সোমবার, জানুয়ারি ৬, ২০২৫
Homeঅন্যান্যসৌন্দর্যের জামালপুর

সৌন্দর্যের জামালপুর

ভ্রমন পিপাসু কোন একজন

পেশাগত কারণে প্রায়ই ছুটে বেড়াতে হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, বিশেষ করে মফস্বল শহরগুলোতে। সরকারি ছুটি প্লাস উইকএন্ডের লম্বা সময়টিতে জামালপুর ঘুরতে যাওয়ার ডাক যখন পেলাম ইউনিভার্সিটির বন্ধু আরজুর কাছ থেকে, প্রথমে একটু দ্বিধার মধ্যেই পড়ে গিয়েছিলাম। মফস্বল শহর! তারপর মনে হলো কেন নয়? প্রায় পাঁচ বছর আগে একবার জামালপুরে গিয়েছিলাম অফিসের কাজেই; কিন্তু শহর বা তার আশপাশ তেমনটা ঘুরে দেখা হয়নি। কাজ সেরে পরের দিনই ঢাকা ফিরে এসেছিলাম।

সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ (১৭৬০-১৮০০), হাতিখেদা বিদ্রোহ (১৭৭০-১৭৭৫) এবং পাগলপন্থী বিদ্রোহের (১৮২৫-১৮২৭) মতো আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু যে জামালপুর তা ঘুরেফিরে দেখার আগ্রহটা কিন্তু এই বেড়ানোর আগ পর্যন্ত মাথার ভেতর ঠিকই ঘুরপাক খাচ্ছিল। তারমধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জামালপুরে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের বিরোচিত লড়াই যা ‘কামালপুরের যুদ্ধ’ নামে খ্যাত সেই কামালপুরের মাটি ছুঁয়ে দেখার একটি তীব্র ইচ্ছাও ছিল। তাই বন্ধু আরজুর ডাক পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তৈরি হলাম জামালপুর যাব বলে। তৈরি হয়ে গেল সাবেক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের ছোট একটি দল। আমরা ঠিক করলাম এবারের জার্নি হবে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে। দীর্ঘ বন্ধের কারণে রেলে টিকিট পাওয়া কঠিন। তবে সেটি ম্যানেজ হয়ে গেল রেলের সাবেক কর্মকর্তা আমাদেরই বিশ্ববিদ্যালয়ের জুনিয়র ভাই রোকনের বদৌলতে। যারা শিরোনাম দেখে ভাবছেন, ভাই, ঘুরতে গেলেন জামালপুর আর লিখেছেন সন্ন্যাসীগঞ্জ, ব্যাপারটা কী? তাদের উদ্দেশে বলছি, জামালপুরের পুরনো নাম সিংহজানী। এরপর এই এলাকা সন্ন্যাসীগঞ্জ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। এর সঙ্গে হয়তো সন্ন্যাসী বিদ্রোহের একটি যোগাযোগ আছে। তাই হয়তো এই নামের স্মৃতি বয়ে বেরাচ্ছে শহরের আশপাশেই থাকা সন্ন্যাসীর চর বা সন্ন্যাসীর ভিটা নামের এলাকাগুলো। সন্ন্যাসী বিদ্রোহের অবসানের প্রায় ৪৫ বছর পর ১৮৪৫ সালে জামালপুরের আবির্ভাব ঘটে প্রশাসনিক মহুকুমা হিসেবে। জামালপুর নামটি আবার করা হয়েছে সুফি হযরত শাহ জামাল (র.) স্মৃতিকে ধরে রাখার উদ্দেশ্যে। প্রচলিত রয়েছে এই সুফি ২০০ অনুসারীসহ ইয়েমেন থেকে এদেশে এসেছিলেন সম্রাট আকবরের শাসন আমলে। উদ্দেশ্য ধর্মপ্রচার। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তিনি আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ব্রহ্মপুত্রের কোল ঘেঁষে সিংহজানী মৌজাতে তার ডেরা তৈরি হয়। ১৯৭৮ সালে জামালপুর আবির্ভূত হয় জেলা হিসেবে।

ব্রহ্মপুত্রের কোলের শহর জামালপুর
হোটেলে দ্রুত ‘চেকইন’ করার পর আমরা বেরিয়ে গেলাম জামালপুর শহরটা দেখতে। শহরের মূল রাস্তা একটিই। সেই রাস্তা ঘিরেই অফিস-আদালত-দোকানপাট। সে কারণে শহরটার আকার অনেকটা লম্বাটে। রাস্তার একদিকে শহর আর অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্র নদ। নদ অবশ্য পানিতে ভরে ওঠে শুধু বর্ষার সময়ই।

অন্য আর দশটি মফস্বল শহরের মতো জামালপুরের রাস্তাও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার দখলে। আমরা একটি অটোরিকশায় উঠে পড়লাম। গন্তব্য সার্কিট হাউস। পথে থামলাম ‘তামান্না রেস্টুরেন্ট’ এ দুপুরের খাবার খেতে। রেস্টুরেন্টটির বড় বৈশিষ্ট্য হলো এটি অবস্থান করছে একটি নব্বই বছরের পুরনো বিল্ডিংয়ের নিচতলায়। ঢুকেই মনটা ভালো হয়ে গেল এর খোলামেলা পরিবেশের জন্য। রেস্টুরেন্টটির সামনে একটি ছোট্ট বাজার। বন্ধু আরজু জানালো সকালবেলা এখানে টাটকা সবজির বাজার বসে। সেই বাজারেই দেখি গরুর দুধের চা পাওয়া যাচ্ছে। দুপুরের খাবারের পর এই চায়ের চাইতে ভালো আর কী হতে পারে। সঙ্গে জুটে গেল মচমচে জিলাপি। একটু এগিয়ে সামনে দেখি একটি লম্বা কংক্রিটের ব্রিজ ব্রহ্মপুত্রের মধ্যে ঢুকে গেছে। ব্রিজের শেষ প্রান্তটা খোলা। দেখে মনে হয় যেন একটি জেটি। অপেক্ষা করছে কোনো জাহাজের জন্য। জানা গেল যে ব্রিজটি তৈরি শুরু হয়েছিল নদের ওপারের একটি গ্রামকে যুক্ত করার জন্য। কাজ শেষ হওয়ার আগেই সেই গ্রাম ভেঙে যায় নদের স্রোতের তোড়ে। এখন এখানে ঘুরতে আসে শহরের মানুষজন। নদের পাড়ের বিশুদ্ধ শীতল হাওয়ায় তাদের প্রাণ জুড়ায়। আমরা হেঁটে গেলাম ব্রিজের মাথা পর্যন্ত। দিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশ, কোথাও কোথাও কালো মেঘের দখল। একটু দূরে চরের মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে টিনের ঘরবাড়ি। ব্রিজের নিচে খালের মতো পানির স্রোত। তারই ধারে মাটির ওপর পড়ে আছে কিছু নৌকা। যেন অপেক্ষা করছে কখন বর্ষা আসবে, কখন যৌবন ফিরে পাবে ব্রহ্মপুত্র। মন ভালো করা এই পরিবেশে কিছু সময় কাটিয়ে আমরা হাঁটতে থাকলাম নদের পাড়ের ফুটপাত দিয়ে। এই পথটিও সবুজে ভরা। সারি সারি জাম গাছ, সারি সারি সুপারি গাছ। মিনিট দশেক হাঁটার পর আমরা পৌঁছে গেলাম সার্কিট হাউসে।

