১০ জুলাই দিনটি বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনের দুজন বিখ্যাত মানুষের জন্ম এবং মৃত্যুর দিন। বহুভাষাবিদ প্রখ্যাত সাহিত্য সাধক পন্ডিত ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর জন্মদিন এবং বিশশতকের চল্লিশ দশকের প্রখ্যাত কবি ও কিংবদন্তীতুল্য সাহিত্য সম্পাদক আহসান হাবীবের প্রয়াণ দিবস। আমি এই দিনে দুই মহান প্রতিভাবান ব্যক্তিত্বের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি।
খবরের কাগজ থেকে তরুণ কবি সানজিদ সকাল যখন আমাকে কবি আহসান হাবীব( ১৯১৭-১৯৮৫) র ওপর একটি ছোট্ট লেখার জন্য অনুরোধ করলেন,তখন আমি দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম। এমন একজন কিংবদন্তি কবির ওপর অন্তত হাজার দুয়েক শব্দের কমে কী লেখা যায়! দৈনিক পত্রিকার স্পেস বিবেচনায় কাটছাঁট করে কবিতার উদ্ধৃতিহীন একটি লেখা গত শুক্রবার ( ৪ জুলাই) ছাপা হলেও আমার কাছে অসম্পূর্ণই মনে হয়েছে উদ্ধৃতির অভাবে। তাই এফবি পাঠকদের জন্য পূর্ণাঙ্গ লেখাটি উপস্থাপন করলাম।
কবি আহসান হাবীবের সঙ্গে ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত তাঁর সহকারী হিসেবে কাজের সুবাদে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল এবং তাঁকে কবি হিসেবে যেমন তেমনই অসামান্য সাহিত্য সম্পাদক হিসেবেও কাছে থেকে জানবারও সুযোগ হয়েছিল। তাঁর মত সৎ, নিষ্ঠাবান জহুরী সাহিত্য সম্পাদক এদেশে আর জন্মগ্রহণ করবেন কিনা জানি না। তিনি লেখক চিনতে ভুল করতেন না। যাঁর মধ্যে সম্ভাবনা দেখেছেন তাঁকে বারবার প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন। একটা সময় ছিল যখন আহসান হাবীব কারো লেখা ছাপলে তাঁকে লেখক বলে মনে করতেন অন্যরা। মানসম্পন্ন বিবেচিত না হলে অনেক খ্যাতনামা লেখকের লেখাও তিনি ছাপতেন না, কিংবা সংশোধন করে ছাপতেন। আবার এমন অনেক তরুণ কেউ তিনি ব্যাপক প্রচার দিয়েছেন যারা পরবর্তীকালে বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। মর্যাদাবান লেখক বিবেচিত হয়েছেন। ১৯৮১ সালে আবিদ আনোয়ার যখন তরুণ কবি সে সময়ই তাকে ব্যাপক গুরুত্বের সঙ্গে ছেপেছে আহসান হাবীব। মধ্য দিনের জানালা শিরোনামে মাসে দুটি কলাম ছেপেছেন তাঁর। গত শতাব্দীর ষাটের দশকের স্বনামখ্যাত কবিরা তো বটেই এমন কি ৭০-৮০ দশকের ময়ূখ চৌধুরী, মাসুদুজ্জামান, রফিক উল্লাহ খান, মুজিবুল হক কবীর, আসাদ মান্নান , ফরিদ কবিরসহ আজকের অনেক সুপ্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকের কথাই বলা যায়— বলতে গেলে যাঁদের অনেককে কবি আহসানা হাবীব আবিষ্কার করেই প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন।
