কাশীনাথ রায়ের নাম আমি প্রথম শুনি আমার মেধাবী বন্ধু আজফার হোসেনের কাছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের এই শিক্ষককে ভীষণ শ্রদ্ধা করে আজফার; সে ছিল কাশীনাথ রায়ের সরাসরি ছাত্র। তখন থেকেই জানি তিনি পণ্ডিত মানুষ; আত্মপ্রচারহীন ও নিভৃতচারী। কবিতা লেখেন, কিন্তু প্রকাশ করেন না।
সেই সময়েই তাঁর লেখা ‘চারুবাবু ও কতিপয় বিভ্রান্ত স্থপতি’ কবিতাটির কথা শুনি, ওই আজফারের কাছেই, যে ছিল তার আদর্শবাদী শিক্ষকের আদর্শ ভাবশিষ্য, বিদ্ব্যজনে মুগ্ধ ভক্ত। আজীবন বিপ্লবী চেতনা ধারণকারী গুরুর প্রভাবটি শিষ্যে সক্রিয় দেখি। উৎপীড়নের বিপক্ষে আর নিপীড়িতের পক্ষে তাদের কলম আজীবন সচল দেখি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এমনি অনেক প্রাণে সত্য ও সাম্যের ধারণাটি সঞ্চারিত করেছেন শিক্ষক কাশীনাথ রায়।
কাশীনাথ রায় কবিতা লিখেছেন অল্প সংখ্যক, ছেপেছেন আরো অল্প, নিজের কবিতা গ্রন্থবদ্ধ করতে তিনি ভীষণ অনীহ। প্রকাশিত হতে একেবারেই অনিচ্ছুক, কী বলা যায় তাকে, সংসারে বসবাসরত যোগী মানুষটিকে? তার প্রথম কাব্য ‘জীবনানন্দ, দেখুন’ প্রকাশিত হয় ২০০৮ সালে, জীবনের মধ্যবয়স ততদিনে পেরিয়ে গেছেন তিনি। বইটি প্রকাশ করেছিল ‘ভাষাচিত্র’। কাশীনাথ রায়ের দ্বিতীয় কাব্য ‘আমি যাহা দিতে পারি’ প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। প্রকাশ করে তাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ কবি পুলক হাসান, ‘খেয়া প্রকাশনী’ থেকে। ওই নামের একটি সাহিত্য পত্রিকা দীর্ঘকাল ধরেই প্রকাশ করছেন পুলক হাসান, যাকে দেখেছি, নিভৃতচারী, মেধাবী কবিদের অন্তর্লোক থেকে বহির্লোকে আনতে সচেষ্ট, যেন এ এক মহান ব্রত তার । যৌবনের সবগুলো বসন্তকাল কাটিয়ে পড়ন্তবেলায় তিনি যে প্রকাশমুখী হলেন তাও, অনুমান করি, ভক্তদের আগ্রহে। নইলে মলাটবদ্ধ হতো না তাঁর কবিতা। আমি যাহা দিতে পারি কাব্যের ফ্ল্যাপে লেখা ‘খুব বেশি লেখেননি, যা লিখেছেন তাও সংকলিত করতে চাননি এতকাল। এই অনাগ্রহের কোন ব্যাখ্যা নেই।’ অথচ জন্মভূমি নাটোরে পাঠশালায় থাকতেই তার ছন্দোবদ্ধ লেখা ছাপা হয়েছিল। ‘বাংলা একাডেমি থেকে আবদুল গনি হাজারী সম্পাদিত ‘পরিক্রম’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল মধ্যষাটে ঢাকায় পা দিয়ে লেখা প্রথম কবিতা।’ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত ষাটের তরুণ কবিদের কণ্ঠস্বর প্রখ্যাত ‘কণ্ঠস্বর’ পত্রিকায় তিনি লিখেছেন। লিখেছেন ‘নিরন্তর, ‘একবিংশ, ‘খেয়া’- কতিপয় নির্বাচিত লিটল ম্যাগাজিনে।
কাশীনাথ রায় যে কতখানি আত্মপ্রচারবিমুখ তা বোঝা যায় প্রথম কাব্য ‘জীবনানন্দ, দেখুন’ এর ফ্ল্যাপে কবি পরিচয়ে লেখা তিনটি ‘না দিলেই নয়’ দরকারি তথ্য। এগুলো হলো জন্মস্থান (নাটোর), জন্মসাল (১৯৪৭), পেশা (শিক্ষকতা)। ঠিক দেশবিভাগের বছরটিতে জন্ম নেওয়াও কেমন কাকতালীয়! মনে হয় এই শিশু দেশবিভাগের ক্ষত বুকে ধারণ করেই বড় হয়েছেন। দ্বিতীয় কাব্য ‘আমি যাহা দিতে পারি’ তে কবিপরিচয় খানিকটা বর্ধিত হয়েছে, তাও বায়োডাটার মৌলিক কিছু তথ্যের চেয়ে বর্ধিত হয়নি। সেখানে লেখা “কাশীনাথ রায়ের জন্ম প্রাক্তন রাজশাহী, অধুনা নাটোরের যোগেন্দ্রনগর গ্রামে, ভারত-বিভাগের অল্প কিছুদিন পর। নিজ গ্রামের পাঠশালা থেকে প্রাথমিক পাঠ নিয়ে পাবনা শহরে পাড়ি দিয়েছিলেন। পাবনা জিলা স্কুল ও পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ইংরেজি সাহিত্য পড়তে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অধ্যয়ন শেষে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনার শুরু- আজ থেকে সাইত্রিশ বছর আগে। অদ্যাবধি সেখানেই আছেন।”