সুলতানগরের সুখদুঃখ-বাংলাদেশেরই প্রতিচ্ছবি
সার্কিট হাউস থেকে বেরিয়ে আমরা রওনা হলাম বন্ধু আরজুর গ্রামের বাড়ি সুলতাননগরের উদ্দেশ্যে। অটো, সিএনজি, তারপর রিকশা-ভ্যানে করে প্রায় ৪৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম সুলতাননগর গ্রামে। অসাধারণ সুন্দর এই গ্রামের চারদিকে বিল। পুরো গ্রামটি গাছগাছালিতে ভরা। কয়েক বছর আগে গ্রামে ঢোকার রাস্তাটি পাকা হয়েছে। গ্রামে ঢুকেই নতুন ধানের গন্ধ পাওয়া গেল। ধান কাটামারি চলছে। বাতাসে তারই গন্ধ ম-ম করছে। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে পালা করা ধানের স্তূপ। কোথাও ধান সিদ্ধ হচ্ছে, কোথাও ধান শুকানো হচ্ছে। আবার কোথাও ধান মাড়াই হচ্ছে মেশিনে। কোথাও দেখলাম কুলায় করে ধান উড়ানো হচ্ছে পাতান থেকে ধান আলাদা করার জন্য। সবার মুখে সুখের হাসি। ফসল ঘরে তোলার নির্মল সুখ। দেখে মনের অজান্তেই গেয়ে উঠতে ইচ্ছা করে, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।’ সবচেয়ে ব্যস্ত দেখলাম নারীদের। কেউ বসে নেই, কিছু না কিছু করছেই। অথচ কৃষিতে এই নারীদের অবদানের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি আমরা এখনো দিতে শিখিনি। একটু পরেই আমাদের পেছনে জড়ো হলো গোট দশেক উৎসুক বাচ্চা ছেলেমেয়ে। মুহূর্তেই ওদের সঙ্গে খাতির হয়ে গেল। জানলাম, সবাই স্কুলে যায়, কেউ কেউ স্থানীয় মাদ্রাসায় পড়ে। আমাদের আরজু যেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা- ওর পেছনে পেছনে পুরো সময় ছুটল এই বাচ্চাদের দল। আমরা আমাদের ক্যামেরায় ধরে রাখতে চাইলাম এদের হাসিমাখা মুখ। এরাই তো আমাদের ভবিষ্যৎ।

শেষ বিকেলে আমরা চলে গেলাম বিলের পাড়ে। বিলের স্থানীয় নাম ‘বামুনজি’। বিলের ধারে ধানক্ষেত। কোনো কোনো ক্ষেতে সবে ধান কাটা হয়েছে। মোথায় ভরা ন্যাড়া মাঠগুলো সেই সাক্ষ্য বহন করছে। অনেক ক্ষেতেই ধান পাকা শুরু হয়ে গেছে। পাকা ধানের সোনালি আভা আর সবুজের সম্মিলনে নতুন এক ঘোরলাগা রঙ তৈরি হয়েছে। দেখলাম নৌকায় করে মানুষজন বিল পাড়ি দিচ্ছে নিজের ঘরে পৌঁছবে বলে। নৌকায় করে জাল বিছিয়ে মাছ ধরছে কিছু মানুষ। একদল হাঁস লাইন ধরে রওনা দিয়েছে গৃহস্তের ঘরে ফিরবে বলে। সূর্যাস্তটা আমরা উপভোগ করলাম বিলের ধারে। ক্লান্ত লাল সূর্য টুপ করে ডুবে গেল বিলের জলে নানা রঙের আভা তৈরি করে। বাংলাদেশের একটি পরিপূর্ণ সুখী গ্রামের চিত্র পেলাম সুলতাননগরে এসে।

আমরা যখন গ্রামের রাস্তা দিয়ে ঘুরছি, অনেক মুরুব্বি এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন, ‘তোমরা কারা বাবা? কোনখান থাইকা আইছ? সরকারি লোক নাকি?’ আমাদের দলের তিনজনার হাতে ডিএসএলআর ক্যামেরা, যা পাচ্ছি তারই ছবি তুলছি। আমরা যখন জানালাম যে আমরা আরজুর বন্ধু, এসেছি গ্রামটা ঘুরে দেখতে, তখন প্রত্যেকের মুখেই স্বস্তি লক্ষ্য করলাম। আরজুর কাছে যখন জানতে চাইলাম কেন সবাই আমাদের সরকারি লোক ভাবছে, তখন শুনলাম আরেক গল্প। সুলতানগরের দুঃখের গল্প। গ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে পাকা রাস্তা ঘিরে সরকার পরিকল্পনা করেছে ‘ইকোনমিক জোন’ করার। এ জন্য ওই এলাকার জমি অধিগ্রহণ চলছে। বিলসংলগ্ন ৯০ একর খাসজমি ইতিমধ্যেই প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ২২৭ একর বিলটির এখন অবশিষ্ট আছে ১৩৭ একর। গ্রামবাসীদের এ নিয়েও তেমন কোনো আপত্তি নেই; কিন্তু ঠিকাদার সংস্থা যেভাবে বিল থেকে বালু তোলার পরিকল্পনা করছে, তাতে ‘বামুনজি’ বিলের জীব-বৈচিত্র্যের বারোটা তো বাজবেই, এমনকি বিলের মধ্যে বিলীন হয়ে যেতে পারে আশপাশের পাঁচটি গ্রামের ঘরবাড়ি। গ্রামবাসীরা চান জমি ভরাটের বালু সংগ্রহ হোক অন্য কোথাও থেকে। এ নিয়ে তারা জেলা প্রশাসকসহ অনেকের কাছেই স্মারকলিপি দিয়েছেন, কিন্তু কোনো ফল পাচ্ছেন না। তারা সবাই নিজেদের গ্রামগুলোর বিপন্নতা নিয়ে চিন্তিত। কথা হচ্ছিল কয়েকজন গ্রামবাসীর সঙ্গে, তারা বলছিলেন, “আমরা তো এখন ভালোই আছি।

কৃষকদের গোলাভরা ধান আছে।
কৃষিশ্রমিকরা প্রতিদিন মজুরি পাচ্ছে ৫০০ টাকা। ‘বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা’ হলে আমাদের নতুন আর কি সুবিধা হবে?” দেশের এবং জামালপুর জেলার বৃহত্তর স্বার্থে তারপরও তারা এই প্রকল্পের বিরোধী নন। তারা শুধু চান বিলের যেন কোনো ক্ষতি না হয়। বিলের ওপর নানাভাবে নির্ভরশীল পাঁচ গ্রামের হাজার হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা, ঘরবাড়ি এবং জমিজমা যাতে কোনোভাবেই বিপর্যস্ত না হয়, সে জন্যই তারা চান যেন বিল থেকে বালু তোলা না হয়। ভাবছিলাম, এতো খুবই মৌলিক চাওয়া। গ্রামবাসীকে এসব চাইতে হবে কেন? যারা উন্নয়ন পরিকল্পনা করেছেন, তাদের মূল ভাবনাতেই তো এটি থাকার কথা। কবে যে স্থানীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় স্থানীয় জনগণের মতামত গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হবে?

