শনিবার, জানুয়ারি ৪, ২০২৫
Homeজাতীয়মনে পড়ে তোমাকে,জামালপুরের নক্ষত্র, বিশিষ্ট সাংবাদিক, কলামিস্ট, লেখক আমানুল্লাহ কবীর ভাই

মনে পড়ে তোমাকে,জামালপুরের নক্ষত্র, বিশিষ্ট সাংবাদিক, কলামিস্ট, লেখক আমানুল্লাহ কবীর ভাই

নুর এমডি চৌধুরী, কবি ও সাহিত্যিক

নব্বই দশকের কথা। বিশেষ কাজে উনার সাথে দেখা করার উদ্যেশ্যে ঢাকায় আসি। তিনি তখন ঢাকা মিরপুর কল্যাণপুরে শশুরের লিখে দেওয়া জায়গাটির উপর দারুসসালাম রোড়ে তিনতলা বাড়ির নির্মান করছিলেন। আর তা দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়েছিলো আমাদের সম্পর্কে কাকা আবার বন্ধুও আলেপ উদ্দিন ফারাজী।

জনাব আমানুল্লাহ কবীর সাহেব মেলান্দহ থানাধীন কুলকুচা গ্রামের রেখির পাড়ায় জন্মগ্রহণ করলেও তার পৈত্রিক পুরুষের বাস ছিল আমাদের গুনারীতলা গ্রামের উত্তর পাড়ায়। মরহুম কামাল মাতাব্বরের বংশধর তিনি।

জনাব আমানুল্লাহ কবীর সাহেবের বাল্যবন্ধু ছিলেন গুনারীতলা গ্রামের আশির দশকের ভাইস চেয়ারম্যান প্রয়াত সোহরাব মাহমুদ। অকস্মাৎ সোহরাব মাহমুদের মৃত্যু হলে তার রেখে যাওয়া অল্পবয়সী এক মেয়ে নাম কনিকা আরেক ছেলে নাম রেজাউল ওস্ত্রীকে রেখে যান। মরহুম সোহরাব মাহমুদের স্ত্রী দুই সন্তানকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে সোহরাব মাহমুদের স্ত্রী নিজ পছন্দে অন্যত্র বিয়ে করে কন্যা সন্তানটিকে সাথে নিয়ে চলে যান।

তখন ছেলেটির দেখাশোনার দায়িত্ব নেন তার চাচা সুলতান মাহমুদ। কিন্তু বিধির বাম সুলতান মাহমুদ ছেলেটাকে স্কুলে না পাঠিয়ে জমি চাষে নিয়োজিত করে এবং ছেলেটাকে প্রতিনিয়ত প্রহার করে।

বন্ধু আলেপ উদ্দিন ফারাজীর সাথে ছেলেটার কথা শেয়ার। বললাম, তুমি আমানুল্লাহ কবীর ভাইকে সব খুলে বলো এবনহ যত দ্রুত পারো ওকে একটা পত্রিকার অফিসে যদিও যথেষ্ট অপ্রাপ্ত বয়স্ক সে তবু্ও তার জন্য একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। যেহেতু কবির সাব ভাইস চেয়ারম্যান সাবের বন্ধু ও গোত্রীয়।

যথারীতি একদিন কবীর সাহেবকে আলেপ উদ্দিন ফারাজী সব খুলে বলল। বিস্মিত বিস্ময়ে কবির সাহেব সেদিন বন্ধু বিয়োগে চোখের জল ফেলেছিলেন এবং বলেছিলেনযত দ্রুত পারো ছেটাকে আমার অফিসে নিয়ে আসো।

আলেপ উদ্দিন বিস্তারিত আমাকে শেয়ার করলে আমি গোপনে ছেলেটাকে বলে রাখলাম। বললাম, রেজাউল শোন, তোকেতো তোর চাচা অনেক মারধর করে তাই আলেপ তোর একটা চাকরির ব্যবস্থা করছে। তোর বাবার বাল্য বন্ধু তিনি। কয়েকদিনের মধ্যে আলেপ বাডি আসবে তুই কাপড় চোপড় গুছায়ে রাখিস তোরে ঢাকা সাথে করে নিয়ে যাবে।

সেও তাৎক্ষণিকভাবে রাজি হয়েছিল। যথারীতি আলেপ বাড়ি এলো এবং যাওয়ার পথে রেজাউলকে সাথে নিলো সাথে নিলো আমাকেও।

