সোমবার, জানুয়ারি ৬, ২০২৫
Homeঅন্যান্যগুনারীতলা গ্রামের প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে মিশে থাকা একটি নাম কাজিমুদ্দিন...

গুনারীতলা গ্রামের প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে মিশে থাকা একটি নাম কাজিমুদ্দিন যিনি কাজী ঘাটিয়াল নামে সুপরিচিত

সম্পাদক, বার্তা বাংলাদেশ ২৪ ডটকম

গুনারীতলা গ্রামের উত্তর পাড়ার কাজিমুদ্দিন সাহেব যিনি কাজী ঘাটিয়াল নামেই সকলের কাছে সুপরিচিত। তিনি বৃটিশ আমলের একজন পরিচিত মুখ। অত্র এলাকায় তার যথেষ্ট নাম ডাক ছিল এখনও আছে।

যে বিশেষ কারণে কাজী সাহেব সকলের কাছে পরিচিত মুখ ছিলেন তা হলো তৎকালীন সময়ে বৃটিশ শাসনামলে গুনারীতলা ইউনিয়নটা ছিল যথেষ্ট উন্নত এবং উন্নয়নশীল। অত্র এলাকায় স্রোতস্বিনী নদীটির ধারে বানিজ্যিক বন্দর ছিল। বড় বড় দেশি বিদেশী জাহাজ এসে ভীড়তো জাগ্রত গুনারীতলার এই বন্দরে।

স্রোতস্বিনী নদীটির নাম ঝারকাটা নদী। নদীটি এখন আর আগের মত নেই। আশির দশকেও নদীটির বুকজুড়ে প্রবল ঢেউ ছিল অতল পানি ছিল যার এখন আর কিছুই নেই। ভরা বর্ষায় মৌসুমেও নদীর বোকে স্রোত থাকেনা। একান্ত স্থবির মোক আর শুন্য দেহ নিয়ে প্রাচ্যের স্বাক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চঞ্চলহীনতায় ঝারকাটা নদী।

ঝারকাটা নদীটি বাংলাদেশের উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ২০ কিলোমিটার। গড় প্রস্থ ১৩২ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। নদীটির উৎস ঝিনাই নদী থেকে এবং এর মোহনা ব্রহ্মপুত্র নদীর ধারে।

ঝারকাটা নদীটিতে বৃটিশামলে পারাপারের যে ফেরিঘাট ছিল সে ঘাটের মালিক ছিলেন কাজী সাহেব যিনি কাজী ঘাটিয়াল নামেই সুপরিচিত। আর সেকারণে কাজী সাহেবকে কাজী ঘাটিয়াল আঞ্চলিক ভাষায় কাজী ঘাইটেল নামে পুরো মাদারগঞ্জের সকলের কাছেই ছিলেন পরিচিত মুখ।

সেকালে পারাপারের ফেরিঘাট বরাবর নদীর ওপারে ছিল গুনারীতলা বানিজ্যিক বন্দর ও প্রসিদ্ধ হাট বাজার। বহু দুর দুরান্ত থেকে বনিক ব্যবসায়ী সাধারণ মানুষ হাট বাজার করতে আসতো। তৎকালীন সময়ে হিন্দু মারোয়ারীদের জমজমাট ব্যবসা ছিল।

গুনারীতলা গ্রামে ইংরেজরা নীল চাষ করতো। সেকারণে আজকের গুনারীতলা আর সেকালের গুনারীতলার মাঝে ঐতিহাসিক ভাবে ব্যপক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।

শুনেছি ঢাকা থেকে ব্যবসায়ীগণ সেকালে এই বন্দরে এসে মালামাল ক্রয় করে নিয়ে যেতো। কারণ তৎকালীন সময়ে বানিজ্যের একমাত্র পথ ছিল নদী পথ আর নদীটির শেষ প্রান্ত এখানে এসে থেমে গিয়েছিল। আরেকটা বন্দর ছিল সরিষাবাড়িতে। সেখানেও জমজমাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল।

সেকালে নদীর একোল ভাংতো ওকোল গড়তো। হায়রে নদীর খেলা। কোন একদিন প্রবল স্রোত শুরু হয়েছি ভাংগন। রাজা মানেনি প্রজা মানেনি প্রবল ভাংগনের কাছে সেদিন হার মেনেছিল জমিদারের শাসন শোষণ ক্ষমতা। সেদিন সেই ভাংগনে নদীর বোকে বিলিন হয়ে গিয়েছিল বন্দরের সকল স্থাপনা। পুরো ঐতিহ্যবাহী গুনারীতলা হাট বাজার বাজার, সকল বিনোদন কেন্দ্রগুলো।

সেদিনের সেই ভাঙানে পুরো গ্রামবাসীর জীবনে নেমে এসেছিল ঘোর অন্ধকার। তসনস হয়ে গিয়েছিল মানুষের জীবনে চলার পথ। এলাকার লোকজন যার যা কিছু ছিল গরু ছাগলসহ সব ধরনের জিনিসপত্র নিয়ে যে যেখানে একটু উচু যায়গা পেয়েছিল সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। নদী ভাঙার কারনে ঐতিহ্যবাহী গুনারীতলা গ্রামটি গরীব এলাকায় পরিনত হয়েছিল। যার ধারাবাহিকতায় আজও আমরা সেই পুরোনো ঐতিহ্যতো গড়তে পারি নাই এমনকি পরবর্তী গুনীজনরা যতটুকুও অর্জন করেছিলেন তাও হারাতে বসেছি।