সন্ধ্যা গড়িয়ে যখন রাত হলো, পরিষ্কার আকাশে তখন বড় একটি চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। আরজু তাদের বাড়ির উঠানে আমাদের জন্য পাটি বিছিয়ে দিল। আমরা সেখানে গা এলিয়ে খোলা আকাশের নিচে চাঁদ উপভোগ করছি। রাতে খাবারের আয়োজন হলো স্থানীয় বিভিন্ন আইটেম দিয়ে। খাবারের স্বাদে আমরা অভিভূত। আমাদের সফরসঙ্গী খাদ্যরসিক পুরান ঢাকার পোলা শাকিল বলল, স্বাদ তো হবেই, একে তো সব টাটকা জিনিস, তার ওপর আবার খড়ির চুলায় রান্না। আমরা পরিচিত হলাম, ‘ম্যান্দা’ নামের স্থানীয় এক খাবারের সঙ্গে। গরুর মাংসের সঙ্গে চালের গুড়া দিয়ে বানানো আইটেম। ঝোলটা অনেক ভারি। স্বাদটা অনেকটা হালিমের মতো, কিন্তু আবার হালিমও না। উত্তরাঞ্চলে গ্রাম্য মজলিসের মাংসের তরকারিতে আটা মেশাতে দেখেছি। এখানে দেখলাম মেশানো হয়েছে চালের গুঁড়া। রাতের খাবার সেরে যখন শহরে ফেরার জন্য রওনা দিলাম, আমাদের মুখে তখনো লেগে আছে ‘ম্যান্দা’র স্বাদ। ফেরার পথে দেখি বাজারে গ্রামবাসীদের বড় জমায়েত হচ্ছে। সবাই একত্রিত হয়ে আলোচনা করছে বিল রক্ষায় কি করা যায়। সমষ্টিগত এই প্রচেষ্টা দেখে ভালো লাগলো। আশা করি, প্রশাসনের বোধোদয় হবে। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় অন্ধকার দূর হবে। মনুষ্য-সৃষ্ট দুঃখের শিকার হতে হবে না সুলতাননগরবাসীদের। সুখী সুলতানপুরের সবাই সুখেই থাকবে সকলে মিলে।

মধুটিলায় গারো পাহাড়ের হাতছানি
পরের দিন সকালে আমরা বের হলাম শেরপুরের উদ্দেশ্যে। আগস্ট মাসের আলোকিত সকাল। ভাড়া মাইক্রোবাসে করে আমরা যখন পাকা রাস্তায় চলছি, চারদিকে তাকিয়ে মন ভালো হয়ে গেল। আমার কাছে ধানকাটার আগের বাংলাদেশের গ্রামবাংলার প্রকৃতি সবচেয়ে সুন্দর লাগে। মাঠগুলো সবুজ ধানক্ষেতে ভরা থাকে। হালকা পাতলা বৃষ্টি ধুয়ে সতেজ করে তোলে গাছগাছালি। আমাদের গাড়ি ছুটে চলল এরকম এক রাস্তা ধরেই। দু’ধারে ধানক্ষেত। কোনো কোনো ক্ষেতে ধান পাকা শুরু হয়েছে। ফলে সবুজের মাঝে যেন হালকা সোনালী রঙের তুলির টান দিয়ে রেখেছে কোনো চিত্রকর। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর আমরা পৌঁছালাম মধুটিলা ইকোপার্কে।

আমাদের ড্রাইভার জানালো যে, মধুটিলা ইকোপার্ক পিকনিক স্পট হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। পিকনিক সিজনে নাকি ভিড়ের কারণে এখানে ঢোকাই মুশকিল। এটি অবশ্য এখন আমাদের দেশের প্রায় সব পিকনিক স্পটের জন্যই প্রযোজ্য। গারো পাহাড়ের পাদদেশে ৩৮৩ একর আয়তনের এই পার্কের বড় আকর্ষণ হলো প্রকৃতির মাঝে নির্জনতা। সবুজের মাঝে নির্জনতা আর নিস্তব্ধতা উপভোগের চাইতে আনন্দের বিষয় আর কিই বা হতে পারে! যেন স্তব্ধতার গান শোনা। শেরপুরের নালিতাবাড়ি উপজেলার এই ইকোপার্কে কিন্তু ওষধি গাছের এক বিশাল সংগ্রহ রয়েছে। তাও আবার ২০ একর জায়গা জুড়ে। বাংলাদেশ বন বিভাগকেও ধন্যবাদ দিতে হয় সুন্দর ব্যবস্থাপনার জন্য। লেকটাও দেখলাম বেশ গুছানো। এমনকি লেকে নৌকাভ্রমণের ব্যবস্থা আছে। দেশি এবং পেডাল- দুই অপশনই আছে। তবে পিকনিকের সিজনে এখানকার পরিবেশ কেমন থাকে তা বলা কঠিন।

একটু ঘোরাঘুরি করতেই আমাদের নজরে পড়ল পার্কের মাঝে থাকা ওয়াচ টাওয়ার। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে খানিকটা কষ্ট হলো। সবাই দরদরে ঘামছিলাম; কিন্তু যখন টাওয়ারের উপর থেকে চারদিকে তাকালাম, কষ্টকে আর কষ্ট বলে মনে হলো না। দূরে গারো পাহাড়ের হাতছানি। চারদিকে সবুজ আর সবুজ। উপরে দূরের দৃশ্য দেখার জন্য দূরবীনের ব্যবস্থা আছে। টাকা দিয়ে সেগুলো ব্যবহার করা যায়। শুনলাম এই বনের একটি অংশ নাকি ভারত অংশেও বিস্তৃত। নিচে ঘোরাঘুরির সময় পুরো পার্কের বিস্তৃতি বোঝা যায় না। বোঝা যায় না সবুজের সমারোহটাও।

টাওয়ার থেকে নিচে নেমেই আমরা দেখা পেলাম এক ডাবওয়ালার। যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। সবাই অনেকটা ঝাঁপিয়েই পড়লাম তৃষ্ণা মেটাতে। পাশে পেলাম গরম গরম পিয়াজু। সঙ্গে মিললো চা। সব মিলিয়ে সকালের শেষভাগের চা বিরতিটা খারাপ হলো না। বের হবার পথে পার্কের উঁচু ঢাল বেয়ে ওঠার সিঁড়িতে বসে সদলবলে সময় কাটালাম। সময়টা ধরে রাখার জন্য তোলা হলো বেশকিছু গ্রুপ ছবি। পার্কে একটি গেস্ট হাউসও আছে। তবে সেখানে রাত কাটাতে হলে প্রশাসন থেকে অনুমতি নিতে হয়। এখানে পূর্ণিমার রাতে এসে থাকতে পারলে দারুণ একটি অভিজ্ঞতা হতো।

ভোগাই নদীর কোলঘেঁষা ছিমছাম নাকুগাঁও স্থলবন্দর মধুটিলা থেকে বেরিয়ে আমরা ছুটলাম নাকুগাঁও স্থলবন্দরের দিকে। শেরপুরে যে একটি স্থলবন্দর রয়েছে এবং তার সঙ্গে ইমিগ্রেশন চেকপোস্টও আছে তা আমার জানা ছিল না। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার এটি চালু করতে আগ্রহী হয়েছিল মূলত ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরির বিষয়টা মাথায় রেখে। এখন এবন্দর দিয়ে কয়লা আর পাথর আমদানি হয় আর সিমেন্ট রপ্তানি হয়। ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট দিয়ে মানুষ পারাপারের ব্যবস্থা থাকলেও খুব বেশি মানুষ এপথ দিয়ে যাতায়াত করে না।

