সোমবার, জানুয়ারি ৬, ২০২৫
Homeঅন্যান্যশিল্পকলা

শিল্পকলা

লুৎফর রহমান কবি ও সাহিত্যিক

আমরা চারপাশে যা দেখি তা প্রকৃতি। প্রকৃতির রূপ-সৌন্দর্য চলমান। এই রূপ আমাদের মনকে আন্দোলিত করে তরঙ্গের মতো। মানুষ তার জীবনের আদিকালে প্রকৃতির রূপের সামনে দাঁড়িয়েছিলো, হৃদয়ে জেগেছিলো প্রেম, অন্তর বিমুগ্ধ হয়েছিলো, বিস্ময়ে করেছিলো প্রশ্ন। সে কিছু জানতে চেয়েছিলো, বুঝতে চেয়েছিলো। সুবিশাল প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যকে সে নিজের মধ্যে পেতে চেয়েছিলো।

মানুষের আবেগ প্রকৃতির বিপুল সৌন্দর্যকে নিজের মতো করে প্রকাশের প্রেরণা জোগিয়েছিলো। প্রকৃতির এই রূপকে মানুষ নিজের মনের ভেতর নিয়ে বিমূর্ত করলো। তারপর আপন মনের রঙে-রেখায়-শব্দে-ভঙ্গিতে বাইরে এনে মূর্ত করলো। তখন সেটা আর প্রকৃতির রইলো না তার নিজের হয়ে গেলো, এবং মনের রঙ মেশানো রূপ অন্যের কাছে প্রকাশ করতে চাইলো। এটাই শিল্পকলা।

শিল্পের মধ্যে অনুভূতির প্রকাশ থাকে। অনুভূতি-সঞ্চার শিল্পের উদ্দেশ্য নয়। শিল্পে মানুষের জীবন-বিরুদ্ধ কিছু থাকার ‍সুযোগ নেই। মানবতাই শিল্পের আকর। জীবনকে সুন্দর করে সামনের দিকে প্রবাহিত করাই শিল্পের উদ্দেশ্য। প্রকৃতির রূপের অনুকরণ করা শিল্প না, শিল্প হচ্ছে মনের রঙ মিশিয়ে সৃষ্টি করা, ফটোগ্রাফ নয়, সৃষ্টি। প্রকৃতিকে অন্তরের করা এবং অন্তরকে সাজিয়ে বের করে আনাই শিল্পের মূল কথা। যা অদৃশ্য ও অস্পর্শযোগ্য সেটাকে দৃশ্যমান এবং স্পর্শযোগ্য করাই শিল্পের ধর্ম। ক্ষণকালের সৌন্দর্যকে চিরস্থায়ী করাই শিল্পের কাজ।

বিশেষ ও সর্বজনীন :
যিনি শিল্পের কাজটা করেন তিনি শিল্পী। শিল্পী রূপবিলাসী রূপকার এবং রূপই শিল্প। শিল্পের বিশেষ ও সর্বজনীন এ দুটু বৈশিষ্ট্য আছে।

বিশেষ :
একটি বস্তুর যে একক ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলো অন্যসব বস্তু থেকে একে আলাদা করে সেগুলোর সমষ্টিকেই বিশেষ বা Individual বলে।

সর্বজনীন :
কোনো বস্তুর অন্যান্য বস্তুর সাথে তার মিলের দিককে সর্বজনীন বা Universal বলে।

কোনো শিল্পী কিছুকে প্রথম দেখেন ও অন্তরে জায়গা দেন পরে সেটাকে অন্তরের বাইরে সত্তা দান করেন। তার ব্যক্তি-অনুভূতি কিন্তু একান্তভাবে ব্যক্তিগত নয়। তিনি একদিকে যেমন বিশেষ আবার অন্যদিকে সর্বজনীন। বিশেষই শিল্পের ভিত্তিভূমি। সায়লা নামের মেয়েটিকে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে রিক্সায় চড়ে যেতে দেখি তখন সে একজন সাধারণ নারী। এটা সর্বজনীন। কিন্তু চন্দন ও মেহেদির রঙে সেজে মুকুট মাথায় যখন বিয়ের আসরে উপস্থিত হয় তখন সে বিশেষ নারী; সাধারণ ছাত্রীদের থেকে আলাদা বিয়ের কন্যা বিশেষ। সে একদিকে সাধারণ নারী আর অন্যদিকে বিশেষ মুহূর্তে উদ্ভাসিত বিশেষ নারী-প্রতিমা। সর্বজনীন মেয়েটিকে যখন শিল্পী নিজের মনের রঙ মিশিয়ে সাজিয়ে বিয়ের আসরে উপস্থিত করেন তখন সে বিশেষ হয়ে যায়। এই বিশেষই শিল্পের ভিত। সুতরাং বিশেষ ও সর্বজনীনের বাস একত্রে। যা বিশেষ তাই সর্বজনীন।