গ্রামের নামে নগর থাকাটাও কাকতালীয়। নগরে ডালাপালা ছড়ানো মানুষটির শেকড় জন্মাবধি গ্রামেই প্রোথিত।
তিনি নিভৃতচারী কবি, তার শিষ্যগণ নিভৃতচারী নয়, প্রকাশ হওয়া মাত্র ‘আমি যাহা দিতে পারি’ কাব্যটি নিঃশেষিত হয়ে যায়। পরের বছরেই প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় সংস্করণ। এই দ্বিতীয় সংস্করণে প্রকাশক পুলক হাসান আমাদের জানাচ্ছেন প্রথম সংস্করণটি আদৌ কবির মনোমত হয়নি, তিনি চেয়েছিলেন কবিতাগুলোকে কালানুক্রমে সাজাতে, তা হয়নি, প্রচ্ছদকে মনে হয়েছে বড়ো বেশি সংগতিহীন, কবিপরিচিতিকে মনে হয়েছে খানিকটা অশোভন। এই ‘খানিকটা অশোভন’ আর কিছুই নয়, ‘প্রচার’, যা তিনি চান না।
কাশীনাথ রায়ের কবিতার মূল সুরটি ধরতে হলে ‘আমি যাহা দিতে পারি’ কাব্যের ফ্ল্যাপে লিখিত কথামালাকে উদ্ধৃত করা যায়। সেখানে লেখা “অন্ধ (?) হোমার তাঁর অমর মহাকাব্যগাথা সুর করে গাইতেন। আর মুগ্ধ হয়ে শুনত তাঁর নিরক্ষর শ্রোতারা। মহাকবির মহাকাব্যিক সৌন্দর্যগুলোর কোনোটাই তাদের উপভোগ-উপলব্ধির বাইরে থাকত না। কবিতা দুর্বোধ্য আওয়াজ তোলে না। কবিতা কথা বলে- ছোটো, বড়ো অর্থবান কথা এবং সে-কথা সরাসরি পৌঁছ যায় শ্রোতার কানে। আর কথার মতো কথা হলে সরাসরি মর্মে। কবিতার এই ধারাতেই বিশ্বাস করেন কাশীনাথ রায়- আধুনিক-উত্তরাধুনিকের যাবতীয় প্রলোভন সত্ত্বেও। সংকলিত কবিতাগুলো তাঁর এই বিশ্বাসকে প্রতিফলিত করেছে।”
২.
উপরের ওই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে কাশীনাথ রায়ের কাব্যভুবনটিকে সহজে বোঝা যায়। গভীর কথা সহজভাবে বলতে চান তিনি। কবিগুরুর সেই কথাটি ‘সহজ কথা যায় না বলা সহজে’ মনে রেখে এও মনে পড়ে “Our greatest truths are also the simplest”। একথা তো সত্যি যে পাঠকের হৃদয়ে কবি টিকে থাকেন কোন কোন পঙক্তির দ্যুতিতে। কবির বিপুল সাহিত্যসম্ভার থেকে যায় গবেষকের কবজায় আর সাহিত্যের ভা-ারে ও ইতিহাসে; পাঠক আউড়ে ফেরে একটি দুটি চরণ।
ওই গভীর কথা সহজ করে বলার সঙ্গে যদি আমরা কাশীনাথ রায়ের বিপ্লবী সত্তাকে একত্রিত করি, তবে তার কাব্যভুবনটি পরিপূর্ণ হয়। তিনি বিপ্লবী মতাদর্শে বিশ্বাসী সে বিশ্বাস ছড়িয়ে আছে তার কবিতায়, কাব্যনাটকে, অন্যান্য গদ্যরচনায়, আলাপনে, এমনকি শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে। মেহনতি মানুষের জন্য একটি শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন আজীবন বুকে লালন করেছেন, কখনোই তা থেকে তিনি সরে আসেন নি। এক্ষেত্রে তার সতীর্থ হলেন ওই ইংরেজি বিভাগেরই প্রখ্যাত ও সিনিয়র শিক্ষক এমিরেতাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। আছেন আরো অনেকেই, এমনকি লালদুর্গের পতনের পরেও, তারা লক্ষ্যে অচঞ্চল, মতাদর্শে সুস্থিত!