এবন্দর দিয়ে যাতায়াত কিন্তু তুলনামূলকভাবে অনেক সহজ। ইমিগ্রেশনে ভিড় নাই। নাই দালালদের আধিপত্য। সীমান্ত পেরিয়ে তিন কিলোমিটার গেলেই বাস স্ট্যান্ড। সেখান থেকে বাসে করে সরাসরি যাওয়া যায় আসামের গৌহাটি বা পশ্চিম বঙ্গের শিলিগুড়ি। পূর্বদিকে গেলে গৌহাটি আর শিলং। আর পশ্চিমে গেলে শিলিগুড়ি। মিজোরাম, অরুণাচল এবং নাগাল্যান্ড যাওয়ার সহজ পথ উত্তরের মানুষের জন্য এটিই। তাছাড়া, গৌহাটিতে থাকা বিমানবন্দর ব্যবহার করে যাওয়া যায় ভারতের সব বড় শহরগুলোতেই। চিন্তা করুন, ঢাকা থেকে ৪/৫ ঘণ্টায় নাকুগাঁও। তারপরেই ভারত। তারপরও প্রচারের অভাবে অনেকটা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে নাকুগাঁও চেকপোস্ট। এই চেকপোস্ট দিয়ে সড়কপথে ভারতে ঢুকতে ভিসার আবেদনে উল্লেখ করতে হয় ‘বাই রোড ডালু’। ভারতের অংশে ‘ডালু’ হলো এই চেকপোস্টের নাম। আমার শিলং যাওয়ার পরিকল্পনা আছে। যদি চালু থাকে তাহলে আমি হয়তো এই পথেই শিলং যাব।

নাকুগাঁও আমার দেখা সবচেয়ে ছিমছাম স্থলবন্দর। কম ব্যস্ত বলেই হয়তো এটি মনে হয়েছে। বন্দরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ভোগাই নদী পুরো পরিবেশে একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। শিলংয়ের পাহাড়ি নদী তুরা হলো ভোগাইয়ের পানি প্রবাহের উৎস। নদীতে বালু তোলার কাজে ব্যস্ত অনেক শ্রমিক। বাঁশের মাচার মতো পানির ওপরে ভেসে থাকা স্থাপনায় সংগৃহীত বালু রাখা হচ্ছে। সবচেয়ে ভালো কোয়ালিটির এই বালু ট্রাকে করে চলে যাবে দেশের বড় বড় শহরে। আমরা জুতা খুলে সবাই নেমে পড়লাম পানিতে। নদীর ঠান্ডা পানি শরীরে লাগার সঙ্গে মনে হলো যেন আমরা পাহাড়ি ঝর্ণার পানিই স্পর্শ করছি। শরীরের ক্লান্তি কিছুটা যেন দূর হলো। একটু মনও খারাপ হলো এই ভেবে যে একই নদীর পানি বিছিন্ন দুই দেশে। একই জল, একই পানি। মাঝে সীমান্ত রেখা। অথচ এই পানি একটু এগিয়ে গিয়ে স্পর্শ করতে গেলে লাগবে পাসপোর্ট, লাগবে ভিসা। ১৯৪৭ সালে একজন সাহেবের টানা রেখায় ভাগ হয়ে গেছে নদী, বন, জল ও জঙ্গল। এ হলো দেশ ভাগের রাজনীতির ফসল!

পেশাগত কারণে প্রায়ই ছুটে বেড়াতে হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, বিশেষ করে মফস্বল শহরগুলোতে। সরকারি ছুটি প্লাস উইকএন্ডের লম্বা সময়টিতে জামালপুর ঘুরতে যাওয়ার ডাক যখন পেলাম ইউনিভার্সিটির বন্ধু আরজুর কাছ থেকে, প্রথমে একটু দ্বিধার মধ্যেই পড়ে গিয়েছিলাম। মফস্বল শহর! তারপর মনে হলো কেন নয়? প্রায় পাঁচ বছর আগে একবার জামালপুরে গিয়েছিলাম অফিসের কাজেই; কিন্তু শহর বা তার আশপাশ তেমনটা ঘুরে দেখা হয়নি। কাজ সেরে পরের দিনই ঢাকা ফিরে এসেছিলাম।

গুগল নিউজে (Google News) সাম্প্রতিক দেশকালের খবর পেতে ফলো করুন
সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ (১৭৬০-১৮০০), হাতিখেদা বিদ্রোহ (১৭৭০-১৭৭৫) এবং পাগলপন্থী বিদ্রোহের (১৮২৫-১৮২৭) মতো আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু যে জামালপুর তা ঘুরেফিরে দেখার আগ্রহটা কিন্তু এই বেড়ানোর আগ পর্যন্ত মাথার ভেতর ঠিকই ঘুরপাক খাচ্ছিল। তারমধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জামালপুরে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের বিরোচিত লড়াই যা ‘কামালপুরের যুদ্ধ’ নামে খ্যাত সেই কামালপুরের মাটি ছুঁয়ে দেখার একটি তীব্র ইচ্ছাও ছিল। তাই বন্ধু আরজুর ডাক পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তৈরি হলাম জামালপুর যাব বলে। তৈরি হয়ে গেল সাবেক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের ছোট একটি দল। আমরা ঠিক করলাম এবারের জার্নি হবে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে। দীর্ঘ বন্ধের কারণে রেলে টিকিট পাওয়া কঠিন। তবে সেটি ম্যানেজ হয়ে গেল রেলের সাবেক কর্মকর্তা আমাদেরই বিশ্ববিদ্যালয়ের জুনিয়র ভাই রোকনের বদৌলতে। যারা শিরোনাম দেখে ভাবছেন, ভাই, ঘুরতে গেলেন জামালপুর আর লিখেছেন সন্ন্যাসীগঞ্জ, ব্যাপারটা কী? তাদের উদ্দেশে বলছি, জামালপুরের পুরনো নাম সিংহজানী। এরপর এই এলাকা সন্ন্যাসীগঞ্জ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। এর সঙ্গে হয়তো সন্ন্যাসী বিদ্রোহের একটি যোগাযোগ আছে। তাই হয়তো এই নামের স্মৃতি বয়ে বেরাচ্ছে শহরের আশপাশেই থাকা সন্ন্যাসীর চর বা সন্ন্যাসীর ভিটা নামের এলাকাগুলো। সন্ন্যাসী বিদ্রোহের অবসানের প্রায় ৪৫ বছর পর ১৮৪৫ সালে জামালপুরের আবির্ভাব ঘটে প্রশাসনিক মহুকুমা হিসেবে। জামালপুর নামটি আবার করা হয়েছে সুফি হযরত শাহ জামাল (র.) স্মৃতিকে ধরে রাখার উদ্দেশ্যে। প্রচলিত রয়েছে এই সুফি ২০০ অনুসারীসহ ইয়েমেন থেকে এদেশে এসেছিলেন সম্রাট আকবরের শাসন আমলে। উদ্দেশ্য ধর্মপ্রচার। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তিনি আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ব্রহ্মপুত্রের কোল ঘেঁষে সিংহজানী মৌজাতে তার ডেরা তৈরি হয়। ১৯৭৮ সালে জামালপুর আবির্ভূত হয় জেলা হিসেবে।