১৯৮১ সালের স্কুলছাত্রী নাসরীন জাহান, একই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ঝর্না রহমানের মতো সেদিনের নবীন সাহিত্যিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয়ের আগেই পরোক্ষে পাওয়া সত্ত্বেও গুণবিচার করে তাদের একাধিক লেখা প্রকাশ করেছিলেন তিনি। যা-ই হোক আমাদের প্রজন্ম কবি আহসান হাবীবের সাহিত্য সম্পাদনার দক্ষতা এবং গুণপনার কথা জানলেও একালে তা প্রায় অজ্ঞাতই রয়ে গেছে। এমনকি তাঁর চির আধুনিক কবিতাও একালের ক’জন তরুণ কবি পড়েছেন বা পড়ছেন জানি না। অথচ ব্যক্তি মানুষ হিসেবে তিনি যেমন আধুনিক ছিলেন, লেখার ক্ষেত্রেও তার সেই আধুনিকতা অক্ষুন্ন ছিল আমৃত্যু। ষাটোর্ধ্ব বয়সেও একজন তরুণের মতো চলাফেরা করতে ভালবাসতেন। “বয়স্ক মানুষ” বলে কেউ সাহায্য করতে চাইলে বিরক্ত হতেন। অনেক সময় বিদ্যুৎ থাকতো না দৈনিক বাংলা ভবনে, লক্করঝক্কর লিফট বন্ধ। তিনি সরু সিঁড়ি বেয়ে চার তলায় উঠতেন। কিন্তু ভুলেও কেউ যদি সাহায্য করতে চাইতেন, সাংঘাতিক বিরক্ত হতেন। এমন দু-একটি ঘটনা আমার মনে আছে।
প্রায় এক বছর বিনা বেতনেই মাঝে মাঝে গিয়ে তাঁর কাজে সহযোগিতা করতাম। হাবীব ভাই যে অ্যাসাইনমেন্ট দিতেন সেগুলি করে দিতাম। আমার কবিতা এবং নানা রকম গদ্য ছাপা হতো লেখার বিল পেতাম। কিন্তু যেদিন মাত্র সর্ব সাকুল্যে মাসিক ৫০০ টাকা বেতনে আমাকে কন্সোলেটেড নিয়োগের চিঠি দিলেন দৈনিক বাংলার কর্তৃপক্ষ, সেদিন অফিসে যাওয়ার পর তিনি আমার হাতে চিঠিটি দিয়ে বললেন, তোমার জন্য সুসংবাদ হল শেষ পর্যন্ত সম্পাদক তোমাকে নিয়োগ দিতে রাজি হলেন, এই নাও তোমার নিয়োগ পত্র। তবে দুঃসংবাদ হলো এখন থেকে তোমাকে দেওয়া এসাইনমেন্ট ছাড়া তোমার কবিতা বা আর কোনো লেখা এই পাতায় ছাপা হবে না। কেন না তুমি আমার সহকারী, এই পাতার অংশ। তিনি নিজেও কোনদিন তার লেখা দৈনিক পাকিস্তানের বা দৈনিক বাংলায় ছাপেননি। হাবীব ভাইয়ের অনুজ সহোদর মুস্তাফা জামাল চলচ্চিত্র প্রকাশনা বিভাগের চাকরি করতেন, কবিতা লিখতেন। অন্যান্য পত্রিকায় তার কবিতা ছাপা হতো।তার কবিতাও বছরে একটি কি দুটির বেশি হাবীব ভাই ছেপেছেন বলে মনে পড়ে না।
তথ্য হিসেবে একথা আমরা অনেকেই জানি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ রাত্রি শেষ’র প্রকাশক ছিলেন আর এক কালজয়ী কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, তাঁর কমরেড পাবলিশার্স থেকে ১৯৪৭ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল রাত্রিশেষ। দেখেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। প্রথম কাব্যগ্রন্থেই তিনি তাঁর কবিসত্তা সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
