দেশটার জন্য বড় মায়া হয়। আমার জন্ম ১৯৭১সালে। জন্মের পর শুনেছি দেশ ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছে। আর একটু বুঝবান হলে স্বচক্ষে দেখেছি গ্রামের ৯০ ভাগ মানুষের জীবন জীবিকা ছিল বড়ই দুর্বিসহ।
গমের ভাত, প্যারারগুড়া, ভেমটে কলা সিদ্ধ, মিষ্টি আলু সিদ্ধ এসবই ছিল নিত্য দিনের খাবার। তারপরও এসব ছিল অপ্রতুল্য। আর ভাত কিবা মাছ সে ছিল বড়লোক কিংবা মোড়লদের রমরমা খাবার। তৎকালীন সময়ে এই ৯০ ভাগ অভাবগ্রস্ত মানুষগুলোর জীবন জীবিকা নিয়ে খেলা করতো গ্রামের শাসক শোষক মোড়লগণ। অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে ইচ্ছে মত কাজে লাগাইতো, ইচ্ছেমতো পারিশ্রমিক নির্ধারণ করতো, ইচ্ছেমতো মনের আনন্দে তাদের পরিবার পরিজনের দুঃখদুর্দশা নিয়ে পরিহাস তামাশা করতো।
সেকালে রাষ্টপ্রধানগণের জীবন জীবিকাও মনে হয় এতোটা বিলাস বহুলে ছিলোনা। যুদ্ধ করে জমিদার হটিয়েছিল কিন্ত সেই জমিদারিত্ত দখল করেনিয়েছিল প্রত্যেকটি অঞ্চলের মোড়লগণ। দিনভর কাঁঠফাঁটা রোদ্রে ঘেমে অথবা বৃষ্টিতে ভিজে কাজ করার পর দিন শেষে পাঁচ টাকা মাইনে দেওয়া হতো তাও আবার সপ্তাহে দুই দিন। এলাকা ভেদে যে দুইদিন হাটবাজার বসতো।
সেকালে চোর ডাকাতদের বেপক পদচারণা ছিলো কারণ একদিকে অভাব অনটন অন্যদিকে মোড়লদের অযাচিত অবিচার অত্যাচারে ক্ষুব্ধ হয়ে এদের মধ্য থেকে যারা একটু দুঃসাহসী ছিল তারাই বেঁছে নিয়েছিল চুরি ডাকাতির মত ঘৃণিত পেশাকে। সেকালে দেখতাম অহরহ চোর ধরা, চোর মারা, চোরের হাত ভেংগে দেওয়া, বট গাছের ডালে বেঁধে ইচ্ছেমতো পিটানো। উহঃ কিভাবে যে সহ্য করতাম সে সব করুন দৃশ্য গুলোকে এখনও মনে হলে গাঁ শিহরিয়ে উঠে।
আমি তখন ছোট। পশ্চিম পাড়ার নামকরা এক চোরকে শুনলাম ধরে এনে বাজারের ভিতরের একটা বটগাছের ডালে বেঁধে ব্যাপক প্রহার করা হচ্ছে। দৌঁড়ে গেলাম দেখতে। মানুষ আর মানুষ। বড় মানুষদের ভীড়ে ছোট মানুষদের সে দৃশ্য অবলোকন করার সুযোগ মেলা ভার। তবুও দেখতেই হবে আমাকে। খুব কষ্ট করেই একটা দোকান ঘরের চালে উঠে গেলাম। দিব্বি ঝুলছে সেই চোরটা। পা দুইটা উপরে বেঁধে ইচ্ছেমতো পেটাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর এলেন গ্রামের একজন প্রতাপশালী মোড়ল পরবর্তীতে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। উনার হাতে ছিল একটা বেতের ছড়ি দেখলাম হাটিহাটি পাপা করে চোরের পাশে এসে দাঁড়াতেই নিশ্চুপ চোরটি যেন সজাগ হয়ে উঠলো। হাউমাউ চীৎকার দিয়ে বলতে লাগলো আমাকে যত পারেন মারেন কিন্তু বেতের ছড়িটা দিয়ে মারবেন না। কি আছে ঐ বেতের ছড়িতে?