ট্রেনের নাম তিস্তা অনেক দিন পর রেল ভ্রমণ। যাওয়ার পথে আমাদের জন্য একটি এসি বার্থ কামরা রিজার্ভ করা হয়েছে। সকাল সাড়ে ৭টার ট্রেন ধরতে আমরা কমলাপুর পৌঁছলাম ৭টার সময়। ভয় ছিল গিয়ে দেখবো ট্রেন নেই। স্টেশনে ঢুকে দেখি ‘তিস্তা’ নামের ঝকঝকে ট্রেনটি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। কামরায় উঠে দেখি তা বেশ পরিচ্ছন্ন। রেলের আগের অভিজ্ঞতার সঙ্গে ঠিক মেলে না। দেশের সঙ্গে সঙ্গে যে রেল ব্যবস্থারও উন্নতি হয়েছে তা বলতেই হয়। সাড়ে ৭টার ট্রেন ছাড়ল সাড়ে ৮টায়। আমরা দলে আড্ডা দিচ্ছিলাম বলে হয়তো এক ঘণ্টার দেরিকে অত দেরি মনে হলো না। ছাড়ার পর কিন্তু ‘তিস্তা’ আমাদের ঝামেলাবিহীনভাবেই চার ঘণ্টার মধ্যে জামালপুর পৌঁছিয়ে দিল। এই চার ঘণ্টা আড্ডা চলল বিরামহীন। এর মাঝে আমরা অর্ডার দিলাম চা আর কাটলেটের। ট্রেনের কাটলেটটা আমাদের কাছে বিশেষ একটি ব্যাপার। ছোটবেলায় বেশ কয়েকবার রংপুর থেকে ফুলছড়ি-বাহাদুরাবাদ ঘাট হয়ে ঢাকা পর্যন্ত আন্তঃনগর ট্রেন জার্নি করেছিলাম। তখন এই কাটলেট ছিল আমাদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ। আমরা কাটলেটের অর্ডার দিয়ে যেন সেই শৈশবে ফিরে যেতে চেয়েছিলাম। তবে এখন স্বাদটা যেন একটু অন্যরকম লাগল। স্বাদটায় কি পরিবর্তন এসেছে, নাকি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরই জিহ্বার স্বাদ পাল্টে গেছে! আমরা ফিরেছিলামও ‘তিস্তা’য়। আসার দিন কিন্তু বিকাল ৪টার ট্রেন ৪টাতেই ছেড়েছিল এবং ঠিক সময়মতো আমাদের বিমানবন্দর স্টেশনে নামিয়ে দিয়েছিল। পুরো ভ্রমণের অভিজ্ঞতাটাই ছিল অনেক স্বস্তিকর।

ব্রহ্মপুত্রের কোলের শহর জামালপুর
হোটেলে দ্রুত ‘চেকইন’ করার পর আমরা বেরিয়ে গেলাম জামালপুর শহরটা দেখতে। শহরের মূল রাস্তা একটিই। সেই রাস্তা ঘিরেই অফিস-আদালত-দোকানপাট। সে কারণে শহরটার আকার অনেকটা লম্বাটে। রাস্তার একদিকে শহর আর অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্র নদ। নদ অবশ্য পানিতে ভরে ওঠে শুধু বর্ষার সময়ই।

অন্য আর দশটি মফস্বল শহরের মতো জামালপুরের রাস্তাও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার দখলে। আমরা একটি অটোরিকশায় উঠে পড়লাম। গন্তব্য সার্কিট হাউস। পথে থামলাম ‘তামান্না রেস্টুরেন্ট’ এ দুপুরের খাবার খেতে। রেস্টুরেন্টটির বড় বৈশিষ্ট্য হলো এটি অবস্থান করছে একটি নব্বই বছরের পুরনো বিল্ডিংয়ের নিচতলায়। ঢুকেই মনটা ভালো হয়ে গেল এর খোলামেলা পরিবেশের জন্য। রেস্টুরেন্টটির সামনে একটি ছোট্ট বাজার। বন্ধু আরজু জানালো সকালবেলা এখানে টাটকা সবজির বাজার বসে। সেই বাজারেই দেখি গরুর দুধের চা পাওয়া যাচ্ছে। দুপুরের খাবারের পর এই চায়ের চাইতে ভালো আর কী হতে পারে। সঙ্গে জুটে গেল মচমচে জিলাপি। একটু এগিয়ে সামনে দেখি একটি লম্বা কংক্রিটের ব্রিজ ব্রহ্মপুত্রের মধ্যে ঢুকে গেছে। ব্রিজের শেষ প্রান্তটা খোলা। দেখে মনে হয় যেন একটি জেটি। অপেক্ষা করছে কোনো জাহাজের জন্য। জানা গেল যে ব্রিজটি তৈরি শুরু হয়েছিল নদের ওপারের একটি গ্রামকে যুক্ত করার জন্য। কাজ শেষ হওয়ার আগেই সেই গ্রাম ভেঙে যায় নদের স্রোতের তোড়ে। এখন এখানে ঘুরতে আসে শহরের মানুষজন। নদের পাড়ের বিশুদ্ধ শীতল হাওয়ায় তাদের প্রাণ জুড়ায়। আমরা হেঁটে গেলাম ব্রিজের মাথা পর্যন্ত। দিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশ, কোথাও কোথাও কালো মেঘের দখল। একটু দূরে চরের মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে টিনের ঘরবাড়ি। ব্রিজের নিচে খালের মতো পানির স্রোত। তারই ধারে মাটির ওপর পড়ে আছে কিছু নৌকা। যেন অপেক্ষা করছে কখন বর্ষা আসবে, কখন যৌবন ফিরে পাবে ব্রহ্মপুত্র। মন ভালো করা এই পরিবেশে কিছু সময় কাটিয়ে আমরা হাঁটতে থাকলাম নদের পাড়ের ফুটপাত দিয়ে। এই পথটিও সবুজে ভরা। সারি সারি জাম গাছ, সারি সারি সুপারি গাছ। মিনিট দশেক হাঁটার পর আমরা পৌঁছে গেলাম সার্কিট হাউসে।

সুলতানগরের সুখদুঃখ-বাংলাদেশেরই প্রতিচ্ছবি
সার্কিট হাউস থেকে বেরিয়ে আমরা রওনা হলাম বন্ধু আরজুর গ্রামের বাড়ি সুলতাননগরের উদ্দেশ্যে। অটো, সিএনজি, তারপর রিকশা-ভ্যানে করে প্রায় ৪৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম সুলতাননগর গ্রামে। অসাধারণ সুন্দর এই গ্রামের চারদিকে বিল। পুরো গ্রামটি গাছগাছালিতে ভরা। কয়েক বছর আগে গ্রামে ঢোকার রাস্তাটি পাকা হয়েছে। গ্রামে ঢুকেই নতুন ধানের গন্ধ পাওয়া গেল। ধান কাটামারি চলছে। বাতাসে তারই গন্ধ ম-ম করছে। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে পালা করা ধানের স্তূপ। কোথাও ধান সিদ্ধ হচ্ছে, কোথাও ধান শুকানো হচ্ছে। আবার কোথাও ধান মাড়াই হচ্ছে মেশিনে। কোথাও দেখলাম কুলায় করে ধান উড়ানো হচ্ছে পাতান থেকে ধান আলাদা করার জন্য। সবার মুখে সুখের হাসি। ফসল ঘরে তোলার নির্মল সুখ। দেখে মনের অজান্তেই গেয়ে উঠতে ইচ্ছা করে, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।’ সবচেয়ে ব্যস্ত দেখলাম নারীদের। কেউ বসে নেই, কিছু না কিছু করছেই। অথচ কৃষিতে এই নারীদের অবদানের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি আমরা এখনো দিতে শিখিনি। একটু পরেই আমাদের পেছনে জড়ো হলো গোট দশেক উৎসুক বাচ্চা ছেলেমেয়ে। মুহূর্তেই ওদের সঙ্গে খাতির হয়ে গেল। জানলাম, সবাই স্কুলে যায়, কেউ কেউ স্থানীয় মাদ্রাসায় পড়ে। আমাদের আরজু যেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা- ওর পেছনে পেছনে পুরো সময় ছুটল এই বাচ্চাদের দল। আমরা আমাদের ক্যামেরায় ধরে রাখতে চাইলাম এদের হাসিমাখা মুখ। এরাই তো আমাদের ভবিষ্যৎ।