আমি শুরু করি তার সুবিখ্যাত কবিতা ‘চারুবাবু ও কতিপয় বিভ্রান্ত স্থপতি’ দিয়েই। চারু মজুমদারের নেতৃত্বে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়িতে যে সশস্ত্র বিপ্লবী সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, যাকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি আখ্যা দিয়েছিল ‘বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ’বলে, যা দাবানলের মতোই ছড়িয়ে পড়েছিল ভারতের অন্যান্য রাজ্য ও অঞ্চলে, সেই আন্দোলন তার সকল মহিমা ও গুরুত্ব সত্ত্বেও ছিল হঠকারী। শ্রেণিশত্রু খতমের রাজনীতি ছিল বিভ্রান্তিকর। দলে দলে মেধাবী যুবকেরা নাম লিখিয়েছিল চারু মজুমদারের নকশালবাড়ি আন্দোলনে। এই বিপ্লবী যুবারা ছিল আত্মোৎসর্গীত, কিন্তু বিভ্রান্ত। কবি কাশীনাথ রায় তাদের স্থপতি বলেছেন, কেননা, তারা চেয়েছিল একটি নতুন সমাজ স্থাপন করতে।
এখন এই স্বতোঃসারিত ধারার মতো ছলোৎচ্ছল পঙক্তিমালার সমুখে দাঁড়িয়ে আমি উপলব্ধি করছি কেন আমার মেধাবী বন্ধু আজফার হোসেন এই কবিতার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। ভাবি, সেই প্রেম কি তার এখনো অটুট নয়? মনে হয়, এটিই কবি কাশীনাথ রায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা। কবিতাটি শুরু
হয়েছে এভাবে,
“একদিন তমসার কানে
মুখ নামিয়ে বললাম : রাত্রি
তুমি, নিশিথিনী
….
শাপের সংসার-করা জটিল প্রান্তরে
তমসা হলো না রাত, অন্ধকার হলো না তমসা!”
এ কবিতায় রয়েছে বিভ্রান্ত যুবকদের ঘর ছেড়ে শরনার্থী হওয়া, পূর্ব প্রান্তরের (নকশালবাড়ি কলকাতা থেকে পূবে) দিকে অব্যাহত যাত্রার গল্প। চতুর্থ স্তবকে কবি লেখেন,
“আমরা শরনার্থী। আমাদের
সমস্ত দাহের আগে ছিল ঘর। ঝড়ের নির্দেশ
কাতর শস্যের কানে পৌঁছে দিতে দিতে
হাজার ভয়ার্ত খেয়া, হাজার চিৎকার ঠেলে
একদিন আমরা সবাই
হারিয়েছি স্ব-গৃহের পথ।”
উদ্ধৃত পঙক্তিনিচয়ে যে চিত্রকল্পটি গাঁথা, “ঝড়ের নির্দেশ কাতর শস্যের কানে পৌঁছে দিতে দিতে হাজার ভয়ার্ত খেয়া, হাজার চিৎকার ঠেলে” এককথায় অনবদ্য। এই স্থপতিগণ, চারু বাবুর ঘনিষ্ঠ কমরেডগণ, ‘নীলকান্ত মণি নামে ডেকে ডেকে, ভুলে গেছে নিজেদের নাম;’ তারা বিশ্বাস করেছিল, “পূর্বাচল ঘুরে শ্রীমতি উষার সংবর্ধনা নেবে।”সেখানে “বিশ্বাসের বৃন্ত নেই,/ রাত্রি নেই, বিপুল সন্ত্রাস/আকণ্ঠ পেঁচিয়ে … যেখানে ঘুমের কথা শঙ্কাকুল, পাছে/ সূর্যোদয় ফিরে যায়, অথচ যেখানে/প্রতীক্ষায় সরে না পাথর।”
এই বিভ্রান্ত স্থপতিগণ ‘বামে শস্যক্ষেত্র দগ্ধ হতে দেখেছেন’, দেখেছেন নির্বাক শিশুর কঙ্কাল নিয়ে তৃতীয় ভুবন কড়ি খেলছে, মৃত্যু-অপমৃত্যুর খবরে ভারী হয়ে উঠেছে বাতাস, প্রান্তর বিনষ্ট, বিশ্বাস নেই, নেই পিতৃতুল্য সহিষ্ণুতা, মহাপুরুষের আবির্ভাব ঘটেনি, সান্তনার মতো কোন বস্ত্র নেই। এই স্থপতিগণ ঘরহীন উদ্বাস্তু, তাদের বস্ত্র ছিন্ন, তাদের পথ বিপথের ভয়ে কণ্টকিত, তারা কেউ নক্ষত্র সংকেত ঠাহর করেনি, তাদের পায়ে দীর্ঘযাত্রার ক্লান্তি। এই মহাকাব্যিক প্যাটার্নের কবিতাটিতে পূর্বদিকে (অর্থাৎ সূর্যোদয়, অর্থাৎ বিপ্লব) এক যাত্রার বিবরণ আছে, আছে এক প্রতীক্ষার কথা, যে যাত্রা ও প্রতীক্ষা ফুরোয় না। কবিতাটির শেষ স্তবকটি তুলে ধরলেই এটা স্পষ্ট হবে।
“ক্রমাগত পূর্বদিকে হেঁটে
আমরা যাত্রার মানচিত্র ভুলে গেছি!