একথা সাহিত্য-বোদ্ধামাত্রই স্বীকার করবেন কবিতায় কালোত্তীর্ণ এবং চিরঞ্জীব কবি আহসান হাবীব। কিন্তু কাব্যশিল্পে সেই উত্তরণের পথটা তাঁর জন্য সহজ ছিল না। কারণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন প্রায়, শিক্ষায় অনগ্রসর দারিদ্র্য-পীড়িত পূর্ব বাংলায় জন্মেছিলেন আহসান হাবীব। অবিভক্ত ভারতবর্ষের পূর্ববঙ্গের গ্রামবাংলার (পিরোজপুর মহকুমার শংকর পাশা গ্রাম ) মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া এক তরুণের পক্ষে মোটেও সহজ ছিল না নগর কলকাতায় গিয়ে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করা। কবিতার জন্য পিতৃদত্ত নাম পর্যন্ত পরিবর্তন করে নিয়ে হয়েছিলেন আহসান হাবীব। তাঁর পরীক্ষার সার্টিফিকেটে থাকা সেই পারিবারিক নামটি যেভাবেই হোক আমি জেনেছিলাম। তিনি সে নাম কোথাও প্রকাশ করতে চাননি । তাই আজো আমি কোথাও উল্লেখ করিনি। কলকাতায় যাওয়ার আগে শুধু হবীব নামে তার কিছু কবিতা ছাপা হয়েছে।
১৯৩৩ সালে ম্যাট্রিক পাস করে দেড় বছর বিএম কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার পরে পরীক্ষা না দিয়েই কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন । সেখানেই কবি হিসেবে তাঁর প্রতিষ্ঠা। আকাশ বাণী কলকাতায় অনুষ্ঠান উপস্থাপকের দায়িত্ব পালনের মত অসাধ্যও সাধন করেছেন সে যুগের তরুণ কবি আহসান হাবীব। গল্প দাদুর আসর পরিচালনা করেছেন তিনি কিছুকাল।
পিতা হামিজউদ্দিন হাওলাদার পুত্রকে প্রথমে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করলও পরে মাদ্রাসায় ভর্তি করেছিলেন আত্মীয়-স্বজনের পরামর্শে। কিন্তু পুত্র মাদ্রাসায় নয়, স্কুলে পড়ারই ইচ্ছা প্রকাশ করলে বাবা তাঁকে স্কুলে ভর্তি করেন আবার। ওই মনোভাব এর মধ্যেই তারা আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের কলকাতা নগরীতে সে যুগে যে স্বল্প সংখ্যক মুসলিম কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন, আহসান হাবীব ছিলেন তাঁদেরই অন্যতম।
তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ :
প্রথম কাব্যগ্রন্থেই স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে আবির্ভূত হয়েছিলেন আহসান হাবীব। তিরিশি কবিদের ইউরোপীয় আধুনিকতাজাত কৃত্রিম নগরযন্ত্রণা, নিঃসঙ্গতা আর ব্যাক্তিকেন্দ্রিকতার হাহাকার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে তিনি রচনা করেছিলেন এক নতুন কাব্য ভূগোল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তাণ্ডবে বিধ্বস্ত বিশ্ব বাস্তবতায় ইউরোপীয় সভ্যতার প্রতি জীবন সায়াহ্নে আস্থা হারিয়েছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, তা আমরা যেমন টের পাই তাঁর মৃত্যু পূর্ববর্তী লেখা “সভ্যতার সংকট” প্রবন্ধে, তেমনি আহসান হাবীবের কবিতাও সেই ভয়াল যুদ্ধের অবক্ষয়ের ছবি এবং হতাশা আমরা দেখি কিন্তু তিনি আশাবাদিতায় মুছে ফেলেন হভাশার ধূসর পান্ডুরতা। যা তাঁকে তিরিশি কবিদের থেকে শুরুতেই পৃথক করে দিয়েছে। “চেনা পৃথিবীকে ভালোবাসিতাম, জানাজানি ছিল বাকী/ জানতাম না তো সে পরিচয়েতে ছিল অফুরান ফাঁকি (এই মন এ মৃত্তিকা/রাত্রি শেষ)।
