বৃহস্পতিবার, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২৫
Homeঅন্যান্যবিপ্লবকে যে কারণে 'অকাল সিজার' বলছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অবঃ) ইকবাল করিম...

বিপ্লবকে যে কারণে ‘অকাল সিজার’ বলছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অবঃ) ইকবাল করিম ভূঁইয়া

অনলাইন ডেস্ক রিপোর্ট

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে যারা শিক্ষার্থীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে আন্দোলনের মাত্রা ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন তাদের অন্যতম সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভুইয়া। ২০১২ সালে আওয়ামী লীগের শাসনামলে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ পাওয়া এই জেনারেল নিজের ফেসবুকে তুলে ধরেছেন আলোচিত সেই সময়ের নানা ঘটনা প্রবাহ। তার দৃষ্টিতে কেমন ছিল ২৪ এর বিপ্লব।

জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া তার পোস্টে জানান, স্বাধীনতার পর মাত্র ২৫ বছর ব্যবধানে বাংলাদেশ তিনটি গণঅভ্যুত্থান দেখেছে। যেখানে সেনাবাহিনী কখনো বিপ্লবীদের পাশে থেকেছে বা কখনো নিরপেক্ষ থেকেছে।

প্রথমটি ঘটে ১৯৭১ সালে, দ্বিতীয়টি ১৯৯০ সালে, আর তৃতীয়টি ২০২৪ সালে। তবে ২৪ এর বিপ্লবকে আধা বিপ্লব হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি। সেই সঙ্গে বিপ্লবীরা কিভাবে নতুন ভবিষ্যৎ নির্মাণের সুযোগ হারালো সে বিষয়ে করেছেন আলোকপাত।

পোস্টে জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া বলেন, ২০২৪ সালে তৃতীয় প্রধান ঘটনাটি ঘটে, যাকে আধা বিপ্লব বলা যেতে পারে। কারণ পুরোপুরি বিকশিত হবার আগেই ফ্যাসিবাদী সরকারের সংবিধান, রাষ্ট্রপতি ও সামরিক বাহিনী মিলে একে আটকে দেয়। বঙ্গভবনকে বড় ধরনের বিক্ষোভের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখা হয়। কিন্তু গণভবন তুলনামূলকভাবে সহজেই বিক্ষোভকারীরা দখল করে।

২৪ এর বিপ্লবে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ করা এখনো কেন সম্ভব নয় তার ব্যাখ্যাও দেন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ইকবাল। তবে তিনি জানান, সেনাবাহিনীর অবস্থান খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত হলেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি উপাদান ছিল, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক সদস্যদের প্রভাব যাকে এখন প্রায়ই উপেক্ষা করা হয়। সেসঙ্গে কিছু প্রশ্ন সামনে আনেন তিনি। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসা হলো, শেখ হাসিনা কিভাবে পালিয়ে গেলেন এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, পুলিশ কিভাবে আশ্রয় পেলেন ক্যান্টনমেন্টে?

তিনি আশা প্রকাশ করেন এসব তথ্যের ঘাটতি পূরণ হলে মিলবে সেনাবাহিনীর প্রকৃত ভূমিকা। সাবেক সেনাপ্রধান লিখেছেন, আজ পর্যন্ত ২০২৪ সালের জুন, জুলাই এবং আগস্ট মাসে কয়েক সপ্তাহব্যাপী চলা এই আন্দোলন এর সময় সেনাবাহিনীর সঠিক ভূমিকা নিয়ে স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। সরকারিভাবে কোন তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি। সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরেও আনুষ্ঠানিক কোন তদন্ত, আদালত হয়নি। ফাঁস হওয়া গোয়েন্দা তথ্যের টুকরো মিললেও, সেগুলো দিয়ে সেনাবাহিনীর আসল আচরণ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায় না। এজন্য এ বিপ্লবটির ফরাসি বা রুশ বিপ্লবগুলোর সাথে তুলনামূলক আলোচনা করা কষ্টকর।

আন্দোলনের সময় নিজের ফেসবুক কভার ও প্রোফাইল ছবি লাল করার প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন জেনারেল ইকবাল করিম ভুইয়া। তার এই পদক্ষেপ সে সময় যে গভীর প্রভাব ফেলেছিল তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন। সেই সঙ্গে এও জানান, অনুরোধের পরও আগের প্রোফাইলের ছবিতে না ফেরায় তার উপর বিরক্ত হন শেখ হাসিনা।