হে বিনষ্ট প্রান্তর, তোমার
সান্তনার মতো কোন বস্ত্র নেই? তোমাকে কখনো
সহযাত্রী ভেবে ভুল করা যাবে নাকি? আমাদের
পবিত্র বিশ্বাস বুকে নেই
পিতৃতুল্য সহিষ্ণুতা নেই
অন্ধকারে কার কথা ভেবে
জেগে থাকবে আমাদের চোখ?”
চারু বাবু ও নকশালবাড়ি আন্দোলন পরাস্ত হয়েছে, ঘরহীন স্থপতিদের ঘরে ফেরা হয়নি। তাদের জেগে থাকা চোখগুলো মৃত।গোপন সশস্ত্র বাম যুদ্ধের সেই আলোড়ন তোলা ইতিহাসটিকে যুক্তিবাদী দৃষ্টিতে নিরিখ করেছেন কবি কশীনাথ রায়। গদ্য ছন্দে লেখা কবিতাটি, আমার জানা মতে, নকশালবাড়ি নিয়ে লেখা কবিতাসমূহের মাঝে অন্যতম সেরা রচনা।
৩.
সুদীর্ঘ জীবনে খুব বেশি কবিতা লেখেননি কবি কাশীনাথ রায়। কোন কোন বছর তিনি কোন কবিতাই লেখেননি, বা লিখেছেন একটি বা দুটি; অন্ততঃ মুদ্রিত কবিতার ইতিহাস তাই বলে। কিন্তু ২০০৬ সালে এসে তিনি রচনা করলেন অনেকগুলো কবিতা। তাঁর প্রথম কাব্য ‘জীবনানন্দ, দেখুন’-এ চৌত্রিশটি কবিতার মধ্যে পঁচিশটি ওই এক বছর লেখা। সে বিচারে ২০০৬ সালকে তাঁর কাব্যস্ফূর্তির বছর বলা যায়। এমনি আরেক কাব্যস্ফূর্তির বছর হলো ১৯৭১। মহান মুক্তিযুদ্ধের বছরটিতে লেখা কবিতার পাঁচটিকে মলাটবদ্ধ দেখি ‘আমি যাহা দিতে পারি’ গ্রন্থে। এখানে একটি আশ্চর্য উলটপালট ঘটেছে, আগে লেখা কবিতা পরের গ্রন্থে, পরে লেখা কবিতা আগের গ্রন্থে মুদ্রিত। এ থেকে বোঝা যায় কবিতা প্রকাশে তিনি সুশৃঙ্খল নন। ১৯৬৫ সালে লেখা প্রথম কবিতাটি থেকে শুরু করে গত শতকে রচিত কবিতাগুলো মলাটবদ্ধ হয়েছে দ্বিতীয় কাব্যে, যা প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। আর প্রথম কাব্যের সকল কবিতাই নতুন শতকে লেখা, যার ভেতরে রয়েছে সেই , কাশীনাথ রায়ের পদ্যরচনার নিরিখে, বহুলপ্রজ বছর ২০০৬।
আমরা ফিরে যাই তার সেই কবিতায় যে কবিতাটি মধ্যষাটে ছাপা হয়েছিল আবদুল গনি হাজারী সম্পাদিত ‘পরিক্রমা’ পত্রিকায়। কবিতাটির নাম ‘হয়তো পাখিই ওটা’। এ কবিতায় রয়েছে প্রেমাষ্পদের জন্য অপেক্ষা, যে প্রেমাষ্পদের সঙ্গে কবির দেখা হচ্ছে তিরিশ বছর পরে। এখানে স্মতর্ব্য, ১৯৬৫ সালে কবির বয়স তিরিশ হয়নি। তাহলে এই তিরিশ বছরের না-দেখা বিরহকাল কী অর্থবোধক? আর ওই পাখি হলো ঘড়ির এলার্মের পাখি, যে কবিকে জাগিয়ে দেয় অপেক্ষা অবসানের ‘রাত-চাপা ভোর’। এখানে অপেক্ষা আছে, আছে অধোগামী বয়সের বিলাপ (‘পুরনো খেয়ার মতো হায়রে বয়স); রয়েছে নিজের প্রতি করুণা (‘আমি আজ অন্ধকারে অভ্যস্ত মানুষ’)। কাশীনাথ রায় আধুনিক-উত্তরাধুনিক সকল প্রলোভন এড়াতে চেয়েছেন, কিন্তু তাঁর এই প্রথম সিরিয়াস কোন পত্রিকায় প্রকাশিত কবিতাটি প্রবলরূপে আধুনিক। বলা যায় এক বহুমাত্রিক কোলাজ এটি। এখানে ছুরতজানের স্বামীর যুদ্ধে যাওয়ার গল্প আছে, কানুদার বাউল বাঁশরি আছে, আছে অতিবৃদ্ধ শিশিরবাবুর বাঁচার কষ্ট। আছে সমকালের ছবি। কবি লেখেন:
“আমাদের নিরীহ পাড়ায়
শুনেছি এখন আর মিলবে না ভীরু বেনারসি
সোমত্ত বুকের কাঁচা রং
লুকোনো প্রহর আর কানুদার বাউল বাঁশরি।
দুপুরের হোম জ্বেলে আসবে প্রখর সূর্য। ঘরোয়া
বিকেলে যারা আজও
অকেজো স্বপ্ন দেখে তারা পরকাল।”
সুতরাং এ কবিতা সর্বতোভাবে আধুনিক। এতে রয়েছে ‘চাপা চুড়ির আলাপে কেউ কাপড় ছাড়ছে কলঘরে’ র মতো পঙক্তি, বৃদ্ধ মোরগের স্বরে চমকে ওঠা হাওয়ার চিত্রকল্প।
৪.