কিন্তু তিরিশি কবিদের মতো সে হতাশা স্থায়ী হয়নি তাঁর মনে। তাইতো রাত্রি শেষ শুরুই হয় আশাবাদিতায় :
ঝরা পালকের ভস্মস্তূপে তবু বাঁধলাম নীড়/ তবু বারবার সবুজ পাতার স্বপ্নেরা করে ভীড়। / তবু প্রত্যহ পীত অরণ্যে শেষ সূর্যের কণা , / মনের গহনে আনে বারবার রঙের প্রবঞ্চনা।”
কবি আহসান হাবীব তাঁর অর্থ শতাব্দীর অধিককালের
কবিজীবনে খুব বেশি কবিতা লেখেননি। কিন্তু পুনরাবৃত্তিহীন যে ৬-৭ টি মৌলিক কাব্যগ্রন্থ তিনি রচনা করে গেছেন, তা কালোতীর্ণ দার্শনিকতাখচিত এমন পঙক্তিমালায় সমৃদ্ধ —যা বহুকাল তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে ভাবিকালের পাঠকের মনে।
১৯৮৫ সালে তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে দৈনিক বাংলায় একটি শোক সভা হয়েছিল এবং একটি বিশেষ সংখ্যাও প্রকাশ করা হয়েছিল। সেখানে তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মী দৈনিক বাংলার প্রধান সম্পাদক কবি শামসুর রাহমানের স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল “যিনি ছিলেন তরুণের প্রতিযোগী।” সম্পাদক আহমেদ হুমায়ুনের প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল “নেই সেই নাগরিক আর”।
এই দুটি প্রবন্ধের শিরোনাম থেকেও আন্দাজ করা যায় কবি হিসেবে আহসান হাবীব কতটা আধুনিক এবং উন্নত রুচির নাগরিক ছিলেন, দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা তাঁকে মর্মে মর্মে চিনেছিলেন।
সত্যি সত্যিই তাঁর কবিতা ছিল তরুণদের কবিতার প্রতিদ্বন্দ্বী। এ ব্যাপারে তিনি খুব সচেতন ছিলেন। কখনো আমাকে কিংবা কবি আবিদ আনোয়ারকে নিউজপ্রিন্ট প্যাডে লেখা নতুন কবিতা ব্যাগ থেকে বের করে পড়তে দিয়ে বলতেন “দেখতো কেমন হয়েছে?”
আমরা বিব্রত হতাম। তিনি বলতেন, আরে তোমরাই তো আসল পাঠক। আগামী দিনের পাঠকের কাছে টিকে থাকতে হলে তোমাদের পছন্দ-অপছন্দ ম্যাটার করে। তরুণ কবিদের পছন্দ না হলে সেই কবিতা তো ক্ষীণায়ু।”
প্রথম কাব্যগ্রন্থের ১৫ বছর পরে ১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ “ছায়া হরিণ”। “সারা দুপুর” বেরিয়েছিল ১৯৬৪ সালে। এর দশ বছর পরে ১৯৭৪ সালে বেরিয়েছিল তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ”আশায় বসতি”। একটি কাব্যগ্রন্থ থেকে অন্য কাব্যগ্রন্থে যে দীর্ঘ সময় তিনি নিয়েছেন, তার মধ্যেই কবির প্রচার বিমুখতা এবং পুনরাবৃত্তিহীন লিখবার আকাঙ্ক্ষা এবং কাব্যরুচির পরিচয় পাওয়া যায়।