যার কথা বলছিলাম। কাজী ঘাটিয়াল, কাজী ঘাটিয়ালের বিশাল বড় ফেরিঘাট ছিল। তার ফেরিঘাট দিয়ে দেশের নানা ধরনের বড় বড় ব্যাবসায়ী লোকজন, সাধারণ জনগণ সর্বদাই চলাচল করতো এবং তাদের সাথে কাজী ঘাটিয়ালের সম্পর্কও ছিল গভীর।

বৃহত্তর ময়মনসিংহের যত নামীদামী লোকজন ছিলেন তাদের সকলের সাথেও ছিল কাজি ঘাটিয়ালের সু-সম্পর্ক। আশেক মাহমুদ তালুকদার সাহেবের সাথেও কাজি ঘাটিয়াল সাহেবের যথেষ্ট সুসম্পর্ক ছিল। শুনেছি এক সময় কাজী ঘাটিয়ালের এই ঘাট দিয়ে একেএম ফজলুল হক নদী পার হয়েছিলেন।

কাজী ঘাটিয়াল একজন মাবিক মনা মানুষ ছিলেন। তিনি মেহমানদারি করতে ভালো বাসতেন। বিশিষ্ট ব্যবসায়ীগণ প্রায় সময়ই কাজী ঘাটিয়ালের বাড়িতে খানা খাইতেন।

অনেক অর্থ বিত্তেরও মালিক ছিলেন তিনি। হতদরিদ্র মানুষের প্রতিও ছিল তার গভীর মমত্তবোধ ও অকৃতিম আন্তরিকতা। যে কোন লোক সাহায্যের জন্য কাজী ঘাটিয়াল এর কাছে এলে কখনই খালি হাতে ফিরে যেতেন না।

জনাব কাজী ঘাঁটিয়াল সাহেবের বড় বড় অনেকগুলো নৌকা ছিল। মাদারগঞ্জ উপজেলা সহ জামালপুর জেলার বিভিন্ন জায়গায় তার নৌকা দিয়েই পারাপার হতে হয়েছে। সেকালে যাতায়াত ব্যবস্থার একমাত্র মাধ্যমই ছিল নৌকা।

সেই সময় নৌকার ভাড়াও ছিল কম। এক আনা দুই আনা এর বেশি নয়। আর সেই সময় টাকার অনেক মূল্য ছিল। এক টাকা দিয়ে বেগ ভর্তি বাজার করেও এক টাকা ফুরাতোনা।

কাজি সাহেব একজন নামকরা কবিরাজও ছিলেন। ব্যক্তি হিসেবে ছিলেন উদার মনের মানুষ। যারা অর্থ অভাবে লেখা পড়া করতে অক্ষর ছিল তাদের লেখা পড়ার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন কাজী সাহেব। এবং তাদেরকে মানুষের মতো মানুষ করে চাকরি পর্যন্ত নিয়ে তিনি দিয়েছিলেন।

অনেক নাম করা লোক ছিল কাজী ঘাটিয়াল নামে খ্যাত কাজী সাহেব। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে তিনি অনেক সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। পাক বাহিনীরা যখন তার নৌকায়য় ভীড়ে মাদারগঞ্জ এলাকার পথ জানতে চাইতো তিনি সঠিক পথ না দেখিয়ে উলটো পথ দেখিয়ে দিতেন এবং তার পারাপারের নৌকা নদীতে ডুবিয়ে রাখতেন।

কাজি ঘাটিয়ালের চার ছেলের মধ্যে বড় ছেলে আজিজুল হক তৎকালীন সময়ে ময়মনসিংহের একজন ঠিকাদারের সাথে যৌথভাবে ঠিকাদারি করতেন। সেকালে মাদারগন্জ উপজেলা হাসপাতালের সকল কাজ তাদের হাতে হয়েছে। কিন্তু ময়মনসিংহের সেই ঠিকাদার ছিলেন বড়ই চতুর। চতুরতা দেখিয়ে ঠিকাদারির সমস্ত টাকা মেরে নিয়ে চলে যান ময়মনসিংহে। আর দেখা দেননি কখনওই। অনেক চেষ্টা করেও তার সন্ধান পায়নি তারা।

উক্ত ঘটনার স্বীকার হয়ে কাজী সাহেব শেষ জীবনে সেই কষ্টে কাতর হয়ে বিছানায় পড়েন।

কাজী ঘাটিয়াল বিয়ে করেছে ধলির বন্ধ গ্রামে। তার একটা মেয়ে এখনও বেঁচে আছেন। নাম বেগম। তার ৪ ছেলে একজনও বেঁচে নেই। আজিজল হক, নাজি, ফজল, গিয়েস।

সেকালে কলেরা রোগের ব্যপক প্রাদুর্ভাব হয়েছিল। তার ছেলেগুলো কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়। সেই সময় ডাক্তারের বড়ই অভাব ছিল। চিকিৎসার অভাবে কলেরার মত ভয়ংকর ব্যধিতে ভোগতে ভোগতে পরপর চার ছেলেই মারা যায়।

চার ছেলের মৃত্যুর যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে জনাব কাজী ঘাটিয়াল কিছুদিন পর ইহধাম ত্যাগ করেন।

তথ্য সহযোগী: মো মোস্তাকিম বিল্লাহ

- Advertisement -spot_img
আরও সংবাদ
- Advertisement -spot_img
এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here