মানুষ বোধ হয় সবচেয়ে বেশি উদাসীন নিজের বার্ধক্য নিয়ে। খুব কম মানুষই নিজের বার্ধক্য কি ভাবে সামলাবেন তার প্রস্তুতি নিতে পারেন। বার্ধক্য নিয়ে কথা উঠলে কেউ কেউ বলেন, আমি তো আমি তো প্রবীণ নই অথবা আমি নিজেকে প্রবীণ বলে মনে করি না।তুলনামূলক ভাবে এগিয়ে থাকা একদল মানুষ প্রতিনিয়ত যৌবনের বন্দনা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। চলন বলনে,পোশাক পরিচ্ছদে, আচার আচরণে নিজেকে তরুণ হিসেবে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে আত্মতুষ্টি লাভ করেন। তিরাশি বছর বয়সী অতি প্রবীণ খ্যাতিমান ব্যক্তিকে মোসাহেবের দল বলে উঠে, স্যারকে তো আটত্রিশ বছর বয়সী তরুণের মতো লাগছে। তখন খ্যাতিমান অতি প্রবীণ ব্যক্তি মুচকি হেসে এসব কথার অনুমোদন দেন।বার্ধক্য যে একটি সম্মান মর্যাদা প্রতীক এটি আমরা ভাবতে পছন্দ করি না। মানব জীবনের বয়সের প্রতিটি ধাপে সম্মান মর্যাদা এবং আনন্দ লাভ করার সুযোগ রয়েছে।
দুঃখ কষ্ট, ব্যাথা বেদনা, অসম্মান অপমান এই গৌরবকে ম্লান করে দিতে পারে না।জীবনের প্রতিটি পর্বের প্রস্তুতি থাকে। শিশু জন্ম লাভের পরপরই মায়ের দুধ খেয়ে জীবন ধারণ করে। মায়ের কোলে,পরিবারের আশ্রয়ে, সামাজিক সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে শিশুরা বড় হতে থাকে। শিশুর খাবার দাবার, সেবা যত্ন, খেলাধুলা, লেখা পড়া, বিনোদন সহ প্রতিটি বিষয়ে পরিবারের সদস্যরা সজাগ থাকে। যৌবনে পদার্পণ করে সেই শিশু পরিবার, সমাজ রাস্ট্রের দায়িত্ব পালন করে। চোখের পলকে যৌবন চলে যায় আসে বার্ধক্য। সেই বার্ধক্য নিয়ে আমাদের সচেতনতা,উপলব্ধি, বিবেচনা, প্রস্তুতি প্রায় শুন্যের কোঠায়।একদল মানুষ নিয়তির উপর ভরসা করে বার্ধক্যে উপনীত হন।
আরেক দল মানুষ টাকা পয়সা, জমি জমা, সহায় সম্পদ, ছেলে মেয়েকে বিবেচনায় রেখে বার্ধক্য মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। কিছু সংখ্যক মানুষ পেনশনের আওতায় থাকেন। সরকারি হাসপাতালে দেশের মানুষের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পাবার সুযোগ রয়েছে।
চাহিদার তুলনায় প্রাপ্ত সেবা অপ্রতুল। বর্তমানে দেশে দুই কোটি প্রবীণের বসবাস। ভবিষ্যতে এই সংখ্যা আরো বাড়বে।
দুই কোটি মানুষের বার্ধক্য শান্তি পূর্ণ এবং স্বস্তিদায়ক করতে প্রস্তুতি নিতে হবে ব্যক্তিগত,সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ভাবে। বার্ধক্য প্রধানত ব্যক্তির নিজস্ব বিষয় ফলে বার্ধক্য মোকাবিলায় ব্যক্তির ভূমিকাই প্রধান। বার্ধক্য মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিতে হবে জন্মের পরপরই। শিশুকালে বেশি বেশি অসুস্থ হলে, চিকিৎসা সেবা ঠিকমতো না পেলে,পুষ্টিহীনতায় ভোগলে,প্রয়োজনের তুলনায় অধিক পুষ্টি গ্রহণ করলে , শারীরিক নানা জটিলতা নিয়ে যৌবনে পদার্পণ খুবই ঝুঁকি পূর্ণ। যৌবনে শরীর মনের সঠিক ভাবে যত্ন না নিলে বার্ধক্য হবে খুবই দুঃখ জনক। কষ্টের বার্ধক্য ব্যক্তির নিজের বহন করা বেদনাদায়ক। সামাজিক নানান পরিবর্তনের ফলে যৌথ পরিবার প্রথা বিলুপ্তির পথে।
গড়ে উঠা একক পরিবার আজ বিভিন্ন রকমের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে প্রায় নাজেহাল হবার উপক্রম হয়েছে। উচ্চ শিক্ষিত যোগ্যতা সম্পন্ন একক পরিবারের সদস্যদের কর্মক্ষেত্র প্রায়শঃই আলাদা হয়ে থাকে। দাম্পত্য জীবন সংকটে রেখে লাখ লাখ মানুষ জীবন টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
রেমিট্যান্স যোদ্ধারা বিদেশে কঠোর পরিশ্রম করে দেশে অবস্থান কারী পরিবার পরিজনের জন্য টাকা পাঠিয়ে দেন। স্বল্প আয়ের শ্রমজীবী মানুষের বড় একটি অংশ পরিবারের সদস্যদের গ্রামের বাড়িতে রেখে নিজেরা কর্মক্ষেত্রে আছেন।