১৯৮০ সালে যখন তাঁর “দু হাতে দুই আদিম পাথর” প্রকাশিত হয় তখন সাড়া পড়ে যায় কাবাঙ্গনে। ভাষা এবং বিষয়ে যে তিনি বয়সে প্রবীণ হয়েও কতটা বিবর্তিত এবং আধুনিক, তারই জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত এই কাব্যগ্রন্থটি। তাঁর বিখ্যাত কবিতা “আমি কোনো আগন্তুক নই” ওই কাব্যগ্রন্থেরই অন্তর্গত। এই কবিতারও প্রেক্ষাপট আছে, অনেকে জানেন না। আহসান হাবীব কাব্যরাজনীতির শিকার হয়েছিলেন বারবার। তাঁর ৬০ বছর পূর্তির একটা উৎসব হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কূট কৌশলে তা হতে দেয়া হয়নি। তিনি দুঃখ করে সময় অসময় নামের একটি কবিতায় লিখেছিলেন “সময় ফুরিয়ে গেছে বলে/ তোমরাই কাফন সদৃশ এক সাদা জামা দিয়েছে পরিয়ে”। কিন্তু তিনি যে সময়কে অতিক্রম করে অগ্রসর, সে কথা ওই কবিতাযই লিখেছিলেন। “নষ্ট হয়ে যাওয়ার শঙ্কা” তিনি ধরে রাখতে চেয়েছিলেন।
একজন কবিকে কেন জীবনের ওই পর্যায়ে এসে কসম করে বলতে হবে যে, “আমি কোন আগন্তুক নই, ভিনদেশী পথিক নই”! আহ কী গভীর দুঃখে তিনি লেখেন : …আমাকে বিশ্বাস করো, আমি কোনো আগন্তুক নই / দুপাশে ধানের ক্ষেত, সরুপথ / সামনে ধুধু নদীর কিনার / আমার অস্তিত্বের গাঁথা।আমি এই / উধাও নদীর / মুগ্ধ অবোধ বালক”।
আহসান হাবীব আপাদমস্তক ছিলেন সমাজ সচেতন এমন এক কবি— যিনি সারাজীবন কলকাতা-ঢাকার মত আধুনিক নাগরিক জীবনে বসবাস করেও অস্তিত্বে ধারণ করেছেন আবহমান বাংলার গ্রামীণ মানুষের জীবনসংগ্রামের জীবন্ত বোধ। পলিমাটির সঙ্গে আমৃত্যু যুক্ত রেখেছিলেন চেতনা। যে কারণে তিনি লিখেছিলেন জমিলার মা’র শূন্য খাঁখা হাড়ি, শুকনো থালা আমাকে চেনে/ আমি তার স্বজন একজন…”।
কৃত্রিম নাগরিক যন্ত্রণা তাঁকে বিদ্ধ করতে পারেনি। বরং তিনি এই কৃত্রিমাতাকে বিদ্রুপ করেছেন বিভিন্ন কবিতায়, বারবার। গ্রামবাংলার ঐতিহ্য হৃদয়ে ধারণ করতেন বলেই তিনি কৃত্রিম নাগরিকতায় ক্লান্তদের বিদ্রুপ করেছেন। কুকুরের জন্মদিন পালন করছে যে শিকড়বিচ্ছিন্ন উচ্চবিত্ত, তাদেরকেও চপেটাঘাত করেছেন ব্যঙ্গ কবিতা লিখে। কৃত্রিম নিঃসঙ্গতার নাম দিয়েছেন তিনি অসুখ। “অসুখ” শিরোনামের কবিতাটির কিছুটা উদ্ধৃতি দিলে পাঠক উপলব্ধি করতে পারবেন তাঁর কবিতায় প্রতীকের কী চমৎকার ব্যবহার! বক্তব্য- প্রধান কবিতাও যে প্রতীকে কত সুন্দর হৃদয়গ্রাহী আর শৈল্পিক করে লেখা যায়, তারও দৃষ্টান্ত এই কবিতা :
“আমি বড় অসুখী। আমার আজন্ম অসুখ। না না / অসুখে আমার জন্ম। / এইসব মোহন বাক্যের জাল ফেলে / পৃথিবীর বালক-স্বভাব কিছু বয়স্ক চতুর জেলে/ মানব সাগরে/সম্প্রতি উদ্দাম হাতে নৌকা বায়/ আমরা
বিমূঢ়। / কয়েকটি যুবক এই অসুখ অসুখ দর্শনের
মিহিতারে /গেঁথে নিয়ে কয়েকটি যুবতী / হঠাৎ শৈশবে গেল ফিরে / এবং উন্মুক্ত মাঠে সভ্যতার কৃত্রিম ঢাকনায় / দুঃসাহস-আগুন জ্বালিয়ে / তারস্বরে কেবল চিৎকার করে : / আমরা বড় অস্থির। কী চাই / আমাদের কী চাই, কী চাই । / ওরা বলে সন্ত্রাসতাড়িত আমরা সন্ত্রাসিত/ পৃথিবীতে তাই / আমরা কেবল ছুটি— বলে আর উর্দ্ধশ্বাসে ছোটে। ….
কবিতার শেষ স্তবকটি পড়লে আরো স্পষ্ট হয়ে যায় তিনি সমাজ এবং সমকালীন বাস্তবতা বিষয়ে কতটা সচেতন ছিলেন এবং তাঁর দার্শনিক উপলব্ধি কোন মাত্রার!