গত শতাব্দী কেন বলি, গত সহস্রাব্দের শেষ বছরটিতে, যার ঠিক একশ বছর আগে একই বর্ষপঞ্জিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাংলা কবিতার দুই মহাপুরুষÑ কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও কবি জীবনানন্দ দাশ, সে বছরে দেশ বিভাগের বছরটিতে জন্ম নেওয়া কবি কাশীনাথ রায় চলে গিয়েছিলেন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তাঁর মনে হয়েছিল সেই বোধকরি শেষ যাত্রা, আর ফেরা হবে না কলহাস্যময় ভুবনে, অনন্ত তিমির থেকে ফেরা হবে না আলোকিত গ্রহটিতে। গভীর জীবন-সংশয়কালে তিনি লিখে ফেলেছিলেন আরো একটি অসামান্য কবিতা। ‘চারুবাবু ও কতিপয় বিভ্রান্ত স্থপতি’-র মতো এটিও গদ্যছন্দে লেখা এক স্বতোঃসারিত ঝর্ণাধারা, ঝর্ণাকলম থেকে উৎসারিত হয়ে যা ছড়িয়ে পড়েছে একটি জীবনের সারাংশ বয়ানে। এ কবিতাটিও দীর্ঘ।
‘আমি যাহা দিতে পারি’কাব্যের শেষ কবিতা ‘যেদিন পড়বে না মোর’। কবিগুরুর বিখ্যাত ও হৃদয়সংবেদী গানটির শেষ শব্দটি অনুক্ত থেকে গেলেও তা বুঝে নিতে কষ্ট হয় না কারও। কেবল পদচিহ্ন নয়, কোনো চিহ্নই আর পড়ে না ধরাত্রীর বুকে যখন কেউ চলে যায়। ‘যেতে আমি দিব না তোমায়/তবু যেতে দিতে হয়/তবু চলে যায়।’ ধরার নিয়মটি এই। কবি তা শুধু জানেনই না, এ বিষয়ে তার একটি নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গিও আছে। নিজের সম্পর্কে অতীব বিনয়ী, এক জীবনের অর্জন নিয়ে নিরহঙ্কারী, বিশ্বাসে সংশয়বাদী কবির এ কবিতাটিকে ‘কনফেশনাল পোয়েট্রি’ বলা যায়।
কবিতাটি শুরু হয়েছে চলে যাওয়ার অনিবার্যতা দিয়ে, রয়েছে নামহীন গোত্রহীনের মতো নির্মোহ প্রস্থান, রয়েছে এক অন্তর্লীন অভিমান। কবির প্রস্থান কাক-পক্ষী ছাড়া কেউ টের পাবে না, এমনকি ঘরের দেয়ালও হয়তো ভুলে যাবে সেখানে কাশীনাথ রায় নামে কেউ কখনো ছিলেন। ‘অত্যন্ত দক্ষিণী মহল্লা’ তার নিবাসের চমৎকার চিত্র! কবিতাটি শুরু হয় ধরাবাঁধা ছত্র দিয়ে,
“এই নামী গ্রহ ছেড়ে নিঃশব্দে একদিন
চলে যাব। কাক-পক্ষী ছাড়া
কেউ টের পাবে না।”
পৃথিবী নামক গ্রহটি নামী নিঃসন্দেহে; সেটাই তো একমাত্র গ্রহ যা আমরা ঘনিষ্ঠভাবে চিনি। আর সবই তো দূরের, অপরিচিত। এরপরেই তিনি লেখেন, “বেয়াড়া বাসনার লুব্ধ রেশ কারো বেদনাকে প্রদক্ষিণ/করে বলবে না : আমি আছি, থাকতে চাই।/ শোকে দগ্ধ বুকের দোহাই/ দেবে না আড়ষ্ট কোনো প্রেম।” অর্থাৎ ওই অন্তর্লীন বেদনা ও অভিমানের উপরিতলে তিনি জানেন ‘সত্যরে লও সহজে।’
দ্বিতীয় স্তবকে পাই কবির আত্মপরিচয়, যেখানে কোনো কৌলিন্য, কোনো অহঙ্কার, কোনো আত্মম্ভরিতা নেই। আছে অপার বিনয় এবং নিজের সঠিক পরিচয়টি। কবি বলেছেন তিনি কোন শিল্পী বা শিল্পপতি নন, নামকরা গুণীজন বা বিদগ্ধ প-িত নন (এ তার বিনয়; দেশের সেরা বিদ্যাপিঠটির তিনি একজন গুণী শিক্ষক, বিদগ্ধ পণ্ডিত)। তিনি লিখেন,