শেষ বিকেলে আমরা চলে গেলাম বিলের পাড়ে। বিলের স্থানীয় নাম ‘বামুনজি’। বিলের ধারে ধানক্ষেত। কোনো কোনো ক্ষেতে সবে ধান কাটা হয়েছে। মোথায় ভরা ন্যাড়া মাঠগুলো সেই সাক্ষ্য বহন করছে। অনেক ক্ষেতেই ধান পাকা শুরু হয়ে গেছে। পাকা ধানের সোনালি আভা আর সবুজের সম্মিলনে নতুন এক ঘোরলাগা রঙ তৈরি হয়েছে। দেখলাম নৌকায় করে মানুষজন বিল পাড়ি দিচ্ছে নিজের ঘরে পৌঁছবে বলে। নৌকায় করে জাল বিছিয়ে মাছ ধরছে কিছু মানুষ। একদল হাঁস লাইন ধরে রওনা দিয়েছে গৃহস্তের ঘরে ফিরবে বলে। সূর্যাস্তটা আমরা উপভোগ করলাম বিলের ধারে। ক্লান্ত লাল সূর্য টুপ করে ডুবে গেল বিলের জলে নানা রঙের আভা তৈরি করে। বাংলাদেশের একটি পরিপূর্ণ সুখী গ্রামের চিত্র পেলাম সুলতাননগরে এসে।

আমরা যখন গ্রামের রাস্তা দিয়ে ঘুরছি, অনেক মুরুব্বি এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন, ‘তোমরা কারা বাবা? কোনখান থাইকা আইছ? সরকারি লোক নাকি?’ আমাদের দলের তিনজনার হাতে ডিএসএলআর ক্যামেরা, যা পাচ্ছি তারই ছবি তুলছি। আমরা যখন জানালাম যে আমরা আরজুর বন্ধু, এসেছি গ্রামটা ঘুরে দেখতে, তখন প্রত্যেকের মুখেই স্বস্তি লক্ষ্য করলাম। আরজুর কাছে যখন জানতে চাইলাম কেন সবাই আমাদের সরকারি লোক ভাবছে, তখন শুনলাম আরেক গল্প। সুলতানগরের দুঃখের গল্প। গ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে পাকা রাস্তা ঘিরে সরকার পরিকল্পনা করেছে ‘ইকোনমিক জোন’ করার। এ জন্য ওই এলাকার জমি অধিগ্রহণ চলছে। বিলসংলগ্ন ৯০ একর খাসজমি ইতিমধ্যেই প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ২২৭ একর বিলটির এখন অবশিষ্ট আছে ১৩৭ একর। গ্রামবাসীদের এ নিয়েও তেমন কোনো আপত্তি নেই; কিন্তু ঠিকাদার সংস্থা যেভাবে বিল থেকে বালু তোলার পরিকল্পনা করছে, তাতে ‘বামুনজি’ বিলের জীব-বৈচিত্র্যের বারোটা তো বাজবেই, এমনকি বিলের মধ্যে বিলীন হয়ে যেতে পারে আশপাশের পাঁচটি গ্রামের ঘরবাড়ি। গ্রামবাসীরা চান জমি ভরাটের বালু সংগ্রহ হোক অন্য কোথাও থেকে। এ নিয়ে তারা জেলা প্রশাসকসহ অনেকের কাছেই স্মারকলিপি দিয়েছেন, কিন্তু কোনো ফল পাচ্ছেন না। তারা সবাই নিজেদের গ্রামগুলোর বিপন্নতা নিয়ে চিন্তিত। কথা হচ্ছিল কয়েকজন গ্রামবাসীর সঙ্গে, তারা বলছিলেন, “আমরা তো এখন ভালোই আছি।

কৃষকদের গোলাভরা ধান আছে।
কৃষিশ্রমিকরা প্রতিদিন মজুরি পাচ্ছে ৫০০ টাকা। ‘বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা’ হলে আমাদের নতুন আর কি সুবিধা হবে?” দেশের এবং জামালপুর জেলার বৃহত্তর স্বার্থে তারপরও তারা এই প্রকল্পের বিরোধী নন। তারা শুধু চান বিলের যেন কোনো ক্ষতি না হয়। বিলের ওপর নানাভাবে নির্ভরশীল পাঁচ গ্রামের হাজার হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা, ঘরবাড়ি এবং জমিজমা যাতে কোনোভাবেই বিপর্যস্ত না হয়, সে জন্যই তারা চান যেন বিল থেকে বালু তোলা না হয়। ভাবছিলাম, এতো খুবই মৌলিক চাওয়া। গ্রামবাসীকে এসব চাইতে হবে কেন? যারা উন্নয়ন পরিকল্পনা করেছেন, তাদের মূল ভাবনাতেই তো এটি থাকার কথা। কবে যে স্থানীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় স্থানীয় জনগণের মতামত গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হবে?

সন্ধ্যা গড়িয়ে যখন রাত হলো, পরিষ্কার আকাশে তখন বড় একটি চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। আরজু তাদের বাড়ির উঠানে আমাদের জন্য পাটি বিছিয়ে দিল। আমরা সেখানে গা এলিয়ে খোলা আকাশের নিচে চাঁদ উপভোগ করছি। রাতে খাবারের আয়োজন হলো স্থানীয় বিভিন্ন আইটেম দিয়ে। খাবারের স্বাদে আমরা অভিভূত। আমাদের সফরসঙ্গী খাদ্যরসিক পুরান ঢাকার পোলা শাকিল বলল, স্বাদ তো হবেই, একে তো সব টাটকা জিনিস, তার ওপর আবার খড়ির চুলায় রান্না। আমরা পরিচিত হলাম, ‘ম্যান্দা’ নামের স্থানীয় এক খাবারের সঙ্গে। গরুর মাংসের সঙ্গে চালের গুড়া দিয়ে বানানো আইটেম। ঝোলটা অনেক ভারি। স্বাদটা অনেকটা হালিমের মতো, কিন্তু আবার হালিমও না। উত্তরাঞ্চলে গ্রাম্য মজলিসের মাংসের তরকারিতে আটা মেশাতে দেখেছি। এখানে দেখলাম মেশানো হয়েছে চালের গুঁড়া। রাতের খাবার সেরে যখন শহরে ফেরার জন্য রওনা দিলাম, আমাদের মুখে তখনো লেগে আছে ‘ম্যান্দা’র স্বাদ। ফেরার পথে দেখি বাজারে গ্রামবাসীদের বড় জমায়েত হচ্ছে। সবাই একত্রিত হয়ে আলোচনা করছে বিল রক্ষায় কি করা যায়। সমষ্টিগত এই প্রচেষ্টা দেখে ভালো লাগলো। আশা করি, প্রশাসনের বোধোদয় হবে। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় অন্ধকার দূর হবে। মনুষ্য-সৃষ্ট দুঃখের শিকার হতে হবে না সুলতাননগরবাসীদের। সুখী সুলতানপুরের সবাই সুখেই থাকবে সকলে মিলে।