শিল্পের নৈর্ব্যক্তিকতা :
শিল্পে নৈর্ব্যক্তিকতা (Impersonality) থাকা আবশ্যক। নৈর্ব্যক্তিকতা হচ্ছে শিল্পটি দেখে যদি কোনো ব্যক্তি একে পেতে না চায়, তার লোভ না জাগে, শুধু এর সৌন্দর্যবোধ হৃদয়ে জাগে, তবেই তার নৈর্ব্যক্তিকতা আছে বলা যাবে। শুধু মুগ্ধতাই নৈর্ব্যক্তিকতার নিদর্শন, শিল্পে তা অপরিহার্য। শিল্পটি ব্যক্তির জন্য না, সকলের জন্য। আবার ব্যক্তির সমষ্টিই সমাজ।

নৈতিকতা ও শিল্প:
নৈতিকতা মানুষের জীবনের অংশ। সেটাই নীতি যা মানুষের কল্যাণ করে, জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যায়, সুন্দর রাখে। তাই অনৈতিক কোনো বিষয় শিল্পের মধ্যে পড়ে না। ধরা যাক পিকাসোর আঁকা নারীর নগ্ন চিত্রটির কথা। নগ্ন নারী পুরুষকে যৌনতায় আকৃষ্ট করে। কিন্তু প্যারিসের রাজপথে শোভিত এই চিত্রটি নারীর বিশেষ রূপ প্রকাশ করে মানুষকে এক অখণ্ড সৌন্দর্য-রসে ছন্দিত করে, কোনো লোভ জাগায় না, এটা শিল্প। এখানে একটা কথা বলতেই হয় শিল্পগুণ উপলব্ধির জন্য একটি সুস্থ মনের প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে নৈতিকতাও গতিশীল। সমাজের বিকাশের সাথে, চেতনার বিকাশের সাথে বিষয়টি জড়িত। নৈতিকতা শুভ কিছু। আর শুভ ও শিল্প চিরকালই এক অঙ্গে মিশে আছে।

শিল্প, সংযমবোধ এবং অখণ্ড অনুভব :
স্থপতিবিদ্যা, ভাস্কর্য, চিত্রবিদ্যা, সঙ্গীত ও কবিতা, শিল্প এই পাঁচ রকমের। শিল্পী তার ভাবরাজ্যের কামনাকে এই পাঁচ প্রকারে মূর্ত করে তোলেন। কিন্তু অনুভবের যথেচ্ছ প্রকাশ শিল্প নয়। শিল্পীর প্রকাশে সংযমবোধ থাকা চাই। এই সংযমই শিল্পের ছন্দ ও সৌন্দর্য সৃষ্টিতে সহায়ক, শিল্পটিকে প্রাণবন্ত করে। যেখানে সংযম নেই সেখানে এমনটা হয় না। অংশগত সৌন্দর্য শিল্পে সর্বাঙ্গীন সৌন্দর্যবোধ জাগায় না। যে শিল্পী বাইরের সাথে নিজের এবং বিশ্বের সাথে wb‡Ri পরিচয়কে নিবিড় অখণ্ডরূপে অনুভব করে নাই তার শিল্পকর্মে ছন্দোপতন ঘটতে বাধ্য। শ্রেষ্ঠ শিল্প শুধু আমাদেরকে রূপ-সৌন্দর্যে মুগ্ধ করে না, এর মাঝে রূপাতীতের ব্যঞ্জনা থাকে।

বিজ্ঞানের সাথে শিল্পের সম্পর্ক:
শিল্প মানে সৃষ্টি। বিজ্ঞান মানে প্রকৃতির নিয়মসমূহের আবিষ্কার। শিল্পীকে এ দুটোকে মেলাতে হয় তার শিল্পে। রূপ সৃষ্টির জন্য কিছু কৌশল, নিয়ম ও পদ্ধতিকে শিল্পী অনুসরণ করেন, এটাই বিজ্ঞান বা শিল্পরীতি। কবিতা লেখার সময় কবি শব্দ-চয়ন ও ছন্দ-রীতির সাহায্য গ্রহণ করেন। এটাই কবিতার বিজ্ঞান। চিত্রকর ছবি আঁকার সময় রেখা সম্পর্কিত যে পদ্ধতি অবলম্বন করেন সেটাই চিত্রকলার বিজ্ঞান। সুতরাং সৃষ্টির পদ্ধতিকে বলা হয় বিজ্ঞান এবং সৃষ্টিকে শিল্প। এ দুটো পরস্পর সম্পর্কিত। বিজ্ঞান ছাড়া শিল্প রূপায়িত হতে পারে না। আবার শিল্প-সৃষ্টি ব্যতীত বিজ্ঞানের কোনো স্বার্থকতা নেই।