“প্রভুভক্তের গুঞ্জন
আমার নিবাস ঘিরে কখনো বাজে না বিপরীত।
কিংবা মুগ্ধ ভক্তের আরতি
আমার নামের পাশে উদ্বেল হয় না দিনরাত।
নক্ষত্রের শুভ দৃষ্টিপাত
কখন যে সরে যায় জানি না, সজ্জন!
আমার তো জ্ঞাননেত্র নেই!”
উপরোক্ত উদ্ধৃতির প্রথম বাক্যের সত্যতা আমরা জানি, দ্বিতীয় বাক্য বিনয়ে পরিপূর্ণ আর তৃতীয় বাক্য কবিতার শর্ত পূরণ করে। চতুর্থ বাক্যে ফের বিনয়াভারে নুয়ে পড়ে জ্ঞানফল। এই স্তবকের শেষাংশে তিনি বলেন,
“যেদিকে তাকাই সেদিকেই
ফণা তোলে বিষম ভ্রুকুটি! সনাতন
জীবনবৃক্ষের ফল ভালোবাসি নগন্য কাফের।”
শেষ লাইনটি যেন তার ভাবলোকের পরিচয়। নিজেকে বলেছেন ‘নগন্য কাফের।’ জীবনের শেষপ্রান্তে এসে অবিশ্বাসীও দুলে ওঠে বিশ্বাসে, অজ্ঞেয়বাদীর মতো সে ‘আছে/ নেই’-র মাঝে ঝুলতে থাকে। এখানে আশ্চর্য, এটা ‘চারুবাবু ও কতিপয় বিভ্রান্ত স্থপতি’ কবিতাতেও রয়েছে, কবি কাশীনাথ রায় ঈশ্বরকে সম্বোধন করেন ‘আল্লাহ্’বলে। সৃষ্টিকর্তাকে অনেক নামেই ডাকা যায়, অনেকটা গোলাপ ফুলের মতো, তবে একটি মুসলমান সংখ্যাগুরুর দেশে জন্ম ও বসবাসকারী কবির কাছে যিনি আগেই নিজেকে শনাক্ত করেছেন অবিশ্বাসী হিসেবে, বেছে নেন প্রভুর সেই নাম, যে নামে মুসলমানরা সৃষ্টিকর্তাকে ডাকে। হাশরের ময়দানের উল্লেখে আর দ্বিধা থাকে না তিনি কাকে বুঝিয়েছেন। এখন ঈশ্বরকে বিভক্ত করে নিয়েছে মানুষ, বলছে তার ঈশ্বরই সেরা। আল্লাহ্কে উদ্দেশ্য করে বলা তার উক্তি পরকালের ত্রানপ্রার্থী নয়, বরং কৃতজ্ঞতায় ভরপুর। কেননা, প্রকৃতি বলি বা বলি ঈশ্বর, কবিকে তিনি দিয়েছেন দৃষ্টি, নয়নাভিরাম জগৎকে দেখবার দুটি চোখ। সেই চোখ দিয়ে কবি দেখেছেন ‘উদ্ভিন্ন অশোক’, ‘ব্যাকুল রজনীগন্ধা’, ‘অবুঝ গোলাপ’, ‘মাটির সহিষ্ণুতা’, ‘কালো মেঘের গৌরব’, ‘প্রান্তরের শুদ্ধ অভিমান’। কবি লিখেন,
“দেখেছি বর্ষার বুকে আত্মার সমান
গহীন তৃষ্ণার মুখ। অপ্রেমের হাতে
কখনো লাঞ্চিত হলে ছুটে এসে বৃক্ষের ছায়ায়
দাঁড়িয়েছি প্রতিকূল অর্ধনগ্ন প্রাতে।”
‘বর্ষার বুকে আত্মার সমান গহীন তৃষ্ণার মুখ’ ভারি কাব্যময়। এরপরেই কবি তার জীবনের রীতিটি, তাকে অর্জন বলা যেতে পারে, বা পুলসিরাত পার হবার টিকেট, ব্যক্ত করেন,
“ঘরের বাতাস রুষ্ট হলে নতজানু হয়ে আমি
এই দেশে যত নদী আছে তার নাম
স্পর্শ করে হয়েছি শীতল। নামীদামি
রজনীর পাত্র নয়, তোমার একান্ত প্রিয় সৃষ্টার সুনাম
এখনও অক্ষুন্ন রেখে ফেরে যে বিশস্ত সূর্যোদয়
তাকে খুব কাছ থেকে দেখব বলে একা জেগে কাটিয়েছি রাত।”