মধুটিলায় গারো পাহাড়ের হাতছানি
পরের দিন সকালে আমরা বের হলাম শেরপুরের উদ্দেশ্যে। আগস্ট মাসের আলোকিত সকাল। ভাড়া মাইক্রোবাসে করে আমরা যখন পাকা রাস্তায় চলছি, চারদিকে তাকিয়ে মন ভালো হয়ে গেল। আমার কাছে ধানকাটার আগের বাংলাদেশের গ্রামবাংলার প্রকৃতি সবচেয়ে সুন্দর লাগে। মাঠগুলো সবুজ ধানক্ষেতে ভরা থাকে। হালকা পাতলা বৃষ্টি ধুয়ে সতেজ করে তোলে গাছগাছালি। আমাদের গাড়ি ছুটে চলল এরকম এক রাস্তা ধরেই। দু’ধারে ধানক্ষেত। কোনো কোনো ক্ষেতে ধান পাকা শুরু হয়েছে। ফলে সবুজের মাঝে যেন হালকা সোনালী রঙের তুলির টান দিয়ে রেখেছে কোনো চিত্রকর। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর আমরা পৌঁছালাম মধুটিলা ইকোপার্কে।

আমাদের ড্রাইভার জানালো যে, মধুটিলা ইকোপার্ক পিকনিক স্পট হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। পিকনিক সিজনে নাকি ভিড়ের কারণে এখানে ঢোকাই মুশকিল। এটি অবশ্য এখন আমাদের দেশের প্রায় সব পিকনিক স্পটের জন্যই প্রযোজ্য। গারো পাহাড়ের পাদদেশে ৩৮৩ একর আয়তনের এই পার্কের বড় আকর্ষণ হলো প্রকৃতির মাঝে নির্জনতা। সবুজের মাঝে নির্জনতা আর নিস্তব্ধতা উপভোগের চাইতে আনন্দের বিষয় আর কিই বা হতে পারে! যেন স্তব্ধতার গান শোনা। শেরপুরের নালিতাবাড়ি উপজেলার এই ইকোপার্কে কিন্তু ওষধি গাছের এক বিশাল সংগ্রহ রয়েছে। তাও আবার ২০ একর জায়গা জুড়ে। বাংলাদেশ বন বিভাগকেও ধন্যবাদ দিতে হয় সুন্দর ব্যবস্থাপনার জন্য। লেকটাও দেখলাম বেশ গুছানো। এমনকি লেকে নৌকাভ্রমণের ব্যবস্থা আছে। দেশি এবং পেডাল- দুই অপশনই আছে। তবে পিকনিকের সিজনে এখানকার পরিবেশ কেমন থাকে তা বলা কঠিন।

একটু ঘোরাঘুরি করতেই আমাদের নজরে পড়ল পার্কের মাঝে থাকা ওয়াচ টাওয়ার। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে খানিকটা কষ্ট হলো। সবাই দরদরে ঘামছিলাম; কিন্তু যখন টাওয়ারের উপর থেকে চারদিকে তাকালাম, কষ্টকে আর কষ্ট বলে মনে হলো না। দূরে গারো পাহাড়ের হাতছানি। চারদিকে সবুজ আর সবুজ। উপরে দূরের দৃশ্য দেখার জন্য দূরবীনের ব্যবস্থা আছে। টাকা দিয়ে সেগুলো ব্যবহার করা যায়। শুনলাম এই বনের একটি অংশ নাকি ভারত অংশেও বিস্তৃত। নিচে ঘোরাঘুরির সময় পুরো পার্কের বিস্তৃতি বোঝা যায় না। বোঝা যায় না সবুজের সমারোহটাও।

টাওয়ার থেকে নিচে নেমেই আমরা দেখা পেলাম এক ডাবওয়ালার। যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। সবাই অনেকটা ঝাঁপিয়েই পড়লাম তৃষ্ণা মেটাতে। পাশে পেলাম গরম গরম পিয়াজু। সঙ্গে মিললো চা। সব মিলিয়ে সকালের শেষভাগের চা বিরতিটা খারাপ হলো না। বের হবার পথে পার্কের উঁচু ঢাল বেয়ে ওঠার সিঁড়িতে বসে সদলবলে সময় কাটালাম। সময়টা ধরে রাখার জন্য তোলা হলো বেশকিছু গ্রুপ ছবি। পার্কে একটি গেস্ট হাউসও আছে। তবে সেখানে রাত কাটাতে হলে প্রশাসন থেকে অনুমতি নিতে হয়। এখানে পূর্ণিমার রাতে এসে থাকতে পারলে দারুণ একটি অভিজ্ঞতা হতো।

ভোগাই নদীর কোলঘেঁষা ছিমছাম নাকুগাঁও স্থলবন্দর মধুটিলা থেকে বেরিয়ে আমরা ছুটলাম নাকুগাঁও স্থলবন্দরের দিকে। শেরপুরে যে একটি স্থলবন্দর রয়েছে এবং তার সঙ্গে ইমিগ্রেশন চেকপোস্টও আছে তা আমার জানা ছিল না। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার এটি চালু করতে আগ্রহী হয়েছিল মূলত ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরির বিষয়টা মাথায় রেখে। এখন এবন্দর দিয়ে কয়লা আর পাথর আমদানি হয় আর সিমেন্ট রপ্তানি হয়। ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট দিয়ে মানুষ পারাপারের ব্যবস্থা থাকলেও খুব বেশি মানুষ এপথ দিয়ে যাতায়াত করে না।

এবন্দর দিয়ে যাতায়াত কিন্তু তুলনামূলকভাবে অনেক সহজ। ইমিগ্রেশনে ভিড় নাই। নাই দালালদের আধিপত্য। সীমান্ত পেরিয়ে তিন কিলোমিটার গেলেই বাস স্ট্যান্ড। সেখান থেকে বাসে করে সরাসরি যাওয়া যায় আসামের গৌহাটি বা পশ্চিম বঙ্গের শিলিগুড়ি। পূর্বদিকে গেলে গৌহাটি আর শিলং। আর পশ্চিমে গেলে শিলিগুড়ি। মিজোরাম, অরুণাচল এবং নাগাল্যান্ড যাওয়ার সহজ পথ উত্তরের মানুষের জন্য এটিই। তাছাড়া, গৌহাটিতে থাকা বিমানবন্দর ব্যবহার করে যাওয়া যায় ভারতের সব বড় শহরগুলোতেই। চিন্তা করুন, ঢাকা থেকে ৪/৫ ঘণ্টায় নাকুগাঁও। তারপরেই ভারত। তারপরও প্রচারের অভাবে অনেকটা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে নাকুগাঁও চেকপোস্ট। এই চেকপোস্ট দিয়ে সড়কপথে ভারতে ঢুকতে ভিসার আবেদনে উল্লেখ করতে হয় ‘বাই রোড ডালু’। ভারতের অংশে ‘ডালু’ হলো এই চেকপোস্টের নাম। আমার শিলং যাওয়ার পরিকল্পনা আছে। যদি চালু থাকে তাহলে আমি হয়তো এই পথেই শিলং যাব।

নাকুগাঁও আমার দেখা সবচেয়ে ছিমছাম স্থলবন্দর। কম ব্যস্ত বলেই হয়তো এটি মনে হয়েছে। বন্দরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ভোগাই নদী পুরো পরিবেশে একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। শিলংয়ের পাহাড়ি নদী তুরা হলো ভোগাইয়ের পানি প্রবাহের উৎস। নদীতে বালু তোলার কাজে ব্যস্ত অনেক শ্রমিক। বাঁশের মাচার মতো পানির ওপরে ভেসে থাকা স্থাপনায় সংগৃহীত বালু রাখা হচ্ছে। সবচেয়ে ভালো কোয়ালিটির এই বালু ট্রাকে করে চলে যাবে দেশের বড় বড় শহরে। আমরা জুতা খুলে সবাই নেমে পড়লাম পানিতে। নদীর ঠান্ডা পানি শরীরে লাগার সঙ্গে মনে হলো যেন আমরা পাহাড়ি ঝর্ণার পানিই স্পর্শ করছি। শরীরের ক্লান্তি কিছুটা যেন দূর হলো। একটু মনও খারাপ হলো এই ভেবে যে একই নদীর পানি বিছিন্ন দুই দেশে। একই জল, একই পানি। মাঝে সীমান্ত রেখা। অথচ এই পানি একটু এগিয়ে গিয়ে স্পর্শ করতে গেলে লাগবে পাসপোর্ট, লাগবে ভিসা। ১৯৪৭ সালে একজন সাহেবের টানা রেখায় ভাগ হয়ে গেছে নদী, বন, জল ও জঙ্গল। এ হলো দেশ ভাগের রাজনীতির ফসল!