তিনি লিখেছেন, নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের উপর নির্মম দমন-পীড়ন বিশেষ করে আবু সাঈদের নির্মম হত্যাকাণ্ড দেখে কয়েক রাত নির্ঘুম কাটানোর পর আমি তাদের অনুরোধ রাখতে মনস্থির করি। কিন্তু নিজে তেমন প্রযুক্তি জ্ঞানী না হওয়ায় আমার ছোট মেয়েকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারি, কিভাবে ছবিটি পরিবর্তন করতে হয়। সে দ্রুতই লাল রঙের একটি গ্রাফিক পাঠায় যেটি আমি আপলোড করি। তারিখ ছিল ৩১ জুলাই এর দিকে।

অবসরপ্রাপ্ত এ জেনারেলের ভাষ্য আমার ধারণা ছিল না, এই পদক্ষেপের প্রভাব কতটা গভীর হবে। মাত্র ছয় ঘন্টায় উল্লেখযোগ্য সেনা সদস্যদের ফেসবুক প্রোফাইল ছবি লাল হয়ে যায়। শেখ হাসিনার নির্দেশে তার সামরিক সচিব ফোন করে আমাকে অনুরোধ করে আমি যেন আগের প্রোফাইলের ছবিতে ফিরি।

আমি রাজি হইনি, এতে শেখ হাসিনা স্পষ্টতই বিরক্ত হন। এরপর আমার সরকারি চাকরিজীবী আত্মীয়-স্বজনদের দিকে নানা ধরনের হুমকি আসতে থাকে।

বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকারুজ্জামানের বিচক্ষণতার প্রশংসা করে আইকেবি হিসেবে পরিচিত জেনারেল ভুইয়া জানান, মোড় ঘুরে যায় ৩ আগস্ট বেলা দেড়ঘটিকায়, যখন জেনারেল ওয়াকার সেনাপ্রাঙ্গণে জুনিয়র অফিসারদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। তাদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল কেননা নিরস্ত্র জনতার উপর গুলি চালানোর নির্দেশে তারা বিক্ষুব্ধ ছিলেন। তাদের অসন্তোষ অনুভব করে জেনারেল ওয়াকার বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে তাদের পক্ষে দাঁড়ান। তারপরে যদিও বিচ্ছিন্ন কিছু জায়গায় গুলির ঘটনা ঘটে যেমন যাত্রাবাড়িতে, অন্যত্র গুলির মাত্রা অনেকটাই কমে আসে।

ক্ষমতাসীন সরকারের ভিত কিভাবে নড়ে গেল, সে বিষয়ে নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন জেনারেল ইকবাল করিম। রাওয়াতে তাদের ব্রিফিংটি শেখ পরিবারকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

পোস্টে সাবেক এই সেনাপ্রধান লেখেন, আমরা বিভিন্ন বাসায় যাই বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত উর্ধতন অফিসারদের বাড়িতে যেমন সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেনেন্ট জেনারেল নুরুদ্দিন খানের। যিনি ১৯৯০ সালে এরশাদের স্বৈরতন্ত্র উৎখাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ৪ আগস্টের এই ব্রিফিং ক্ষমতাসীন সরকারের ভিত নাড়িয়ে দেয়। তখনও তারা আশা করছিল, হয়তো দেশব্যাপী অচল অবস্থার মধ্যেও কোনভাবে টিকে যাবে। শোনা যায়, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিকী ও শেখ হেলাল ব্রিফিং এর বিষয়বস্তু শোনার পর রীতিমত স্তব্ধ হয়ে যান। হয়তো বুঝতে পারেন তাদের সময় ফুরিয়ে এসেছে।

দেশ ছাড়ার একদিন আগেও শেখ হাসিনা অবসরপ্রাপ্ত এই জেনারেলকে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের সহিংসতা তার নানা ছবি পাঠান এবং ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেন বলে ফেসবুকে দাবি করেন সাবেক সেনাপ্রধান।

তিনি লেখেন, ৪ আগস্ট থেকেই শেখ হাসিনা আমাকে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের সহিংসতা নানা ছবি পাঠাতে শুরু করেন এবং ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। আমি ফোনে সাড়া দিইনি। ৭ আগস্টের পর ছবি পাঠানো বন্ধ করেন তিনি। শুধু ২৭ অক্টোবর শেষবারের মতো একটি ভিডিও পাঠান।

শেষ মুহূর্তে শেখ হাসিনা আরো একটি বলিয়া চেষ্টা করেন বলেও পোস্টে উল্লেখ করেন সাবেক এই সেনাপ্রধান।