সৃষ্টির ভেতরেই স্রষ্টাকে খোঁজেন কবিরা। স্রষ্টার চিহ্ন আঁকা থাকে তাঁর সৃষ্টির গায়ে। কবির স্বদেশে ‘প্রেম ছাড়া কোথাও দুর্নীতিমুক্ত কিছু নেই।’ব্যগ্র তরুণের বুকে ব্যগ্র তরুণীর ঘনিষ্ঠ বুককে তার চোখে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ দৃশ্য বলে মনে হয়েছে। কেন কে জানে? প্রেম ছাড়া কোথাও কিছু নেই দুর্নীতিমুক্ত- কবির এই উচ্চারণ এক ভয়ঙ্কর সমাজব্যবস্থার ছবি দেখায় আমাদের। কেউ হয়তো বলবেন প্রেমও দুর্নীতিমুক্ত নয়। এর বদলে হতে পারে মাতৃস্নেহ, একমাত্র মাতৃস্নেহই দুর্নীতিমুক্ত।
এর পরের স্তবকে পাই কবির নারীসঙ্গ, নারীপ্রেম পাবার আকাঙক্ষা ও আকুতি। কবির সরল স্বীকারোক্তি,
“… এমনকি তোমার বিচারে নিষ্কলুষ
নয় এই হৃদয়- সেখানে সহস্র নিষিদ্ধ ঢেউ
ওঠে, ভেঙে পড়ে, তপ্ত রূপের লালসা
ওত পেতে থাকে। একান্ত সহসা
ফুঁসে ওঠে অবৈধ প্রণয়। নারীসঙ্গের বাসনা
অহর্নিশি করে আনাগোনা।
মানবদেহের যত শ্যামলিমা, তরঙ্গের সঙ্গী যত রাত
এ হৃদয় করে আত্মসাৎ।”
এজন্যই বলেছিলাম এ কবিতা কনফেশনাল। এখানে কবিসত্তা প্রকটিত। আর কবি তো রক্তমাংসেরই মানুষ, নবীরা যেমন। তাদের নারীসঙ্গ লাগে। নিষিদ্ধ গন্ধম খেয়ে আদি পাপের যে সূচনা তা আছড়ে পড়েছে পৃথিবীতে। কেবল স্বর্গ হইতে বিতারণ নয়, স্বর্গে ফিরে যাবার পথখানি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে আদিম বাসনায়, দেহের প্রবৃত্তি ভুলে যায় সিদ্ধ-নিষিদ্ধের সীমারেখা, ফুঁসে ওঠে অবৈধ প্রণয়। শেষাংশটুকু “মানবদেহের যত শ্যামলিমা, তরঙ্গের সঙ্গী যত রাত/এ হৃদয় করে আত্মসাৎ।” অপূর্ব!
কবি জানেন তার সম্বল বলতে ওই প্রেম। এ ছাড়া ইহকাল-পরকালের আর কোন পুঁজি নেই। “পথভ্রষ্ট মনোলোভাকেই/কুড়িয়ে কুড়িয়ে একা পুড়েছে কপাল।” আমাদের মনে রাখতে হবে মরণের ভেলায় চড়ার প্রাক্কালে তার মধ্যে ওই নারীসঙ্গলাভের আকাঙ্ক্ষার স্বীকারোক্তি আদালতে দেওয়া সত্যভাষণের মতো প্রকাশিত হলো। আর কবিরা সত্যপ্রকাশে দ্বিধাহীন, হয়তো বা আবরণহীন, কিন্তু একথাও তো বলা যায়, প্রেম তাকে নামিয়ে রাখে পাশে আর জীবনমুখী ভেলায় চড়িয়ে দেয়।
কবিতাটি শেষ হয়েছে এক অভাবিত প্রেমের কথা বলে। এ প্রেম হলো বৃক্ষপ্রেম। জীবনদায়ী বৃক্ষকে ভালোবাসেন কবি। বৃক্ষ কেবল আমাদের ফুসফুস সবুজ অক্সিজেনে ভরে দেয় না, বৃক্ষ তৈরি করে সবুজ শর্করা, যা সকল প্রাণীর খাদ্যের মৌলিক উৎস। কবিতাটি শেষ হয়েছে আশ্চর্য পঙক্তিসমষ্টি নিয়ে।
“তবুও দিনান্তে আমি বৃক্ষে ধীরে রেখেছি ললাট।
জন্মাবধি অবনত এ আমার একমাত্র বিলাস।
জীবন্ত পাতাকে আমি অসম্মান করিনি কখনো।
আমার শিয়রে তাই জেগে থাকে এই অভিলাষ :
বৃক্ষ ভালোবেসে যদি করে থাকি ক্ষুদ্র পুণ্য কোনো-
এই অভিজাত গ্রহে বর্ণহীন চুকে গেলে পাট
নিষ্ফল আমার নামে নিদ্রিত ছায়ায়
যে-কোনো বৃক্ষের থেকে যে-কোনো একটি পাতা যেন ঝরে যায়।”
৫.