” ভেসে ভেসে ডুবে যাওয়া একমাত্র সত্য পৃথিবীতে/ সত্যের সজ্জিত বৃদ্ধ গাধাটাকে ডুবিয়ে আমরাও/ কিছুকাল মত্ত হাতে নৌকা বেয়ে / জোয়ারের জলে ভেসে যাব।”
আহসান হাবীব গুরুতর বক্তব্যধর্মী কবিতাকেও গভীর প্রতীকী ব্যঞ্জনায় চিত্রকল্পে উদ্ভাসিত করেছেন— যা সমকালের তরুণ কবির পক্ষেও বিস্ময়ের। তাঁর দুহাতে দুই আদিম পাথর কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতা মার্শাল ল কবলিত বাংলাদেশের যে ছবি তুলে এনেছে তা যেমন সমকালীন, চিরকালীনও বটে। কবিতায় অন্ত্যমিল ব্যবহার করেও কতটা সমকালীন এবং আধুনিক থাকা যায়, তারও জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত ওই কবিতাটি। কবিতার শুরু হয়েছে একটি ভয়াল প্রতিকী চিত্রকল্পে : “এখন অসুখী কোন বালকের কাছে নীল প্রজাপতি নেই / ফুলমতির ময়াজালে মাছ নেই, চুপচাপ বসে থেকে এই / পৃথিবীর ছায়া দেখে, ছায়ার ভেতরে দেখে মুন্ডুহীন পাখির উড়াল / বৃক্ষের সভায় দেখে কেবলই ফুরিয়ে যায় পাখিদের কাল। / পাখিহীন সব শাখা কী গভীর দুঃখে লীন, নত হয়ে আছে / নদী কী নিশ্চল, দেখো সব নদী স্তব্ধতার কাছে / কিরকম নতজানু….( উল্টাপাল্টা এইসব। /দুহাতে দুই আদি পাথর) না, উদ্ধৃতি প্রলম্বিত করার প্রয়োজন নেই।” মুন্ডুহীন পাখির উড়াল” এর মত ভয়াবহ চিত্রকল্প থেকে বহু মাত্রিক অর্থ উদ্ধার সম্ভব, যা ভয়াবহ সমকাল ছাড়িয়ে চিরকালের নৈরাজ্যের সঙ্গেও মিলে যায়।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে অনেক কবিতা লেখা হয়েছে, কিন্তু আহসান হাবীবের “খোকন” শিরোনামের
একটি কবিতা আছে— যা পড়ে বিস্মিত হতে হয়েছি। এমন গণমুখী একটি বিষয়কেও প্রতীকের আশ্রয়ে এমন শিল্পসফল করে তোলা যায়, ওই কবিতা না পড়লে বোঝানো অসম্ভব।
কবিতার বিষয়বস্তু হচ্ছে একটি কিশোর ছেলে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সে বদলে যায়। বাবার প্রিয় সন্তান বাবা হঠাৎ বদলে যাওয়া তাকে আর চিনতে পারেন না, অন্যরকম হয়ে গেছে সে, গোপনে সে মুক্তিযুদ্ধের কাজ করছে। ভীত সন্ত্রস্ত বাবা তাকে আগলে রাখতে চায়। কিন্তু খোকন বলে “… তুমি আর হাতের আড়ালে রেখো না আমার হাত/… অন্ধকার ছড়িয়ে রেখো না/আমার দু চোখে পিতা/তোমার চারপাশে বড় অন্ধকার, তাই / সামনে যাব / আরো সামনে / সূর্যোদয়ে যাব। / তখন বয়স্ক কোনো পিতার কণ্ঠস্বরে খোকা বলে— মৃত্যুই জীবন…”(আমার সন্তান)।
কবি আহসান হাবীব মধ্যবিত্ত জীবনের টানা পড়েনের এমন অসামান্য সব চিত্র তাঁর কবিতায় এঁকেছেন যা বিস্ময় জাগায়। তার অনেক কবিতায় গল্পের আমেজ আছে। একটি কবিতায় আছে যে খোকনের পেশাবে ভেজা দাগে আকীর্ণ বিছানার উপর একটি চাদর দিয়ে তা ঢেকে রেখে বন্ধুকে বসতে দেয়া হয়েছিল। কবি ওই কবিতায় বলছেন আসলে চাদর উল্টালেই বেরিয়ে পড়তো মধ্যবিত্তের কঠিন সীমাবদ্ধতা। থাকো মধ্যম সারিতে একটি দৃষ্টান্তযোগ্য কবিতা। এছাড়া অনেক কবিতার কথা উল্লেখ করা যায়, যেখানে মধ্যবিত্ত জীবনের নানা সংকট গভীর জীবনবোধে উৎকীর্ণ।