শিল্পরূপ চিরন্তন :
শিল্পের সাথে শিল্পীর কাল জড়িয়ে থাকে। পরিবেশ ও ঐতিহ্যের প্রভাব স্বীকার করতেই হয়। কিন্তু শিল্পে শিল্পীর নিজস্বতাই আসল। শিল্পী নিজের হৃদয়ের রূপ সম্পাদনের জন্য শিল্প সৃষ্টি করেন। তবে আপন মনের রূপ সাধনাই শিল্পের একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে না। দেশ-কালকে অতিক্রম করে শিল্পের মূল্যায়ন হয়। দেশকালাতীত হওয়ার গুণটি শিল্পে থাকতে হবে। বস্তুত শিল্প তার স্রষ্টার মনেরও অতীত হবে। শ্রেষ্ঠ শিল্পী শুধু যুগের প্রতিনিধি নন, তিনি যুগ-সময়ে থেকে যুগের অতীত অর্থাৎ তিনি চিরন্তনকে দেখেন। রবীন্দ্রনাথ, মধুসূদন কাব্যে তাদের পরিবেশ ও সময়কে অতিক্রম করে চিরন্তন হতে পেরেছেন, তাঁরা এমনই এক জীবন-মহিমাকে রূপদান করেছেন। সেজন্য তাঁরা শ্রেষ্ঠ শিল্পী। আর শিল্পের চিরন্তন রূপ দিয়েই সব যুগের শিল্পের ঐক্য প্রতিষ্ঠা হয়।

শিল্পে স্থূলভোগ ও
সূক্ষ্ম আনন্দের মিশ্রণ :
শিল্পের মূল উদ্দেশ্য রূপ সৃষ্টি। কিন্তু যে শিল্পে সৌন্দর্য-সৃষ্টি গৌণ হয়ে মানুষের প্রয়োজন মেটানোর গুরুত্ব অধীক, যেমন- ঘর, মূর্তি, অলঙ্কার এসব কারুশিল্প বা Mechanical Arts হিসেবে চিহ্নিত।
যে শিল্প আমাদের দ্বন্দ্বময় জীবনে যন্ত্রণা-পীড়িত মনকে আনন্দলোকে মুক্তি দেয়, জৈব অপেক্ষা আত্মিক আনন্দের জোগান বেশি দেয় তাকে চারুশিল্প বা Fine Arts বলে চিহ্নিত করা হয়। তবে শিল্পকে এভাবে বিভক্ত করলেও স্থূল ভোগ ও সূক্ষ্ম আনন্দ প্রত্যেক শিল্পে একত্রে বাস করে। যেমন আমাদের জাতীয় সংসদ গৃহকে যখন আইন প্রণয়নে ব্যবহার করি তখন স্থূল ভোগ সম্পাদন হয়। তখন এটি কারুশিল্প। আবার যখন একে সুষম রূপময় সৌন্দর্য-সৃষ্টি হিসেবে দেখি তখনই এটা চারুশিল্প। এটাই শিল্পের দ্বান্দ্বিকতা।

