়ে পাটাতন এবং দুই পাশে রেলিং দেওয়া হয়েছে। সেতুর মাঝখানে যেখানে পানি বেশি, সেখানে ৩০ ফুট জায়গায় ব্যবহার করা হয়েছে স্টিল। প্রতিদিনই সেতু দিয়ে প্রায় ছয় হাজার মানুষ পার হয়। সেতুটি বানাতে সময় লেগেছে দুই মাস দুই দিন। পাইলিং করতে গাজীপুর থেকে ১৬ জন মিস্ত্রি আনা হয়েছে। এলাকার শ্রমিকরাও কাজ করেছেন। শেষ পর্যন্ত সব মিলিয়ে খরচ হলো ২১ লাখ টাকা। সেতুটি সাত গ্রামের ৪০ হাজার মানুষের যাতায়াত সহজ করেছে। ভরা বর্ষায়ও সেতুর নিচ দিয়ে নৌকা-স্টিমার যাতায়াত করতে পারে।
স্বপ্ন সত্যি হলো
সম্প্রতি খুলে দেওয়া হলো গ্রামবাসীর বহুল আকাঙ্ক্ষিত সেতু। মানুষ সেতুতে হাঁটে আর যুবকদের নিয়ে গর্ব করে। স্বপ্নপূরণের কথা বলে। লোকেরা বলল, ‘আমাদের ইউনিয়নের এত মানুষ একসঙ্গে এর আগে কোথাও দেখা যায়নি।’ বৃদ্ধ আসলাম শেখ সেতুতে হেঁটে এপার-ওপার ঘুরলেন। বললেন, ‘ছোটকাল থেকে স্বপ্ন দেখতাছি, এহানে ব্রিজ অনব। কতজন কত কথা হুনাইল আমরারে। কাজ অইল না। আমার নাতি-নাতকররা এবার বেডার কাম করছে।’
আব্দুল মান্নান চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মনিরুল বলল, ‘নৌকায় করে স্কুলে আসতে হতো। ঝড়ের দিন স্কুল কামাই যেত। সেতু হওয়ায় আমাদের সুবিধা হয়েছে।’
সেতুর জন্য ৮ শতক জায়গা দিয়েছিলেন মাওলানা রবিউলদের পরিবার। রবিউল বললেন, ‘৩৫ বছর ধরে মানুষ আমাদের জমির ওপর দিয়ে ঘাট করে নৌকায় পারাপার হচ্ছে। এবার সেতুর কথা শুনে খুশিমনে জমি দিলাম। মানুষের উপকারের চেয়ে ভালো কাজ আর কী আছে?’
আহ্বায়ক আবু মুহাম্মাদ সাদ্দাম বলেন, ‘এই কাজে অংশ নিতে পেরে গর্ব বোধ করছি। আমরা চাই, সরকার এখানে স্থায়ী ব্রিজ করুক।’