আমি ভাবি যিনি ১৯৬৫ তে ‘হয়তো পাখিই ওটা’’-র মতো কবিতা লেখেন তিনি কেন উচ্চস্বর, বিস্ফারিত হলেন না? ১৯৭৩ সালে লিখিত ‘চারুবাবু ও কতিপয় বিভ্রান্ত স্থপতি’-ও মতো শিখর স্পর্শ-করা কবিতা লেখা ছাড়া নিজেকে আর ডিঙ্গোতে পারেননি তিনি। তার বেশিরভাগ কবিতাই নিজের সাথে কথা বলা কিংবা প্রেমাষ্পদের সাথে কথোপথন। হয়তো কবিতা লেখাকে তাঁর অকেজো কাজ মনে হয়েছে, হয়তো তিনি নিজেকে কবি ভাবেননি, হয়তো শৈথিল্য, উপেক্ষা তো বটেই, ছিল। কবিতা যখন স্বতোঃস্ফূর্তভাবে তার কাছে ধরা দিয়েছে তিনি কলম ধরেছেন, নিজে কবিতার পেছনে ছোটেননি। কবিতা তার আরাধ্য দেবী নয়। একথা যখন লিখছি তখন চোখ চলে যায় তার ‘এই জন্মে-জনমে জনমে’ কবিতায়। যিনি লিখেন, “কবিতাকে খুব ভালোবাসি বললে কম বলা হয়।/
এমন দুঃসহ টানে অন্য কোন মানুষ বা প্রাণী/টানেনি, টানে না।” তার রক্তের ভেতর কবিতা খেলা করে। একই কবিতার অন্যত্র বলেন,
“আমার সমস্ত দুঃখ যন্ত্রণার পাশে
কবিতার মতো করে আজ অব্দি দাঁড়ায়নি কেউ।”
তখন সায়াহ্নবেলার এক প্রতিভাবান কবির কথা মনে পড়ে। তিনি বিনয় মজুমদার, কবিতার জন্য জীবন উৎসর্গ করা যোগী। কাশীনাথ রায় কাব্য প্রতিভায় বা কাব্যআত্মত্যাগে বিনয় মজুমদারের সমতুল্য নন অবশ্যই, কিন্তু একথা বলা যায়, কবিতা কাশীনাথ রায়ের শ্রেষ্ঠ সহচর। আরও বলবো যে নিষ্ঠায় কাব্য দেবীকে আরাধনা করা উচিৎ ছিল, তিনি তা করেননি, লেগে থাকেননি। থাকলে তার নিভৃতলোকের স্বর বহির্লোকের বাণী হতো। কবিতা রচনার ক্ষেত্রে তাকে কিছুটা অসতর্ক ও নিস্পৃহ বলে মনে হয়। তিনি অনুপ্রেরণাতাড়িত কবি, আয়াসসাধ্য বা যত্নশীল নির্মাণে বিশ্বাসী নন। পরিমার্জনা সঙ্কুচিত করে স্বতোঃস্ফূর্ত ভাবকে এ কথা বিশ্বাস করেন। বিষয়ে (content) নিবিষ্ট, কিন্তু কাঠামোতে (form) উদাসীন- এই কবি। তার কবিতা, যেমনটা তিনি চেয়েছেন, সরল ও আড়ালহীন। তাঁর কবিতা কোলাজধর্মী, আখ্যানমূলক ও কাব্য অলঙ্কারবিরল। তবু বলব কাশীনাথ রায় আরো বেশি উচ্চারিত হবার দাবী রাখেন। তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা!
পাদটিকা:
এ লেখাটি কবি পুলক হাসান সম্পাদিত ‘খেয়া’ পত্রিকার কাশীনাথ রায় সংখ্যায় প্রকাশিত। আনন্দ যে নিভৃতচারী প্রতিভাবান মানুষটি তা দেখে যেতে পেরেছেন। বেদনা এই যে এর অব্যবহিত পরেই তিনি ইহধাম ত্যাগ করেন।