পরবর্তীতে জেনেছিলাম ঐ বেতের ছড়ির ভিতরে একটা বিষাক্ত ছুরি লোকানো ছিল। যা শরীরে একবার পুচ দিলেই অবধারিত মৃত্যু সত্যিকার অর্থে সেকালে অগণিত মানুষেরা অসম্ভব মানবেতর জীবন যপন করত। পরিবার পরিকল্পনার কোন প্রচার প্রচারণা ছিলনা তাই প্রত্যেক ঘরে ঘরেই চার পাঁচটা কিংবা তারও অধিক ছেলেমেয়ে থাকতো আর অধিকাংশ পরিবারে উপার্জনক্ষম মানুষ থাকতো একটি। কোন কোন পরিবার আবার উপার্জন ক্ষম মানুষই থাকতোনা। সে সব পরিবারের লোকেরা বেঁছে নিতে বাধ্য হতো ভিক্ষাবৃত্তি নামক পেশাকে।
বলছিলাম দিনমজুরদের পারিশ্রমিক এর কথা। এই অল্প উপার্জনে কিভাবে দিন চলতো তা সে সব পরিবারের সদস্যদের চোখ মুখে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে যেতো যে এরা না জানি কত ক্ষুধার্ত। আমরা তখন সবে মাত্র প্রাথমিক স্কুল পেরিয়ে হাইস্কুলে পদার্পন করেছি। এই হাইস্কুলে পদার্পনের সময় কালেই দেখেছি কত বন্ধুকে লেখাপড়া থেকে ঝড়ে যেতে। কেউ ক্লাস থ্রী থেকে ক্লাস ফোরে উত্তীর্ণ হতে না হতেই পড়ালেখা বন্ধ বাবার সাথে দিন মজুরের কাজে যোগদান।
কেউ মাঝিদের নৌকায় মাছ ধরার পেশায় কেই আবার কাঠমিস্ত্রী কামার কুমার তাতী ইত্যাদি পেশায়। আমরা যারা হাইস্কুলে অধ্যায়ণ করছি তারা অধিকাংশই গ্রামের ছোট বড় মোড়লদের পোলাপান। কিন্তু আমরা অধিকাংশ ছাত্ররাই মানবিক ছিলাম। মনে মনে মোড়লদের অত্যাচারের কথা ভাবতাম এবং প্রায় সময়ই দরিদ্রদের জীবন জীবিকা নিয়ে বন্ধুরা রাত্রে নির্জনে নদীর ঘাটে বসে বসে আলোচনা করতাম।
কোন উপায় বের করতে পারতাম না।
দরিদ্র মানুষগুলো যারা ভিক্ষাবৃত্তিতে জীবন যাপন করতো মাঝে মধ্যে তাদের জন্য আমরা বন্ধুরা যার যার ঘর থেকে চাল চুরি করে আনতাম দশ বারো জনের চাল একসাথ করলে অনেক হয়ে যেতো। এগুলো বেশী অভাবগ্রস্ত যারা তাদের দুই তিনজন কিংবা তারোধিক পরিবারদেরকে দিতাম। মোড়লগণ ক্ষমতাবলে নদীগুলোও শাসন করতো। দরিদ্ররা মাছ ধরে যে একটু আমিষের অভাব মিটাবে তারও উপায় ছিলোনা।
বর্ষাকালে মোড়লরা নদীতে বাঁধ দিয়ে জাল পেতে রাতভর মাছ ধরতো। ড্রামকে ড্রাম মাছের খেলা। এরা আবার সকাল বেলায় ভাগাভাগি করে নিতো। এতো মাছ নষ্ট হতো যে পঁচা মাছের দুঃগন্ধে কলেরার উপদ্রুব পর্যন্ত হতো অসংখ্য মানুষও মারা যেতো তবু তারা মাছগুলো গরীবদের ধরতে দিতোনা।