তাঁর “প্রেমের কবিতা” প্রকাশিত হয়েছিল (১৯৮২)যখন তাঁর বয়স ষাট অতিক্রান্ত। প্রথম যৌবনে লেখা প্রেমের কবিতাও তিনি কোন বইতে ব্যবহার করেননি এমনকি মধ্যবয়স থেকে শেষ জীবন পর্যন্ত যেসব প্রেমেরকবিতা তিনি লিখেছেন তাও এর আগে প্রকাশিত হয়নি। অসীম সাহার উদ্যোগে আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ আর রফিক আজাদের প্রেমের কবিতার চারটি বই মোস্তফা জব্বারের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আনন্দ প্রেমের কবিতার প্যাকেট প্রকাশ করেছিল।
কবি আহসান হাবীবের এই কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গ পত্র পড়লে চমকে উঠবেন পাঠক। কলকাতার শ্রীমতি সুলেখা বন্দ্যোপাধ্যায় নামের এক ভদ্রমহিলাকে এই বইটি উৎসর্গ করতে গিয়ে তিনি তাঁর র কৈশোর থেকে জীবনের নানা যে কজন নারীকে উপলব্ধি করেছেন সবার নাম এক আশ্চর্য চিঠিতে উৎসর্গ করেছেন ঐ উৎসর্গপত্রে। ওই উৎসর্গ পত্রের শেষাংশ ছিল এমন —আসলে কি জানেন এই উৎসর্গ- ফুৎসর্গে আমার যাওয়াই উচিত হয়নি।
প্রেমের কবিতার কয়েকটি চরণ উদ্ধৃত করলে বোঝা যায়— কী সহজ অথচ ব্যঞ্জনময় তাঁর উচ্চারণ : আমার একটাই গন্তব্য ছিল, তুমি / তোমারও গন্তব্য আছে, তাই/ বারবার তোমাকে হারাই। দোতলার ল্যান্ডিংয়ে মুখোমুখি কবিতাটা পড়লে একালের তরুণতরণীরাও চমকে উঠবেন —কবি হিসেবে আহসান হাবীব কী আশ্চর্য রোমান্টিক আর আধুনিক ছিলেন!
কবির জীবনের শেষ কাব্যগ্রন্থ বিদীর্ণ দর্পণের মুখ বেরিয়েছিল মৃত্যুর কয়েক মাস আগে ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। মৃত্যুচিন্তাসহ গভীর দার্শনিকতায় উজ্জ্বল সেই কাব্যগ্রন্থ। ওই কাব্যগ্রন্থকে কেন্দ্র করে আবদুল মান্নান সৈয়দ সংবাদের সাময়িকী পাতায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন “ভিন্ন পাটাতনের কবি আহসান হাবীব শিরোনামে। কোন একটা কারণে দীর্ঘদিন আব্দুল মান্নান সৈয়দ দৈনিক বাংলায় লেখেননি এবং হাবিব ভাইয়ের উপর বিরূপ ছিলেন। একদিন আমার সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে আমিই বললাম মান্নান ভাই দেখেন কি অসামান্য কবিতাগুলো। বিদীর্ণ দর্পণে মুখ হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখলেন কিছু কবিতা পড়লেন। বললেন আমি হাবীব ভাইয়ের উপর একটা লেখা লিখব। তখন হাবিব ভাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ শয্যায়। বৃহস্পতিবার সাংবাদিক বের হওয়ার পর হাসপাতালেই আমি পড়ে শুনিয়েছিলাম। আবেগ বিহ্বল হয়ে কবি বললেন , নাসির শেষ পর্যন্ত
মান্নান আমার কবিতা নিয়ে লিখল, কিন্তু বড় দেরি হয়ে গেল। এর দুই বা তিনদিন পরে তিনি মারা গেলেন।