সমাজের এই নতুন পরিস্থিতি মেনে চলতে, মানিয়ে নিতে আমরা কমবেশি সবাই হিমশিম খাচ্ছি। দিন যত যাচ্ছে মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই ততবেশি তীব্র হচ্ছে। একক পরিবারের নানান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে গিয়ে তালাক, সেপারেশন, আলাদা বসবাস জীবনকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। তরুণ তরুণীদের বিয়ে না করার এবং সন্তান না নেবার প্রবনতা বাড়ছে।দায়ী দায়িত্বহীন সম্পর্কের বাজার রমরমা অবস্থায় রয়েছে। এসব কারণে ভবিষ্যতে জনসংখ্যা কমতে থাকবে। শিশু জন্মের হার নেতিবাচক হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পৃথিবীর উন্নত দেশ গুলোতে নিজের কাজ নিজেকেই করতে হয়।বাড়ি ঘর,উঠোন, বাগান, জামা কাপড় পরিস্কার, ঝাড়া মোছা,রান্না বান্না, গাড়ি চালানো, মালপত্র উঠা নামা প্রায় সব কাজই ব্যক্তিকে করতে হয়।বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ভবিষ্যতে ব্যক্তির দায় আরো বাড়বে বলে মনে হচ্ছে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি এবং জীবন যাপনের মান বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। দীর্ঘ জীবন লাভ করা এসব মানুষের সামাজিক, আর্থিক, আবেগিক চাহিদা পূরণ বড় ধরনের একটি চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে গিয়ে জাতীয় বাজেটের বড় অংশ ব্যয়
করতে হবে। এখনই প্রতি বৎসর সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়ছে। বার্ধক্যের এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে বৃদ্ধাশ্রম, প্রবীণ নিবাস,বয়স্ক পূর্ণবাসন কেন্দ্র যথেষ্ট নয়। তদুপরি আমাদের দেশের ধর্মীয় সামাজিক মূল্যবোধ বৃদ্ধাশ্রম ও প্রবীন নিবাস কে উৎসাহিত করে না বরং নেতিবাচক ধারণা দেয়।আমাদের দেশের প্রবীণরা জীবনের শেষ দিন গুলো ছেলে মেয়ে, আত্মীয় স্বজন,বন্ধু বান্ধব, পরিচিত পরিবেশে থাকতে চায়।এই ইচ্ছা পূরণ করতে হলে প্রবীণ কে দাতার ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ পৃথিবী গ্রহীতাকে করুণা, দয়া,কৃপা অনুগ্রহ নিয়ে বাঁচতে শেখায় বিনিময়ে মর্যাদা, সম্মান, ইজ্জত হরণ করে নেয়।সম্মান মর্যাদা, ইজ্জত শুধু দাতারা পাবেন।প্রবীণরা নিজেকে দাতার ভূমিকায় আনতে না পারলে সম্মান মর্যাদা পাবেন না।যখনই প্রবীণ সাহায্য প্রার্থী হবেন তখনই প্রবীণ করুণার পাত্র হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করবেন। বার্ধক্য সামলানোর জন্য ব্যক্তিকে সুস্থ সবল এবং আর্থিক ভাবে সামর্থ্য বান হতে হবে। এসব অর্জনে যৌবনই হলো মোক্ষম সময়। যৌবনের আয়ের একটি অংশ সঞ্চয় করতে হবে, কমপক্ষে দশ শতাংশ। শরীরকে সুস্থ রাখতে পরিমিত আহার, বিশ্রাম, ব্যায়াম এবং দুশ্চিন্তা মুক্ত হতে হবে। ছেলে মেয়ে নাতি নাতনি দের ভবিষ্যত বিনির্মানে অধিক পরিমাণে দায়িত্ব পালন করতে থাকলে প্রবীণের বর্তমান ঝুঁকি পূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। বার্ধক্যকে স্বস্তি দায়ক ও শান্তি পূর্ণ করতে নিজেকে সুস্থ সবল রাখা ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই।
প্রবীণ যৌবনে সমাজের, রাস্ট্রের কল্যাণে ভূমিকা পালন করেছে অতএব সমাজ ও রাস্ট্রের দায়িত্ব প্রবীণকে লালন পালনে ভূমিকা রাখা। আমাদের কিছু সংখ্যক মানুষ রয়েছেন যাঁরা প্রবীণের সকল সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব রাস্ট্রের উপর ছেড়ে দিতে চান।প্রবীণের সকল সেবা বিনামূল্য বা সাশ্রয়ী মূল্যে পাবার দাবি জানান। তাঁরা ভুলে যান যে রাস্ট্রটি কে এখন পর্যন্ত আমরা ন্যায় ভিত্তিক কল্যাণ কামী রাস্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারিনি।
বার্ধক্য মোকাবিলায় ব্যক্তিকে প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে। একই সাথে বার্ধক্যের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে নানা রকমের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে অগ্রণ ভূমিকা পালন করতে হবে। বার্ধক্যের চ্যালেঞ্জ গুলো সমাজ রাস্ট্র কে চরম ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়।ঝুঁকির বড় অংশটি আমাদের তরুণ দের বহন করতে হচ্ছে। কম লোকবল নিয়োগ করে এবং কম খরচে উন্নত মানের সেবা পাবার সুযোগ প্রবীণদের জন্য জরুরি। তরুণ প্রজন্মের বড় একটি অংশ প্রবীণ সেবায় নিয়োজিত হলে উন্নয়নের বিভিন্ন খাত চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে পারে।
সর্বশেষ বার্ধক্য মোকাবিলায় ব্যক্তির ভূমিকা প্রধান এই বিষয় গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে।