বুধবার, জানুয়ারি ৮, ২০২৫
Homeঅন্যান্যমৃত্যুর ৩১ বছর পর মরণোত্তর একুশে পদক পেলেন কালজয়ী গীতিকার নজরুল ইসলাম...

মৃত্যুর ৩১ বছর পর মরণোত্তর একুশে পদক পেলেন কালজয়ী গীতিকার নজরুল ইসলাম বাবু

নুর এমডি চৌধুরী || বার্তা সম্পাদক

সব ক’টা জানালা খুলে দাও না, একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার এমন বহু জনপ্রিয় গানের গীতিকবি ছিলেন কালজীয় এই গীতিকার নজরুল ইসলাম বাবু। ১৯৯০ সালে ১৪সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

মৃত্যুর ৩১ বছর পর এসে মরণোত্তর একুশে পদক পেলেন এই গীতিকার যিনি দেশের হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেছিলেন দেশ মাতৃকার সেভায়।

বৃহস্পতিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে একুশে পদকের জন্য মনোনীতদের নাম ঘোষণা করা হয়। এতে বলা হয়, সংস্কৃতি অঙ্গনে অবদান রাখায় এবার শিল্পকলা বিভাগে একুশে পদক পাচ্ছেন ৭ জন। তার মধ্যে সংগীতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে মরণোত্তর একুশে পদক পাচ্ছেন অমর গীতিকার জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ থানার কৃতি সন্তান নজরুল ইসলাম বাবু।

নজরুল ইসলাম বাবু ১৯৪৯ সালের ১৭ জুলাই, জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জের চরনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃকবাড়ি একই উপজেলার হেমাড়াবাড়ি গ্রামে। তার বাবার নাম বজলুল কাদের এবং মা রেজিয়া বেগম। বাবা ছিলেন সঙ্গীতানুরাগী।নজরুল ইসলাম বাবু ১৯৬৯ সালে তৎকালীন সময়ে সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজে ছাত্রনেতা হিসেবে বেশ নামডাক ছিল তার।

একসময় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে তিনি কিছুদিন আত্মগোপনে চলে যান ভারতে। সেখানে গিএও তিনি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যোগ দেন।

দেশ স্বাধীন হলে তিনি আবার লেখাপড়া, সাহিত্য ও সংগীতচর্চা শুরু করেন। তার লেখা জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে- সবকটা জানালা খুলে দাও না, একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার, আমায় গেঁথে দাও না মাগো একটা পলাশ ফুলের মালা, পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই, ডাকে পাখি খোল আঁখি, কাল সারারাত ছিল স্বপ্নের রাত, আমার গরুর গাড়ীতে বউ সাজিয়ে, কতো যে তোমাকে বেসেছি ভালো, দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা বন্ধু চিরকাল, কথা বলব না বলেছি, কাঠ পুড়লে কয়লা হয়, এই অন্তরে তুমি ছাড়া নেই কারও নাম, আমার মনের আকাশে আজ জ্বলে শুকতারা, তোমার হয়ে গেছি আমি, কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো ইত্যাদি।

তার লেখা গানগুলো শুনলে আজও নস্টালজিক হন শ্রোতারা। হৃদয়ে ভর করে অন্যরকম ভালোলাগার অনুভূতি। গানগুলো সবার চেনা, কিন্তু এ গানগুলোর গীতিকারকে তা অনেকেরই অজানা? কিংবা এ প্রজন্মের কাছে তার নাম ও কর্ম কতটা তুলে ধরা যাচ্ছে সে প্রশ্নও উঠে আসছে বারবার।

এসব গানের গীতিকার নজরুল ইসলাম বাবু। তিনি ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। অকালমৃত্যু তাকে নতুন প্রজন্মের কাছে বিস্মৃত করলেও তার লেখা অমৃতশোধা গান চিরকালই সব প্রজন্মের শ্রোতার মনের মন্দিরে পূঞ্জিভূত হয়ে রবেন তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

নজরুল ইসলাম বাবু ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে গীতিকার হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। এরপর লিখতে থাকেন অসাধারণ সব গান। ১৯৭৮ সালে সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সঙ্গে প্রথম চলচ্চিত্রে গান লেখা শুরু করেন। তিনি যেসব সিনেমাতে গান লেখেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- আঁখি মিলন, দুই পয়সার আলতা, সাক্ষী, মহানায়ক, নসিব, বউ শাশুড়ি, সুখ, প্রতিরোধ, শুভদা, প্রতিঘাত, উসিলা, চাকর, পদ্মা মেঘনা যমুনা, প্রেমের প্রতিদান, সিপাহি প্রভৃতি। নজরুল ইসলাম বাবুর গানের সংখ্যা ১১৩টি। এর মধ্যে ৫২টি আধুনিক ও ৯টি ধর্মীয় গান।

নজরুল ইসলাম বাবু ১৯৯০ সালে তার ইন্তেকালের পর ১৯৯১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ছবি পদ্মা মেঘনা যমুনার গীত রচনার জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ গীতিকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। আর মৃত্যুর তিন দশক পর ২০২২ সালে পান একুশে পদক।

২০১৭ সালে তাকে নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘নজরুল ইসলাম বাবু স্মারকগ্রন্থ’। গ্রন্থটি সংকলন করেছেন আরেক খ্যাতিমান গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান।

নজরুল ইসলাম বাবু বাংলাদেশ গীতিকবি সংসদের প্রথম কার্যনির্বাহী পরিষদের (১৯৭৮-৭৯) সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ব্যক্তিজীবনে নজরুল ইসলাম বাবু ১৯৮৪ সালে শাহীন আক্তারের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দুই কন্যাসন্তান নাজিয়া ও নাফিয়া।
গানটা আসছিল না কিছুতেই। অথচ কিছুদিন পর রেকর্ডিং, নাটকে গানটি ব্যবহার করা হবে। আশির দশকের গোড়ার দিকের কথা। পবিত্র কোরবানির ঈদের পরদিন। সকালে চালের রুটি ও মাংস দিয়ে নাশতা করে রিকশায় বের হয়েছিলেন দুই বন্ধু। মালিবাগ রেলক্রসিংয়ে হঠাৎ ট্রেন এল। রিকশা থামল। ঝিকঝিক আওয়াজে ট্রেন যাচ্ছিল। হঠাৎ চোখমুখ বড় হয়ে গেল নজরুল ইসলাম বাবুর। সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে সব কটি সিগারেট ফেলে দিলেন। প্যাকেটর সাদা কাগজে লিখলেন, ‘দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা বন্ধু চিরকাল/ রেললাইন বহে সমান্তরাল বহে সমান্তরাল…। রিকশায় বসে পুরো গান লেখা হয়ে গেল।

গল্পটা সুরকার মোহাম্মদ শাহনেওয়াজের কাছ থেকে শোনা। গল্পের নায়ক নজরুল ইসলাম বাবু এমনই সৃষ্টিশীল গানানুরাগী ছিলেন, যাঁর আত্মার সঙ্গে যেন গান মিশে ছিল। স্বাধীনতাস্তম্ভ বাংলা গানের ভুবনে যিনি ফুল হয়ে ফুটেছিলেন, নাইট কুইনের মতো, দ্রুতই ঘ্রাণ ছড়িয়ে ঝরে গেলেন অকালে।

শেখ সাদী খান আর নজরুল ইসলাম বাবু মিলে অনেক জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে এমন অনেক গানের আড্ডা কিংবা গান বিষয়ে আলোচনায় সংশ্লিষ্টদের বলতে শুনেছি, নজরুল ইসলাম বাবু অকালে চলে যাওয়া দেশের সংগীতভুবনে জন্য বড় ক্ষতি। এ ক্ষতি অপূরণীয়। যদিও জন্মদিন এবং পরের এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও বাবুকে আনুষ্ঠানিক বা আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ স্মরণ করতে দেখিনি। তাঁর নাম নিতে শোনা যায়নি এফডিসিতে, শিল্পকলায় বা সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানে।

অনেক কষ্টে মিলল পরিবারের সদস্যদের নম্বর। ১৭ জুলাই নজরুল ইসলাম বাবুর জন্মদিনেই কথা হয় তাঁর স্ত্রী শাহীন আক্তারের সঙ্গে। ১৯৮৪ সালের ২৩ নভেম্বর তাঁদের বিয়ে হয়। কেউ মনে না রাখলেও তাঁরা ঠিকই মনে রেখেছেন প্রিয় মানুষটির জন্মদিন। পারিবারিকভাবে ছোট পরিসরে কেক কেটে পালন করেছেন দিনটি। বাসাবোতে মেয়ে-নাতনিকে নিয়ে থাকেন তিনি। সেখানে গিয়ে বাসায় গিয়ে দেখা গেল ড্রয়িংরুমে ছবিতে বাবুর নানা রঙের উপস্থিতি। শোকেসে পাশাপাশি রাখা বেশ কিছু পদক। সব পরিপাটি করে সাজানো। নেই শুধু সেই মানুষটি। পারিবারিক অ্যালবামে তাঁর বেশ কিছু ছবি দেখি। পরিবারের সদস্য আর পরিচিতজনদের কাছ থেকে গল্প শুনি।

বাবা বজলুল কাদের ছিলেন স্কুলশিক্ষক। মা রেজিয়া বেগম গৃহিণী। বাবা বজলুল কাদেরের সংগীতের প্রতি অনুরাগ ছোটবেলা থেকেই বড় সন্তান নজরুল ইসলাম বাবুকে প্রভাবিত করে। চার ভাই, পাঁচ বোনের মধ্যে বাবু ছিলেন সবার বড়। স্থানীয় স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে মামার কর্মস্থল বরিশালে চলে যান। বরিশাল বি এম স্কুল অ্যান্ড কলেজে মাধ্যমিক এবং পরে জামালপুরের আশেক মাহমুদ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও বিএসসি ডিগ্রি নেন।

বরাবরই অন্যদের চেয়ে একটু আলাদাই ছিলেন। যখন স্কুল-কলেজে বিদ্যুতের সংযোগ পৌঁছায়নি, বিজলিবাতি জ্বলেনি, তখনো কলেজের হোস্টেলে মধ্যরাত অবধি জেগে হারিকেন জ্বালিয়ে সাহিত্যের আড্ডা জমাতেন বাবুরা। আশেক মাহমুদ কলেজের অধ্যাপক মো. মজিবর রহমান স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘বাবুর নামটা শুনলেই চেহারাটা জীবন্ত ভেসে ওঠে। মাঝারি আকৃতির তরুণ। ওষ্ঠে গোঁফ, মুখটা কিন্তু কচি। চোখ ডাগর নয়, মায়াবী আবেশে পরিপূর্ণ। দেখলে মনটা কেমন আহ্লাদে ভরে যায়।’ ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির সঙ্গে জড়িয়ে যান তিনি। জড়িয়ে যান রাজনীতিতে।

অস্ত্র ধরেছিলেন দেশের জন্য তখন ২১ বছরের টগবগে তরুণ নজরুল ইসলাম বাবু। দেশে তখন মুক্তির লড়াইয়ের প্রস্তুতি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আন্দোলন চলছে। সে সময়, অর্থাৎ ১৯৬৯ সালে সালে তৎকালীন সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজের ছাত্রনেতা হিসেবে বেশ নামডাক তাঁর। কলেজশিক্ষক অধ্যাপক দুর্গাদাস ঘোষ স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘উনসত্তর সত্তরের সেই দিনগুলোতে তার লেখায় কেমন যেন অস্থিরতা পাওয়া যেত। এমনিতে সে ছিল স্বভাবকবি। স্বদেশভাবনা তার কাব্যচেতনায় মুক্তির আন্দোলনের সময় যথেষ্ট প্রগাঢ়তা পেয়েছিল।’

সব কটা জানালা খুলে দাও না’, ‘একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার’, ‘আমায় গেঁথে দাও না মাগো একটা পলাশ ফুলের মালা’, কিংবা ‘পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’—অসাধারণ গানগুলোর শিল্পীর নাম সবাই জানলেও এ প্রজন্মের বেশির ভাগ মানুষ জানেন না এর স্রষ্টার নাম। তিনি নজরুল ইসলাম বাবু। বেশ কিছু জনপ্রিয় গানের গীতিকারের ৭০তম জন্মদিন চলে গেল নীরবে। তাঁকে স্মরণ করা হয়নি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনে। যেমনটি হয়নি রাষ্ট্রীয় মূল্যায়ন।

গানটা আসছিল না কিছুতেই। অথচ কিছুদিন পর রেকর্ডিং, নাটকে গানটি ব্যবহার করা হবে। আশির দশকের গোড়ার দিকের কথা। পবিত্র কোরবানির ঈদের পরদিন। সকালে চালের রুটি ও মাংস দিয়ে নাশতা করে রিকশায় বের হয়েছিলেন দুই বন্ধু। মালিবাগ রেলক্রসিংয়ে হঠাৎ ট্রেন এল। রিকশা থামল। ঝিকঝিক আওয়াজে ট্রেন যাচ্ছিল। হঠাৎ চোখমুখ বড় হয়ে গেল নজরুল ইসলাম বাবুর। সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে সব কটি সিগারেট ফেলে দিলেন। প্যাকেটর সাদা কাগজে লিখলেন, ‘দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা বন্ধু চিরকাল/ রেললাইন বহে সমান্তরাল বহে সমান্তরাল…। রিকশায় বসে পুরো গান লেখা হয়ে গেল।

গল্পটা সুরকার মোহাম্মদ শাহনেওয়াজের কাছ থেকে শোনা। গল্পের নায়ক নজরুল ইসলাম বাবু এমনই সৃষ্টিশীল গানানুরাগী ছিলেন, যাঁর আত্মার সঙ্গে যেন গান মিশে ছিল। স্বাধীনতাস্তম্ভ বাংলা গানের ভুবনে যিনি ফুল হয়ে ফুটেছিলেন, নাইট কুইনের মতো, দ্রুতই ঘ্রাণ ছড়িয়ে ঝরে গেলেন অকালে।

১৭ জুলাই ক্ষণজন্মা এই গুণী মানুষের জন্মদিন ছিল। ১৯৪৯ সালের ১৭ জুলাই জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জের চরনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন নজরুল ইসলাম বাবু। বেঁচে থাকলে তিনি ৭০ ছুঁতেন।

না, বাবুর ৭০ পূর্ণ হয়নি। তিনি ফিরে গেছেন অজানায়, ১৯৯০ সালে ১৪ সেপ্টেম্বর চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। তখন মাত্র ৪১ বছর বয়স ছিল তাঁর। মহাকাল তাঁকে বেশি দূর যেতে দেয়নি ঠিকই, কিন্তু নজরুল ইসলাম বাবু সেই মানবসন্তান, যিনি হয়ে উঠেছেন কালোত্তীর্ণ। এই বাংলায় তিনি প্রতিদিন ফিরে আসেন, সকাল-সন্ধ্যায়। ফিরে আসেন গানের চরণে, শব্দে। কেননা, তাঁর লেখা গান ও স্মৃতি আজও শ্রোতাদের মননে স্থায়ী হয়ে আছে।

এমন অনেক গানের আড্ডা কিংবা গান বিষয়ে আলোচনায় সংশ্লিষ্টদের বলতে শুনেছি, নজরুল ইসলাম বাবু অকালে চলে যাওয়া দেশের সংগীতভুবনে জন্য বড় ক্ষতি। এ ক্ষতি অপূরণীয়। যদিও জন্মদিন এবং পরের এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও বাবুকে আনুষ্ঠানিক বা আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ স্মরণ করতে দেখিনি। তাঁর নাম নিতে শোনা যায়নি এফডিসিতে, শিল্পকলায় বা সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানে।

অনেক কষ্টে মিলল পরিবারের সদস্যদের নম্বর। ১৭ জুলাই নজরুল ইসলাম বাবুর জন্মদিনেই কথা হয় তাঁর স্ত্রী শাহীন আক্তারের সঙ্গে। ১৯৮৪ সালের ২৩ নভেম্বর তাঁদের বিয়ে হয়। কেউ মনে না রাখলেও তাঁরা ঠিকই মনে রেখেছেন প্রিয় মানুষটির জন্মদিন। পারিবারিকভাবে ছোট পরিসরে কেক কেটে পালন করেছেন দিনটি। বাসাবোতে মেয়ে-নাতনিকে নিয়ে থাকেন তিনি। সেখানে গিয়ে বাসায় গিয়ে দেখা গেল ড্রয়িংরুমে ছবিতে বাবুর নানা রঙের উপস্থিতি। শোকেসে পাশাপাশি রাখা বেশ কিছু পদক। সব পরিপাটি করে সাজানো। নেই শুধু সেই মানুষটি। পারিবারিক অ্যালবামে তাঁর বেশ কিছু ছবি দেখি। পরিবারের সদস্য আর পরিচিতজনদের কাছ থেকে গল্প শুনি।

বাবা বজলুল কাদের ছিলেন স্কুলশিক্ষক। মা রেজিয়া বেগম গৃহিণী। বাবা বজলুল কাদেরের সংগীতের প্রতি অনুরাগ ছোটবেলা থেকেই বড় সন্তান নজরুল ইসলাম বাবুকে প্রভাবিত করে। চার ভাই, পাঁচ বোনের মধ্যে বাবু ছিলেন সবার বড়। স্থানীয় স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে মামার কর্মস্থল বরিশালে চলে যান। বরিশাল বি এম স্কুল অ্যান্ড কলেজে মাধ্যমিক এবং পরে জামালপুরের আশেক মাহমুদ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও বিএসসি ডিগ্রি নেন।

বরাবরই অন্যদের চেয়ে একটু আলাদাই ছিলেন। যখন স্কুল-কলেজে বিদ্যুতের সংযোগ পৌঁছায়নি, বিজলিবাতি জ্বলেনি, তখনো কলেজের হোস্টেলে মধ্যরাত অবধি জেগে হারিকেন জ্বালিয়ে সাহিত্যের আড্ডা জমাতেন বাবুরা। আশেক মাহমুদ কলেজের অধ্যাপক মো. মজিবর রহমান স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘বাবুর নামটা শুনলেই চেহারাটা জীবন্ত ভেসে ওঠে। মাঝারি আকৃতির তরুণ। ওষ্ঠে গোঁফ, মুখটা কিন্তু কচি। চোখ ডাগর নয়, মায়াবী আবেশে পরিপূর্ণ। দেখলে মনটা কেমন আহ্লাদে ভরে যায়।’ ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির সঙ্গে জড়িয়ে যান তিনি। জড়িয়ে যান রাজনীতিতে।

অস্ত্র ধরেছিলেন দেশের জন্য তখন ২১ বছরের টগবগে তরুণ নজরুল ইসলাম বাবু। দেশে তখন মুক্তির লড়াইয়ের প্রস্তুতি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আন্দোলন চলছে। সে সময়, অর্থাৎ ১৯৬৯ সালে সালে তৎকালীন সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজের ছাত্রনেতা হিসেবে বেশ নামডাক তাঁর। কলেজশিক্ষক অধ্যাপক দুর্গাদাস ঘোষ স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘উনসত্তর সত্তরের সেই দিনগুলোতে তার লেখায় কেমন যেন অস্থিরতা পাওয়া যেত। এমনিতে সে ছিল স্বভাবকবি। স্বদেশভাবনা তার কাব্যচেতনায় মুক্তির আন্দোলনের সময় যথেষ্ট প্রগাঢ়তা পেয়েছিল।’

একদিন তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে তৎকালীন সামরিক জান্তা। একসময় তিনি আত্মগোপন করেন। চলে যান ভারতে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ক্যাম্পে যোগ দেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ১১ নম্বর সেক্টরে তুরার পাহাড়ে বসে যুদ্ধপ্রশিক্ষণের অবসর মুহূর্তে গান লিখতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্যাম্পের ভয়ংকর এবং কঠোর জীবন নজরুল ইসলাম বাবুকে পরবর্তী সময়ে সম্পূর্ণ কবি করে তোলে। ট্রেনিং শেষে দেশে ফিরে দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মসি ও অসি দুটোই সমান চালানোয় দারুণ দক্ষ ছিলেন বাবু। তাঁর অন্যতম দায়িত্ব ছিল বিস্ফোরক দিয়ে ভারী ও মজবুত পুল বা ব্রিজ ধ্বংস করে হানাদারদের যোগাযোগবিচ্ছিন্ন করা। দেশ স্বাধীন হলে তিনি আবার লেখাপড়া, সাহিত্য ও সংগীতচর্চা শুরু করেন।

