বুধবার, জানুয়ারি ১৫, ২০২৫
Homeঅন্যান্যশিল্পীর সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গে: লুৎফর রহমান

শিল্পীর সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গে: লুৎফর রহমান

লেখক, কলামিস্ট

সভ্যতার কথা বলছি। আদিকালে মানুষ সভ্য ছিলো না, বনে বনে বস্ত্রহীন ঘুরে বেড়াতো, ছিলো এক অনিশ্চিত জীবন। এখন আমরা সভ্য। এই সভ্যতার নাম পুঁজিবাদী সভ্যতা।

সভ্যতার সাথে যুক্ত আছে এর দুটো দিক, একটি বৈষয়িক এবং অন্যটি মানসিক দিক। বৈষয়িক দিকটি হচ্ছে যান্ত্রিক অগ্রগতি এবং মানসিক দিকটি হচ্ছে আদব, লেহাজ, চালচলনের উৎকর্ষ অর্থাৎ সাংস্কৃতিক দিক। এখানে আমরা শিল্পীর সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলতে চাই।

পুঁজিবাদী সমাজ একটি শোষণভিত্তিক শ্রেণি বিভক্ত সমাজ। শোষণ হচ্ছে কারারুদ্ধের শিকল। শিল্পী সবসময় সকল বন্ধন থেকে মুক্তি চায়। তাই সে এ সমাজ পছন্দ করে না, চায় নতুন সমাজ নতুন সভ্যতা। বাধ্য হয়ে সভ্যতার দু দিকের কথা তাকে ভাবতে হয়; তাকে রাষ্ট্রিক ও সামাজিক কাঠামোর চুলচেঁরা বিশ্লেষণ করতে হয়। তাঁর অন্তর্জগতে থাকে নতুন সমাজের জন্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি সৃষ্টির পথ-নির্দেশনা। শুধু নির্দেশনা থাকলে হয় না, নতুন সমাজের জন্য হাতে-কলমে কাজও করতে হয়। তাঁকে অগ্রসর হতে হয় দ্বান্দ্বিকভাবে, এগুতে হয় প্রামাণিকভাবে। আর এখানেই এসে যায় তত্ত্ব ও তথ্যের বিষয়টি। তত্ত্ব ও তথ্যের মাঝে চুল পরিমাণ ফাঁক থাকাও চলে না।

এমনটা কেউ ভাবতে পারেন যে, তাত্ত্বিকতার জায়গাটাতে আবেগ-অনুভূতির কোনো স্থান থাকতে পারে না। এ চিন্তা সঠিক নয়। সুকঠিন তত্ত্ব সম্পর্কিত বিষয়ে একটা প্রবল অনুভূতিপ্রবণতার স্রোত থাকে। তাই মানুষের স্বপ্ন দেখার বিষয়টি মূল্যায়নের দাবি রাখে। এই স্বপ্ন দেখার পেছনেতো কাজ করে মানুষের আবেগ-অনুভূতি। সুতরাং বলা যায় শিল্পকলা, বিজ্ঞান ও গণসম্পৃক্ত কাজকর্মে এই আবেগ-অনুভূতি সহায়ক। তবে অনুভূতির ভিত্তি হতে হবে বাস্তব। আবেগ-অনুভূতি বাস্তব হলে সেটা জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন খাতে প্রবাহিত হবে না, আকাশ-কুসুম হবে না। স্বপ্ন ও জীবনের মাঝে সম্পর্ক থাকলে সব শুভ হয়। তাই শিল্পীকে যান্ত্রিকতা পরিহার করে চলতে হবে।

শিল্পীকে তাত্ত্বিকতার ক্ষেত্রে মুক্তমনা হতে হবে, কারণ মানুষের জ্ঞান কোনো সরলরেখা নয়, তা সরলরেখা অনুসরণ করে চলেও না। মানুষের জ্ঞানকে বক্ররেখা বলা যেতে পারে। এই বক্ররেখা বৃত্তের পর বৃত্ত রচনা করে অগ্রসর হয়, অর্থাৎ সরল জটিল হয় এবং জটিল জটিলতর হয়ে এগোয়। শিল্পীকে আরো মনে রাখতে হবে জ্ঞানের একটি ধারাবাহিকতা আছে, এখানে বিচ্ছিন্নতা বলতে কিছু নেই। তাই শিল্পীকে সব সময় খণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করে চলতে হবে। কারণ খণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গি ও গোঁড়ামি একই বস্তু।