আমরা মোড়লদের বিরোধিতা করার সাহস পেতাম না কারণ তারা আমাদের মধ্যেই কারও না কারও বাবা কারও চাচা কারও জেঠা। তো আমরা যা করতাম বন্ধুরা মিলেমিশে খুব সাবধানে যুক্তি বুদ্ধি করেই করতাম। ড্রাম ভর্তি যে মাছ থাকতো সেটা পাহারা দিতে মোড়লগণ একজন কাজের ছেলে নিয়োজিত করতো। আমরা কি করতাম ঐ কাজের চেলেটাকে রাতের বেলায় রীতিমতো পাহারা দিতাম এবং যখন দেখতাম ঘুমে ঢলে পড়ছে ঠিক তখনই ড্রাম থেকে ইচ্ছেমতো মাছ নিয়ে আসতাম এবং রাতারাতি লাউ পাতা ছিঁড়ে মাছ ভর্তি করে দরিদ্র মানুষগুলোর ঘরের ভাংগা বেড়ার ফাঁক দিয়ে দিয়ে আসতাম। মোড়লদের লাউ গাছে ঝুলে থাকা অসংখ্য লাউও ছিড়তাম সাথে সাথে এবং দরিদ্রদের ঘরে একই কায়দায় ঢুকিয়ে দিয়ে আসতাম। দরিদ্ররা বুঝতে পারতো এসব আমাদের কাজ।
মোড়লদের প্রতি অসন্তোষ হয়ে এও করতাম রাতে মোড়লদের মাটির চুলাগুলো ইচ্ছেমতো ভেংগে দিয়ে আসতাম যদিও সে সব মেরামত করতে আমাদেরই মা চাচীরা কষ্ট করতো। কিন্ত সকাল হলে নাস্তাটা যখন মোড়লগণ না পেতো ক্ষিদেয় উস ফিস করতো। আমরা এটাই বুঝাতে চেষ্টা করতাম যে ক্ষিদের কষ্ট কি জিনিস দ্যাখো। কিন্তু অন্ধরা কি আর দেখতে পায়। দিন যেতে লাগলো।
যতই বড় হতে লাগলাম মানবতার দিকগুলো বিবেকের কাঁঠগড়ায় দাঁড় করাতে লাগলাম। বন্ধুরা মিলে কল্যাণ মূলক সংগঠণ করলাম। নানা কায়দা কৌশল করে মোড়লদের কাছ থেকে কখনও কখনও রাজনৈতিক নেত্রীবৃন্দকে অতিথি করে এলাকার মধ্যে যারা দানবীয় ছিলেন সে সকল ব্যক্তিবর্গকে মঞ্চে অতিথি করে টাকা পয়সা সংগ্রহ করতাম এবং সেই টাকা গ্রামের যে সকল দরিদ্র বাবা মা মেয়ের বিয়েতে খরচ করতে নিরুপায় ছিলেন কিংবা যে সকল দরিদ্র বাবা মা ছেলে মেয়েকে পড়াশোনা করাতে অক্ষম ছিলেন তাদেরকে সহযোগিতা করতে শুরু করলাম।
কেঁটে গেছে অর্ধশত বছর। দরিদ্র মানুষগুলো জীবনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে পরিবর্তন এনেছিল বেশ। যে গ্রামে একটাও টিনের ঘর দেখা যেতোনা সে গ্রাম জুড়ে এখন শুধু বিল্ডিং আর বিল্ডিং। ভালোই চলছিল জীবন। কিন্ত সরকারের নানামুখী অপকর্মে আজ দেশটা বৈদেশিক নানামুখী ঋনে জর্জরিত। দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাঁচার। ব্যাংক খাত শুন্যের কোঁঠায়। গুম, খুন, মিথ্যে মামলা, ধর্ষণ, লুটপাট, ভুমি দখল নানাবিধ অপকর্মে সরকারের ছত্রছায়ায় থাকা নেতাগুলোর অপকর্মে আজ দেশটা মেরুদণ্ডহীন হয়ে পড়েছে। মানুষের মানবতাও যেন আজকাল দেখা যায়না।