তিনি লেখেন, ৪ আগস্ট রাতে গণভবনে সব নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধানদের ডেকে তিনি নির্দেশ দেন, বিক্ষোভকারীদের শেষ দফা আক্রমণ যেমন করে হোক দমাতে হবে। এজন্য একটি বিশদ পরিকল্পনা করা হয়। বিজিবি, র‍্যাব ও পুলিশকে ঢাকার ১৩ টি প্রবেশপথ আটকে দিতে বলা হয় এবং সেনাবাহিনীকে শহরের প্রধান এলাকাগুলো দখলে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। সেনাপ্রধান বুদ্ধিমত্তার সাথে এমন ভাবে সেনা মোতায়ন করেন, যাতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের ঝুঁকি কম থাকে।

তিনি জানতেন যে, বাহিনীর বেশিরভাগ সদস্যই গুলি চালাতে নারাজ। এর সঙ্গে তিনি এও লেখেন ৫ আগস্ট অসংখ্য মানুষ রাস্তায় ঢুকতে শুরু করলে বাইরের দিকে অবস্থান নেওয়া বিজিবি, র‍্যাব ও পুলিশ বাধা না দিয়ে তাদের পথ ছেড়ে দেয়। শহরের ভেতরে থাকা সেনা ইউনিটগুলো জনতার সাথে মিশে গিয়ে সহমর্মিতা প্রকাশ করে। গণভবন দখল হয় আর শেখ হাসিনা তড়িঘড়ি করে দেশ ছাড়েন।

কয়েক মুহূর্তের জন্য জনতাকে থামিয়ে রাখা হয়, যাতে তিনি হেলিকপ্টারে করে নিরাপদে বেরিয়ে যেতে পারেন। ধারাবাহিক পোস্টের সপ্তদশ অংশে হতাশা প্রকাশ করেছেন সাবেক এই সেনাপ্রধান।

সেনা সদস্যদের পাঁচটি রাজনৈতিক দল আর আইনের শিক্ষক আসিফ নজরুলকে ডেকে পাঠানোকে একটি বিতর্কিত পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।

অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল লিখেছেন, সেনাপ্রধান এবং নৌ ও বিমান বাহিনীর প্রধানরা মেজর জেনারেল ফজলে ইলাহী আকবর ও ডিজি, ডিজিএফআই মেজর জেনারেল হামিদের মাধ্যমে পাঁচটি রাজনৈতিক দল আর আইন শিক্ষক আসিফ নজরুলকে ডেকে পাঠান। যেখানে বিজিতদের বিজয়ীদের কাছে যাওয়ার কথা সেখানে উল্টো, বিজয়ীরা বিজিতদের কাছে রিপোর্ট করে।

তিনি আরো লেখেন, যে বিপ্লব জোরালোভাবে শুরু হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত এটি অকাল সিজারের মত জটিল কৌশলের মাধ্যমে অনেকটাই নিয়ে যায়। কিছু ক্ষমতাবান লোক মূল নাটের গুরু হিসেবে থেকে যান। বিপ্লব সম্পূর্ণভাবে সফল করতে কি কি করা জরুরী ছিল তাও পোস্টে তুলে ধরেন সাবেক এই সেনাপ্রধান।

তিনি লেখেন, যদি আদর্শভাবে ফরাসি ও রুশ বিপ্লবের ন্যায় এই বিপ্লব সম্পূর্ণ সাফল্য পেতে চাইতো, তাহলে হয়তো গণভবন ও বঙ্গভবন একযোগে দখল হতো। বিদ্যমান সংবিধান ছিড়ে ফেলা হতো, আর আগের শাসনের সহায়তায় যেসব উর্ধতন সামরিক কর্মকর্তা নিষ্ঠুরতা চালিয়েছেন, তাদের সবাই হয় দেশ ছাড়া হতেন বা বিচারের মুখোমুখি হতেন।

সামরিক বিদ্রোহ, সামরিক অভ্যুত্থান, গণঅভ্যুত্থান, গণবিপ্লব ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান শিরোনামে চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি থেকে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত মোট ১৭ টি পোস্ট করেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভুইয়া। ২৪ এর আন্দোলনের পাশাপাশি এসব পোস্টে সেনাবাহিনীর ভেতর বাইরের নানা ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। সেনাপ্রধানদের মধ্যে যারা অসাংবিধানিক উপায়ে রাজনৈতিক জটিলতা সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন তাদের পরিণাম ভয়াবহ হয়েছিল বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি।

- Advertisement -spot_img
আরও সংবাদ
- Advertisement -spot_img
এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here