লাউচাপড়ায় সবুজের সমারোহ
নাকুগাঁও থেকে বেরিয়ে আমরা ছুটলাম জামালপুরের বকশীগঞ্জের দিকে। উদ্দেশ্য লাউচাপড়া পাহাড়িকা অবকাশ কেন্দ্র ঘুরে দেখা। আমাদের মাইক্রোবাস এবারে ছুটলো বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর রাস্তাগুলোর একটি দিয়ে। দু’ধারে ছোট ছোট সবুজ টিলা। মাঝে মাঝেই বন। পেঁচানো, পরিচ্ছন্ন এবং কম ব্যস্ততাপূর্ণ এই রাস্তায় উঠে মনে হলো আমরা অন্যরকম সুন্দর বাংলাদেশ দেখছি। পথে পথে আবার দেখি হাতি ক্রসিংয়ের সাইন। জেব্রা ক্রসিং, ডিয়ার ক্রসিংয়ের পর এবার সড়কে এলিফ্যান্ট ক্রসিংয়ের সাইন দেখার অভিজ্ঞতাও যোগ হলো।

লাউচাপড়া অবকাশ কেন্দ্রও আসলে একটি পিকনিক স্পট। আর দশটি স্পটের মতো এখানকার প্রবেশ পথটিও ট্যুরিস্টিক। মূল গেট ধরে একটু হাঁটলে পাওয়া যায় ওয়াচ টাওয়ারে ওঠার ঢাল। সেই ঢাল উঠতে হয় সিঁড়ি বেয়েই। মধুটিলার মতো এই টাওয়ারও অনেক উঁচু। এবার আমাদের দলের দু-একজন ওঠার কষ্টের কথা ভেবে ক্ষান্ত হলো; কিন্তু তারা জানতেই পারল না যে কি ভীষণ সুন্দর অভিজ্ঞতা তারা মিস করল। টাওয়ারের সবচেয়ে উঁচু তলায় উঠে চারিদিক তাকিয়ে দেখি সবুজ আর সবুজ। মনে হচ্ছিল যেন বেলুনে চড়ে সবুজের ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছি। দ্রোন ব্যবহার করে উঁচু থেকে বনের ছবি তুললে যেমন লাগে অনেকটা সেই রকম অনুভুতি। যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজে ভরা – এ যেন সবুজের সমারোহ। দূরে মেঘালয়ের পাহাড় যেন আকাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের ডাকছে। এই ডাকে সাড়া দিয়েই শিলং যেতে হবে মনে হচ্ছে। বন থেকে ভেসে আসছে পরিচিত আর অপরিচিত পাখ-পাখালির ডাক। স্থানীয়রা বললেন, ধান পাকার মওসুমে রাতে মেঘালয়ের পাহাড় থেকে নেমে আসে হাতির দঙ্গল। তছনছ করে দিয়ে যায় পাকা ফসল। গ্রামবাসীদের তখন দলবেঁধে ক্ষেত পাহারা দিতে হয়। হাতির দল লোকালয়ে নেমে আসে কারণ বন এবং বনের খাবার সাবাড় করেছে মানুষ। মানুষ আর হাতির অস্তিত্বের এই লড়াই চলছে সারা বিশ্ব জুড়েই। বিশ্বজুড়ে আমাদের মতো মানুষের সর্বগ্রাসী ক্ষুধায় বিপর্যস্ত বনবাদাড়, হাতিরাও এর ব্যতিক্রম না। হাতি আর মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান তখনই সম্ভব হবে যখন মানুষের সর্বগ্রাসী এই ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে।

টাওয়ার থেকে নেমে আমরা কৃত্রিমভাবে তৈরি করা লেকের পাশে গাছের নিচে বসে পড়লাম। ছিমছাম এই জায়গা বিশ্রামের জন্য দারুণ। এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ছোটার কারণে আমাদের দুপুরে খাওয়ার সুযোগ হয়নি। গাছের নিচে পেয়ে গেলাম স্থানীয় এক নারীর ছোট্ট দোকান। সেখানে মিলল ঝালমুড়ি আর বিস্কুট। হাল্কা নাস্তা সারতে সারতেই বন্ধু আরজু জানালো পাশেই ‘দিকলাকোনা’ নামে গারোদের গ্রাম। সেখানে তার এক বন্ধু থাকে। আমরা সবাই লাফিয়ে উঠলাম সেখানে যাওয়ার জন্য।

অবকাশ কেন্দ্র থেকে ঢালু পথ ধরে নেমে এলাম দিকলাকোনায়। গারোদের এই গ্রামে ২২ পরিবারের বাস। জনসংখ্যা প্রায় ১শ’। আমরা আরজুর বন্ধুর দেখা পেলাম না; কিন্তু দেখা পেলাম মনমুগ্ধকর প্রাকৃতিক পরিবেশের। গ্রামটা কতগুলো টিলার মাঝে বিদ্যমান সমতল ভূমির ওপর দাঁড়িয়ে। চারদিকে সবুজ ধানী জমি। টিলাগুলোর চারধারে সবুজ গাছপালা। এরই মধ্যে সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়তে শুরু করেছে। আলোছায়ার মায়াবী রূপ খেলা করছে চারধারে। একই সঙ্গে অনুভব করলাম শীতল বাতাস। সারাদিনের ছোটাছুটির পর বাতাসের এই শীতল স্পর্শ আমাদের ক্লান্তি দূর করে দিল। গ্রামের রাস্তার ধারে থাকা বাঁশের মাচাংয়ে আমরা বসে পড়লাম। পাশেই একটি ছোট্ট দোকানে ভাজা হচ্ছিলো পিয়াজু। ছিল চায়ের ব্যবস্থা। এমন সুন্দর পরিবেশে সবাই মিলে গল্প আর আড্ডা দেয়ার চাইতে আনন্দের বিষয় আর কি হতে পারে? কোলাহল আর দূষণবিহীন এক গ্রামে অলস বিকেল। ক্ষেতে দু-একজন গারো নারীপুরুষ কাজ করছে। জমির মাঝের রাস্তায় খেলছে শিশুরা। তাদের মধ্যে নেই কোনো ব্যস্ততা। ঢাকা শহরে জ্যাম, বায়ু আর শব্দদূষণের মাঝে দিনের পর দিন কাটানোর পর এই বিকাল পুরো অন্য এক অভিজ্ঞতা।

- Advertisement -spot_img
আরও সংবাদ
- Advertisement -spot_img
এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here