রেখির পাড়া গ্রামে বেড়ে উঠা আমানুল্লাহ কবীর সাহেব ছিলেন ন্যায় নীতির উর্ধে উঠা ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন একজন মানব হিতৈষী মানুষ। তিনি কখনওই নীতি বিসর্জন দিয়ে কাজ করেননি। সেদিন দেখা দেখা হয়েছিল কল্যাণপুরে বিকেল বেলায়। ফেলে আসা অনেক স্মৃতির গল্প তিমি বলেছিলেন।

তিনি ছিলেন বাংলাদেশের একজন সাংবাদিক ও লেখক। সাংবাদিকতার জীবদ্দশায় তিনি ছিলেন তার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। জনাব আমানুল্লাহ কবীর সরকারি সংবাদ সংস্থা (বাসস) এর একজন পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব দৈনিক পত্রিকায় নেতৃত্বস্থানীয় পর্যায়ে থেকে পাঁচ দশক ধরে সাংবাদিক হিসেবেযথেষ্ট সম্মানের সহিত কাজ করে গেছেন।

১৯৭১ সালে রনাঙ্গণের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে পূর্ব পাকিস্তান পরবর্তী বাংলাদেশে তিনি সাংবাদিকদের রুটি-রুজি আন্দোলনের পুরাধা হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

আমানুল্লাহ কবির ২৪ জানুয়ারি ১৯৪৭ সালে জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার রেখিরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ও ফুলকোচা ইউনিয়নের প্রাক্তন ইউপি চেয়ারম্যান বছির উদ্দিন মাস্টারের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬২ সালে আমানুল্লাহ কবির হাজরাবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিকুলেশন পাশ ও রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন।

আমানুল্লাহ কবীর ১৯৬৯ সালে দৈনিক পয়গাম পত্রিকা দিয়ে সাংবাদিকতা শুরু করেন। ১৯৭১ সালে ইংরেজি সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত হন। দ্য পিপল-এ কাজ করার সময় শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হামলা চালিয়ে পত্রিকার অফিসটিকে গুড়িয়ে দিলে অল্পের জন্যে তিনি প্রাণে বেঁচে যান।। পরে তিনি ঢাকা নগরী ছেড়ে জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার রেখিরপাড় গ্রামে তার জন্মস্থানে ফিরে যান। সেখান থেকে সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি।

স্বাধীনতার সূর্য উদিত হওয়ার পর ‘দ্য পিপল’ পত্রিকাটি পুনরায় আত্মপ্রকাশ করলে তিনি ফের পত্রিকায় যোগ দিয়ে স্বাধীন বাংলায় সাংবাদিকতা শুরু করেন। এরপর’ দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টে’ পত্রিকায় নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘ সময়। ২০০১ সালের অক্টোবরে তিনি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন। ২০০৪ সাল থেকে ‘দৈনিক আমার দেশ’ পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন করেন তিনি।

সাংবাদিকতা পেশার শত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি কবিতা, গল্প ও বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখে গেছেন। পরবর্তী সময়ে সমসাময়িক ঘটনার ওপর বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় লেখার ওপরই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন তিনি।

মৃজনাব আমানুল্লাহ কবীর মৃত্যুর আগের ৫ বছর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জ্যেষ্ঠ সম্পাদক ছিলেন। বাংলাদেশের এক সময়কার জনপ্রিয় ইংরেজি দৈনিক নিউ নেশনের বার্তা সম্পাদক ছিলেন তিনি। কাজ করেছেন টেলিগ্রাফ পত্রিকায়।

জনাব আমানুল্লাহ ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের দুই বার মহাসচিব হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ঢাকাস্থ জামালপুর সমিতি এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহ সাংস্কৃতিক ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন তিন। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি ছিলেন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সক্রিয় ও একনিষ্ঠ কর্মী। সেই থেকে সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি ছিল তার গভীর অনুরাগ। জনাব আমানুল্লাহ সংবাদপত্র সম্পাদনার পাশাপাশি ১০টি বই লিখে গেছেন তিনি।

জামালপুরে জন্ম নেওয়া এই গুণী মানুষটি জনাব আমানুল্লাহ কবির ডায়াবেটিস ও লিভারের নানা জটিলতায় ভুগে ভুগে ১৬ জানুয়ারি ২০১৯ সালে ঢাকা ইবনে সীনা হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে গুণী মানুষটির বয়স হয়েছিল ৭২ বছর।

- Advertisement -spot_img
আরও সংবাদ
- Advertisement -spot_img
এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here