শিল্পী-হৃদয়

শিল্প বিচারের মাপকাঠি :
চিন্তা বস্তুজাত, তাই বস্তুর বাইরে গিয়ে রূপসজ্জা হতে পারে না। শিল্পীর প্রধান অবলম্বন হচ্ছে তার বস্তু বা Matter। কল্পনার ভিত্তি হচ্ছে বস্তু। বস্তু ছাড়া কল্পনা সম্ভব না। বস্তুর ওপর শিল্পীর মানস-স্পর্শই শিল্প। যে শিল্পে মানস-স্পর্শ অধিক তা ততো উন্নত। এই ‍হিসেবে স্থপতিবিদ্যা বা Architecture সর্ব নিম্ন গোত্রের শিল্পকর্ম। যেমন আমাদের জাতীয় স্মৃতিসৌধ যার মধ্যে বস্তুর প্রাধান্যই বেশি। ভাস্কর্য বা Sculture এর চেয়ে উন্নত স্তরের। কারণ ভাস্কর্যে শিল্পী কোনো বস্তুকে, যেমন- ধরা যাক একখণ্ড পাথরকে যেভাবে কেটে তার মনের ভাব ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হন স্থাপত্বে সেটা সম্ভব হয় না। সুতরাং এখানে বস্তুসত্তার চেয়ে রূপসৃষ্টির পরিমাণ বেশি। এর পরের অবস্থান দিতে পারি আমরা চিত্রশিল্পকে। চিত্রশিল্পী তাঁর তুলির স্পর্শে অঙ্কিত চিত্রে হৃদয়কে আরো বেশি ফুটিয়ে তুলতে পারেন। চিত্রশিল্প বা The Art of Painting–এ হৃদয়-স্পর্শের আধিক্যের জন্য এটি আরো উন্নত। তারপর আসে সংগীত বা Music–এর কথা। সঙ্গীতজ্ঞ তাল লয়ের মাধ্যমে সুর ও কথার সাহায্যে শ্রবণেন্দ্রিয়ের ভেতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করেন। এখানে স্থপতিবিদ্যা, ভাস্কর্য, ও চিত্রশিল্পের চেয়ে শিল্পীর মানসস্পর্শ আরো বেশি রাখার সুযোগ আছে। সংগীতে সুর-সুষমাই প্রধান কথা। কিন্তু কবিতা বা সাহিত্যে(Literature)-এ শিল্পী অর্থময় ভাষায় নিজেকে প্রকাশ করে। সঙ্গীতের শব্দাতীত সুর মাধুর্যের চেয়ে কবিতা বা সাহিত্যের শব্দে-গড়া রূপ, শিল্পীর মনোজগৎকে বেশি প্রকাশ করে। একমাত্র কবিই শব্দের সাহায্যে চিত্রকল্পের মাধ্যমে রূপ সৃষ্টি করে সকলের সামনে তুলে ধরেন। শব্দ-ঝংকারে, ইঙ্গিতে, ভাবে, সুর-মাধুর্যে রূপ সৃষ্টি করে শব্দেরও ঊর্ধ্বে উঠে তা আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে। রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন,
তারপরে হাওয়া যেই নেমে যায়,
পাতা-কাঁপা থেমে যায়,
ফেরে তার মনটি-
যেই ভাবে মা যে হয় মাটি তার,
ভালো লাগে আরবার
পৃথিবীর কোণটি।
তখন তালগাছ, চারপাশের পৃথিবী ছাপিয়ে কবিতার শব্দগুলোর ঊর্ধ্বে উঠে কিছু যেনো আমাদের হৃদয়কে নাড়িয়ে দেয়। এজন্য কাব্য বা সাহিত্য শ্রেষ্ঠ শিল্পকলা বলে পরিগণিত।

তবে এটাও স্বীকার করতে হবে যে মানুষ সৌন্দর্যবোধের তাড়নায় নিজের মতো করে বিভিন্ন সরঞ্জাম ব্যবহার করে নানা মাধ্যমে শিল্প সৃষ্টি করে চলেছে। এদিক থেকে কেউ হয়তো কারো চেয়ে ছোট নয়। স্থপতি, ভাস্কর, চিত্রকর, সঙ্গীতজ্ঞ, কবি প্রত্যেকেই আমাদের কাছে বরণীয়। তাই বলতে হয় রূপ সৃষ্টির বেলায় শিল্পীর মানস-স্পর্শই শিল্প-মূল্যায়নের আসল মাপকাঠি। প্রত্যেকেই রূপ সৃষ্টি করে তার মাধ্যমটির দ্বারা এবং মানবজীবনকে অপরূপ সাজায় সামনে এগুতে। শিল্পকলায় শিল্পীর আত্মমুক্তি হয় রূপসৃষ্টির দক্ষতায়।

আমাদের একটা কথা জেনে রাখতে হবে, শিল্প-সৌন্দর্য বোঝতে হলে জনগণের মনোজগতের বিকাশ চাই। এর জন্য শিক্ষাদীক্ষা চাই। সাধারণের উপলদ্ধির কথা বলে শিল্পের মানকে নীচে নামানো যাবে না। মানুষের চেতনাকে অধিকতর সমৃদ্ধ করতে হবে। এ দায়িত্ব সমাজের। শিল্প মানবপ্রাণের মুক্তির একটা পথ, মানবসভ্যতার মাপকাঠি। মানবজাতির ইতিহাস শিল্পকলার সাহায্যে জীবন্ত হয়ে ওঠে।

- Advertisement -spot_img
আরও সংবাদ
- Advertisement -spot_img
এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here