মঙ্গলবার, জানুয়ারি ১৪, ২০২৫
Homeঅন্যান্যবাংলায় নীল চাষ অত:পর বাংগালীর জনজীবন

বাংলায় নীল চাষ অত:পর বাংগালীর জনজীবন

অনলাইন ডেস্ক রিপোর্ট

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের ফলে বস্ত্রশিল্পের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয় এবং কাপড় রং করার জন্য নীলের চাহিদা শতগুনে বেড়ে যায়। ফলে ওই সময়ে নীল চাষের ব্যবসা অত্যন্ত লাভজনক হয়ে ওঠে।

প্রাগৈতিহাসিককাল থেকেই ভারত বর্ষে নীল চাষ ও প্রক্রিয়াকরণকরা হতো ইউরোপীয় বণিকরা অন্যান্য অনেক কৃষিজাত পণ্যের পাশাপাশি নীলের সুলভতার কারণেই ভারতবর্ষের প্রতিআকৃষ্ট হয় পরে পর্তুগিজরা ওয়েস্টইন্ডিজ যাবার সমুদ্র পথ আবিষ্কার করলে সেখান থেকেই গোটা ইউরোপের বাজারে সরবরাহ করার মতো যথেষ্টপরিমাণ নীল আমদানি শুরু করে।

সপ্তদশ শতকে ওলন্দাজরা নীলব্যবসায় পর্তুগিজদের একচেটিয়া সুবিধা নষ্ট করে দেয়।এরপর ইংরেজরাও তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে শুরু করে।

ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করার পর তারা এদেশীয় চাষীদের দ্বারা কম খরচে নীল উৎপাদন শুরু করে।

ব্রিটিশরা আগেঔড নামক এক প্রকার গাছ থেকে নীলভ তৈরি করতো।ভারতবর্ষে বাণিজ্য শুরু করার পর ব্রিটিশ বণিকরা পশ্চিম ভারত থেকে নীল কিনে নিয়ে যেত ইউরোপে। দেশীয় আদি পদ্ধতিতে তৈরি এই নীল ইইউরোপের বাজার থেকে ঔডের রংকে সরিয়ে দেয়, এনে দেয় সন্তোষজনক মুনাফা।

ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান নীলকররা এতে প্রলুব্ধ হয়।সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে দেখা যায়, ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান নীলকরদের উৎপাদিত উচ্চমান অনুসারে প্রক্রিয়াকৃত নীল ইউরোপের বাজার থেকে ভারতীয় নীলকে হটিয়ে দিতে শুরু করেছে।এই প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭২৪ সালে নীল ব্যবসা পরিত্যাগ করে কিন্তু তারা বাজার ছেড়ে দেবার অব্যবহিত পরেই ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান নীলকররা অপেক্ষাকৃত বেশি লাভজনক চিনি ও কফির ব্যবসায় ঢুকে পড়ে।ফলে তাদের নীল ব্যবসা স্তিমিত হয়ে যায়।

বাংলাদেশে নীলের চাষ প্রধানতঃ পশ্চিমবঙ্গ, যশোর, কুমিল্লা, সিলেট, ফরিদপুর, খুলনা, পাবনা, রাজশাহী এবং দিনাজপুর জেলার কিছু অঞ্চলে করা হয়। পরবর্তীতে বর্তমান জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ থানায় নীল চাষ করা হয়।

নীল চাষ কী? নীল বিদ্রোহ কেন হয়েছিল?
উত্তর: ১৮৫৯ – ৬০ খ্রীষ্টাব্দে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিদেশী নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে ব্যাপক কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয় তা নীল বিদ্রোহ নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহ blue mutiny নামেও অভিহিত।

নীল বিদ্রোহের কারণ : উনিশ শতকের প্রথম দিকে নীল ব্যবসায় ছিল খুবই লাভজনক। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ইউরােপীয় বণিকদের হাতে নীল ব্যবসায়ের একচেটিয়া অধিকার তুলে দেন। ১৮৩৩ সালে সনদ আইনে ভারতে এসে যে কোন ব্রিটিশ নাগরিক নীল চাষ করার অধিকার পেতেন।

প্রায় সব ক্ষেত্রেই নীল চাষের মালিকানা ছিল নীলকর সাহেবদের হাতে। নীল চাষের জন্য বিভিন্ন কুঠি স্থাপিত হয়। কৃষকদের দাদন বা অগ্রিম অর্থ নিয়ে তার জমিতে নীল চাষের ব্যবস্থা করা হত। এই দাদনের পরিমাণ ছিল নগণ্য। কিন্তু কৃষকদের শ্রম ও অর্থ দিয়ে নীল চাষ করতে হত। এইভাবে নীলচাষীদের শােষণের উপর নীল সাহেবরা মুনাফা লুটতে লাগলেন।