আহসান হাবীব’র শিশুসাহিত্য আমাদের শিশুদের জন্য এক উজ্জ্বল মূল্যবান সম্পদ। বিশ্ব সাহিত্যের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রচনা তিনি অনুবাদও করেছেন শিশুদের জন্য। শাহেদ সোহরাওয়ার্দীসহ বেশ কয়েকজন বিদেশি ভাষার কবির কবিতাও তিনি অনুবাদ করেছিলেন, স্বল্প পরিসরে যা আলোচনা করা গেল না।
আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে আজ কবি আহসান হাবীব নেই কিন্ত জীবন্ত তিনি এখনো সেই আমাদের চেতনায় —যারা তাঁর মহান ব্যক্তিত্বের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে যাবার সুযোগ পেয়েছিলাম, তাঁর চির আধুনিক রুচিশীল জীবন কাছ থেকে দেখেছিলাম,কবিতা পড়েছিলাম এবং এখনো পড়ছি। প্রত্যক্ষ করেছিলাম তার অসামান্য সাহিত্য সম্পাদনার প্রজ্ঞা আর কলাকৌশল।
দেখেছিলাম অর্থনৈতিকভাবে মধ্যবিত্ত জীবনের টানা পড়েনের জীবনযাপন করেও একজন মানুষ কতখানি আধুনিক এবং পরিশীলিত উন্নত রুচির পরিচয় দিতে পারেন।
তরুণ কবিদের বলি, আহসান হাবীবকে জানতে হবে, পড়তে হবে। কারণ চল্লিশের এই মহান কবি বিভাগোত্তর কালের আমাদের কবিতায় নব্য আধুনিকতার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করছিলেন। তিনিই প্রথম মুসলিম আধুনিক কবি জিনিস সত্যিকারের আধুনিকতার পথ রচনা করেছিলেন বিভাগ পূর্বকালের বাংলা কবিতায়। এই পূর্ববঙ্গের কবিতার অনেক কিছুরই তিনি পথিকৃৎ। আল মাহমুদ সৈয়দ শামসুল হক সহ যাঁরা আঞ্চলিক ভাষার কবিতা লিখে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন, কবিতায় আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করেছেন, তাদেরও পথিকৃত্তি নেই। তাঁর “হক নাম ভরসা” এবং “সহি জঙ্গলনামা” আঞ্চলিক ভাষার কবিতার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। তাঁকে পড়ার মধ্য দিয়েই আমরা শোধ করতে পারি সেই ঋণ।
কবির সম্মাননা ও স্বীকৃতি: বাংলা ভাষা সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ১৯৬১ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৭৮ সালে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক এবং ১৯৯৪ সালে মরণোত্তর সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন আহসান হাবীব।
কবির গ্রন্থ বিষয়ে কিছু তথ্য : আহসান হাবীবের কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, ছোটদের ছড়া ও কবিতার বই মিলিয়ে মোট গ্রন্থ সংখ্যা ২৫টি।
কাব্যগ্রন্থ : রাত্রিশেষ (১৯৪৭)ছায়াহরিণ (১৯৬২)
•সারা দুপুর (১৯৬৪) আশায় বসতি (১৯৭৪)মেঘ বলে চৈত্রে যাবো (১৯৭৬) দু’হাতে দুই আদিম পাথর (১৯৮০) প্রেমের কবিতা (১৯৮২) বিদীর্ণ দর্পণে মুখ (১৯৮৫)।উপন্যাস :আরণ্য নীলিমা (১৯৬২) রানীখালের সাঁকো ( ১৯৬৫), জাফরানী রং পায়রা। •শিশু সাহিত্য :জোছনা রাতের গল্প, ছুটির দিন দুপুরে বিষ্টিপড়ে টাপুর টুপুর, ইত্যাদি।