যুদ্ধ শেষে আবার লেখাপড়ায় ফিরে গিয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে আশেক মাহমুদ কলেজ থেকে বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। চলে আসেন ঢাকায়। এসেছিলেন কবি হতে। একদিন শাহবাগের বেতার ভবনে পরিচয় সেখানকার কর্মকর্তা শেখ সাদী খানের সঙ্গে। আবুল মিয়ার ক্যানটিনে। পকেট থেকে বের করে একটা গান দিলেন শেখ সাদীকে—‘আলো আর এমনি আলো হাজার দুয়ার খুলে গেল।’ খুব পছন্দ হলো শেখ সাদী খানের। পরের রোববার আসার পরামর্শ দিলেন। বাবু শিল্পী সুখেন্দু চক্রবর্তীর জন্য লিখলেন, ‘না দেখাই ছিল বুঝি ভালো’ গানটি। প্রথম গানটি সফল। ব্যস, জুটি হয়ে গেল সুরকার শেখ সাদী খান আর গীতিকার নজরুল ইসলাম বাবুর।

দুজন মিলে গান করতে থাকেন। শাহবাগের বেতারে, রমনা পার্কে, মহিলা সমিতির পাশে ব্যাংকের সিঁড়িতে। একে একে সৃষ্টি হয় সুবীর নন্দীর ‘হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে’, শাম্মী আকতারের কণ্ঠে ‘মনে হয় হাজার ধরে দেখি না তোমায়’, আশা ভোসলে ও বেবী নাজনীনের ‘কাল সারা রাত ছিল স্বপনেরও রাত’, কুমার শানুর কণ্ঠে ‘আমার মনের আকাশে আজ জ্বলে শুকতারা’, হৈমন্তী শুক্লার কণ্ঠে ‘ডাকে পাখি খোল আঁখি’—এমন জনপ্রিয় সব গান। সেসব স্মৃতিচারণা করে শেখ সাদী খান বলেন, ‘স্বাধীনতার পরে যেকজন গীতিকার বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করেছেন, নজরুল ইসলাম বাবু ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর অকালে চলে যাওয়া আমাদের সংগীতাঙ্গন যে বিশাল ক্ষতি হয়েছে, তা বলে প্রকাশ করা যাবে না।’

স্বল্প জীবনকালে নজরুল ইসলাম বাবু সবচেয়ে বেশি গান করেছেন সুরকার শেখ সাদীর সঙ্গে। মূলত, আধুনিক গানগুলোই তাঁর সঙ্গে করা। ওই সময়ে নজরুল ইসলাম বাবু ও শেখ সাদী খান এবং আলাউদ্দিন আলী ও মনিরুজ্জামান দুটি জনপ্রিয় জুটি হয়েছিল দেশের সংগীতাঙ্গনে।

এক হাতে তিনি লিখেছেন ‘দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা বন্ধু চিরকাল’, ‘কথা বলব না বলেছি, শুনব না শুনেছি’, ‘কাঠ পুড়লে কয়লা হয় আর কয়লা পুড়লে ছাই’, ‘পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’, ‘কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো, সে কথা তুমি যদি জানতে’, ‘আমার মন কান্দে ও আমার প্রাণ কান্দে’সহ অনেক গান। তাঁর গান গেয়েছেন বশীর আহমেদ, সৈয়দ আব্দুল হাদী, আশা ভোসলে, সুবীর নন্দী, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীন, শাম্মী আখতার, দিলরুবা খান, বেবী নাজনীন, সুখেন্দু চক্রবর্তী, অ্যান্ড্রু কিশোর, কুমার বিশ্বজিৎ, শুভ্র দেব, কুমার শানুসহ অনেকেই।

বাবুর ৭০ পূর্ণ হয়নি। তিনি ফিরে গেছেন অজানায়, ১৯৯০ সালে ১৪ সেপ্টেম্বর চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। তখন মাত্র ৪১ বছর বয়স ছিল তাঁর। মহাকাল তাঁকে বেশি দূর যেতে দেয়নি ঠিকই, কিন্তু নজরুল ইসলাম বাবু সেই মানবসন্তান, যিনি হয়ে উঠেছেন কালোত্তীর্ণ। এই বাংলায় তিনি প্রতিদিন ফিরে আসেন, সকাল-সন্ধ্যায়। ফিরে আসেন গানের চরণে, শব্দে। কেননা, তাঁর লেখা গান ও স্মৃতি আজও শ্রোতাদের মননে স্থায়ী হয়ে আছে।

১৯৯০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ইন্তেকাল করেন তিনি। মত্যুকালে এই গুণী মানুষটির বয়স হয়েছিল মাত্র ৪১ বছর।

- Advertisement -spot_img
আরও সংবাদ
- Advertisement -spot_img
এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here