অর্থনৈতিক শােষণের পাশাপাশি ছিল গরীব চাষীদের উপর নির্মম অত্যাচার। কোন চাষী নীল চাষ করতে অসম্মত হলে তার উপর অকথ্য অত্যাচার চলত। এই সব অত্যাচার ও শােষনে বিরুদ্ধে নীলচাষীরা বাধ্য হয়ে বিদ্রোহের পথে অগ্রসর হয়। ১৮৫৯ – ৬০ খ্রীষ্টাব্দে বাংলাদেশের যশােহর, খুলনা, চব্বিশ পরগণা, নদীয়া, ফরিদপুর, পাবনা প্রভৃতি জেলায় প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ কৃষক এই বিদ্রোহে সংশ্লিষ্ট হয়।

প্রথম দিকে বিদ্রোহ ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু নীল সাহেবদের দমন নিপীড়নের চাপে অতিষ্ঠানে হয়ে কৃষকেরা মরিয়া হয়ে নীলকরদের কুঠি আক্রমণ করে। নীল বিদ্রোহের নেতাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন যশােহর , খুলনা অঞ্চলের চৌগাছা গ্রামের দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস তথা তারা এক সময়ে নীলকুঠির দেওয়ান ছিলেন কিন্তু প্রজাদের ওপর অত্যাচারে বিচলিত হয়ে তাঁর প্রজাদের সমবদ্ধ করতে অগ্রসর হয়।

নীল বিদ্রোহ) ছিল একটি কৃষক আন্দোলন এবং পরবর্তীকালে নীল চাষীদের বিরুদ্ধে নীল চাষীদের বিদ্রোহ , যা ১৮৫৯ সালে বাংলায় উঠেছিল এবং এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলতে থাকে। গ্রামের প্রধান (মন্ডল) এবং উল্লেখযোগ্য রায়ট ছিল সবচেয়ে সক্রিয় এবং অসংখ্য দল যারা কৃষকদের নেতৃত্ব দিত। কখনও কখনও ইউরোপীয় চাষীদের অসন্তুষ্ট প্রাক্তন কর্মচারীরা – ‘গোমশতা’ বা নীল কারখানার ‘দিওয়ান’, নীলকরদের বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগঠিত করার নেতৃত্ব নিয়েছিল।

বাংলায় একটি বিকানের রঞ্জক কারখানা,১৮৬৭।
১৮৫৯ সালের গ্রীষ্মে বাংলায় যখন হাজার হাজার রায়ট ইউরোপীয় চাষীদের জন্য ক্ষোভ এবং অবিরাম সংকল্প প্রদর্শনের সাথে নীল চাষ করতে অস্বীকার করেছিল, তখন এটি ভারতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কৃষক আন্দোলনগুলির মধ্যে একটি হয়ে ওঠে। নদীয়া জেলায় উদীয়মান , বিদ্রোহ ১৮৬০-এর দশকে বাংলার বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ে এবং নীল কারখানা এবং চাষীরা অনেক জায়গায় সহিংস আক্রমণের সম্মুখীন হয়। ১৮৬০ সালে ইন্ডিগো কমিশন গঠনের পর বিদ্রোহের অবসান ঘটে যা সিস্টেমের সংস্কারের প্রস্তাব দেয়, যা ছিল সহজাতভাবে শোষণমূলক।

নীল দর্পণ দীনবন্ধু মিত্রের ১৮৬০ সালের নীল দর্পণ নাটকটি ঢাকায় প্রকাশিত হয়েছিল এবং এটি বিদ্রোহের উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছিল। এটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং প্রকাশ করেছেন অ্যাংলিকান ধর্মযাজক জেমস লং। নাটকটি প্রকাশের জন্য, লংকে ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষ বিচারের মুখোমুখি করেছিল এবং তাকে এক মেয়াদের কারাদণ্ড এবং ১০০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছিল। লং এর বন্ধু কালীপ্রসন্ন সিংহ তার জরিমানা পরিশোধ করেন।

নাটকটি বাংলায় থিয়েটারের বিকাশের জন্য অপরিহার্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল এবং গিরিশ চন্দ্র ঘোষকে প্রভাবিত করেছিল, যিনি ১৮৭২ সালে কলকাতায় ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করতে যান , যেখানে প্রথম নাটকটি বাণিজ্যিকভাবে মঞ্চস্থ হয়েছিল নীল দর্পণ। বেন মুসগ্রেভের নাটক ইন্ডিগো জায়ান্ট , দীনবন্ধু মিত্রের ট্রেইল-ব্লেজিং ইন্ডিগো মিরর দ্বারা অনুপ্রাণিত, ২০২২ সালে বাংলাদেশে এবং ২০২৪ সালে যুক্তরাজ্যে মঞ্চস্থ হয়েছিল।

নীলচাষে কর্মরত ছিল ১ কোটি ১২ লক্ষ ৩৬ হাজার কৃষক এবং নীলকুঠিগুলোতে নিযুক্ত কর্মচারীর সংখ্যা ছিল ২ লক্ষ ১৮ হাজার ৪৮২ জন।

- Advertisement -spot_img
আরও সংবাদ
- Advertisement -spot_img
এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here