আমরা শুরুতে যে কথাটা বলেছি যে, শিল্পী সমাজের আমূল পরিবর্তন চায় এবং সেটা করতে হলে পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে আমূল বদলে দিতে হবে। অর্থনীতির পরিপূর্ণ বিকাশ ও মুক্তি মানুষের আত্মিক বিকাশকে সব বন্ধন থেকে মুক্ত করে। মনে রাখতে হবে মানুষ, মেহনতি মানুষ আমূল পরিবর্তনের নায়ক। সুতরাং শিল্পীকে আত্মিক ও মানসিক প্রস্তুতির ওপর চূড়ান্ত গুরুত্বারোপ করতে হবে। এর কোনো ব্যতিক্রম করা যাবে না।

শিল্পীকে বিজ্ঞানমনস্ক হতে হবে। তবেই তাঁর বিজ্ঞানসম্মত সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠবে। আমাদের শিল্পীদেরকে অতীতের সব সুন্দর সৃষ্টিকে গ্রহন করতে হবে, রক্ষা করতে হবে। যতো পুরনোই হোক জীবনের পক্ষে হলেই তা সুন্দর বলে বিবেচিত হবে। একে অনুসরণও করতে হবে। আমরা মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, তারাশঙ্কর, নজরুল, জসীম উদ্দীন, সুকান্ত, জয়নূল, এস এম সুলতান ও আরো অনেকের প্রসঙ্গ টেনে কথাটা বলতে পারি।

শিল্পীর ব্যক্তিত্ব একটি হিসেবের বিষয়। তবে মনে রাখতে হবে একজন যতো জ্ঞানীই হোন না কেনো তিনি সবজান্তা হতে পারেন না। একা সব দায়িত্বপালনও কারো পক্ষে সম্ভব না। শিল্পীর সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয় থেকে প্রশ্নটা আসে। সুতরাং যৌথ প্রচেষ্টার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। শিল্পীকে হতে হবে নৈর্ব্যক্তিক, দৃষ্টিভঙ্গি হবে বিশ্বজনীন।

পুঁজিবাদ, সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব তার কিছু সেবাদাসের মধ্যে আটকে রাখে। আসলে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শতফুল ফুটতে দিতে হবে। এ লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের খাঁটি নেতাদের প্রয়োজনে নিজেদেরকে গৌণ করতে হবে। জনগণের মধ্য থেকে, মেহনতি মানুষের মধ্য থেকে শিল্পী, লেখক গড়ে তুলতে হবে। ইতালির বিখ্যাত চিন্তাবিদ গ্রামচি আমূল পরিবর্তন, নেতা ও সাংস্কৃতিক কর্মীকে এক করে দেখেছিলেন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সব সাংস্কৃতিক চিন্তক মনে করেন, যে-শিল্পী ও কর্মী সমাজের তলা থেকে উঠে আসে তাঁর ওপর প্রত্যাশা বেশি করা যায়। এর উদাহরণ হিসেবে মাক্সিম গোর্কির নাম উল্লেখ করা যায়। সে জন্য শত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে মেহনতি নর-নারীকে শিল্প আয়ত্ব করার সুযোগ করে দিতে হবে, যাতে তাদের মাঝখান থেকে শিল্পী বেরিয়ে আসে। কারণ ইতোমধ্যে আহরিত সাংস্কৃতিক ও শিল্প-সম্পদে তাদের সমান অধিকার রয়েছে, অংশ রয়েছে কারণ মেহনতই দুনিয়াকে সুন্দর করে। তাই শিল্প-সম্পদে সমবন্টন কাম্য। এটা হলে মেহনতি মানুষের মানসিক ক্ষমতার পূর্ণ বিকাশ ত্বরান্বিত হবে। এ কাজে উপকরণের স্বল্পতা ও সীমাবদ্ধতা থাকলেও যতোটুকু সুযোগ আছে তা দিয়েই শুরু করতে হবে। অতীতের শিল্পকর্ম জনসন্মুখে তুলে ধরতে হবে।
শিল্পীকে আরো মনে রাখতে হবে হাজার হাজার বছর লড়ে মানুষ যে মানবিক মূল্যবোধ অর্জন করেছে, দুনিয়াময় পুঁজিবাদী চক্র সেটা ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলতে সচেষ্ট। মেহনতি মানুষ যাতে সে মূল্যবোধ রক্ষা করতে পারে এবং নতুন উন্নততর মূল্যবোধের জন্ম দিতে পারে শিল্পীর সে লক্ষ্যে কাজ থাকবে।

সবশেষে বলতে চাই, শিল্পীর এমনতোর সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিই সহায়ক হবে মানুষের নতুন সভ্যতায় উপনীত হতে যেখানে মানবজাতির মুক্তি নিহীত।

- Advertisement -spot_img
আরও সংবাদ
- Advertisement -spot_img
এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here