বৃহস্পতিবার, জানুয়ারি ৯, ২০২৫
Homeসাহিত্যছাত্রধরা

ছাত্রধরা

নুর এমডি চৌধুরী

খুব সম্ভব আশির দশকের শেষের দিকের ঘটনা। বন্যার সময়। পুরো গ্রামে পানিতে থৈথৈ করছে তবে অতিমাত্রার বন্যাটা তখনও শুরু হয়নি। গ্রামের রাস্তাঘাট এমনিতেই ভালো থাকেনা তার মধ্যে বন্যার পানি টৈটৈ করছে তাই ক’দিন ধরে বিদ্যালয়ে যাওয়া হয়না। হঠাৎ খবর এলো ছাত্র ধরা শুরু হয়েছে। কেন হঠাৎ ছাত্র ধরা। কি হয়েছে যে পুলিশ ছাত্র ধরতে শুরু করেছে। রীতিমত সবার মুখে আলোচনার ঝড় উঠে গেলো। এতদিন শুনে এসেছি ছেলে ধরা আছে। তা ঠিক এই সময়টাতেই হয়। যখন পুরো গ্রাম-জুড়ে পাট চাষের মৌসুম শুরু হয় ঠিক সেই সময়টাতে পাট গাছ গুলো বড় হয়ে উঠে। এই সময়টাতে কুচক্রকারীরা গ্রামে ঢুকে পড়ে এবং ছোট ছোট ছেলে মেয়েদেরকে লজেন্স কিংবা আকর্ষণীয় বস্তুর লোভ দেখিয়ে কব্জা করে ফেলে অবুঝ শিশুদের এবং দ্রুত পাটক্ষেতে ঢুকে যায়। যদিও ঘটনা কোন দিন স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তবে এই সময়টাতে ছেলে ধরার ব্যপক আতংক মানুষের মনে কাজ করে।

এমন আতংকের খবর কানে এলে মনটা খুব খারাপ হয়ে যেতো। নিজেকে অপরাধী মনে হতো খুব। তাই বন্ধুরা মিলে পরামর্শও করতাম এর কিছু একটা বিহিত করা যায় কিনা। কিন্তু পরামর্শ গুলো পরামর্শই থেকে যেতো সন্ধ্যা নেমে আসার সাথে সাথে আমাদের পরিকল্পনাগুলোও আঁধারে ঢেকে যেতো। তবে কল্যাণ সমিতি নামে গ্রামে অনেকগুলো সমিতি ছিল কিন্তু এদের দ্বারাও কারও কোন কল্যাণ হয়েছিল বলে চোখে পড়ে নাই। আমাদের গ্রামের নাম গুনারীতলা। গ্রামটি উপজেলা থেকে প্রায় ৫ কিলো পূর্বে জেলা শহরের দিকে। সে সুবাদে নয় শুধু বড় বড় নেতৃস্থানীয় লোক ছিল এই গ্রামে এবং এ গ্রামের মানুষের মধ্যে একটা ঐক্য ছিল। পাড়ায় পাড়ায় গোত্র ভেদে একজন নির্ধারিত দলনেতা থাকতো যাকে গ্রাম্য ভাষায় মাতাব্বর বলা হতো। এক এক মাতাব্বরের নেতৃত্বে এক এক পাড়া নিয়ন্ত্রিত হতো।গুনারীতলা গ্রামের পাড়া ছিল সাতটা কোথাও কারও বড় ধরনের বিপদ দেখা দিলে পুরো সাত পাড়ার লোক এক হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তো।

তৎকালীন সময়ে আমাদের গ্রামে অনেকের মধ্যে দুইজন তুখোড় ছাত্রনেতা ছিলেন। এরা যেমন সাহসী তেমনি বিচক্ষণতা এবং দেহ গতরেও সুঠাম দেহের অধিকারী ছিলেম। এর মধ্যে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া বন্ধ করে চলে আসেন গ্রামে এবং মাদারগঞ্জ এএইচজেড় সরকারি কলেলে ভর্তি হন উদ্যেশ্য ভিপি নির্বাচন করা। যথাসময়ে ভিপি নির্বাচন সংঘটিত হলে তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং বিপুল সমর্থনে ভিপি নির্বাচিত হন। নির্বাচন শেষ হয়েছে প্রায় তিন চার মাস হবে এরই মধ্যে তিনি উপজেলায় একটা বড় ধরনের অনিয়মের খবর পাম ছুটে যান মিছিল নিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যানকে ঘিরে ফেলেন। অনিয়মের বিষয়টি জানতে চাইলে উপজেলা চেয়ারম্যান ছাত্রদের উপর চড়াও হন এতে ছাত্ররা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে বাকবিতণ্ডার মাঝে দুস্কৃতিমনা কে বা কারা উপজেলা ভবনে আগুন লাগিয়ে দিলে প্রশাসনের টনক নড়ে। ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলেও এরই মধ্যে উপজেলার অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আর সেই সূত্র ধরেই শুরু হয় ছাত্র ধরা। প্রথমে বিশ্বাস করছিলাম না।

কিন্তু পরে যখন দেখলাম আমাদের এক চাচা পুলিশের কবলে নির্যাতিত হয়ে ফিরে এসেছেন তখন সবাই আমাদেরকে সাবধানে থাকার পরামর্শ দিলেন। প্রতিদিন পুলিশের গাড়ি আসতে শুরু করলো এবং গ্রাম, পাড়া, মহল্লার আনাচে কানাচে তছনছ করা শুরু করলো। অতিষ্ঠ করে তুললো আমাদের। ঠিক মত খাওয়া নেই, ঘুম নেই, গোসল নেই। কখনও কখনও এমনও হয়েছে যে ভাতটা কেবল মুখে দিবো এমন সময় খবর আসে পুলিশ এসেছে পুলিশ আর অমনিতেই ভাতের থালটা রেখে দৌড়। প্রতিদিন ভোরেই বন্ধুরা সব এক হয়ে পাটক্ষেতে লুকিয়ে পড়তাম। দুপুরে যখন হতো পাটক্ষেত বিলি দিয়ে দিয়ে মাকে খুঁজতাম। মা’ও খবর রাখতো পুলিশ এসেছে কিনা খবর যদি ভালো থাকতো দাঁড়িয়ে থাকতো মা রাস্তায় আমার উঁকি দেওয়া দেখেই ঈশারা দিতো আয় আয়। ছুটে যেতাম খাবার খেতে। হাউমাউ করে কিভাবে যে খাবার শেষ করতাম মনে পড়লে বিস্ময় ভরে এখনও তাঁকিয়ে থাকি।

বেশ কয়দিন পাটক্ষেতে থাকতে থাকতে জীবনটা যেন হাঁপিয়ে উঠেছে। একদিন বাবা বললেন, এক কাজ কর ক’টা দিন তোর বড় বোনের বাড়িতে থেকে আয়। যেহেতু নদীটা পার হলেই অন্য থানা সেখানে তো আর কোন সমস্যা নাই। তাই বন্ধু রাজ্জাককে সাথে নিয়ে সেদিনই সন্ধ্যাবেলা বোনের বাড়ি চলে গেলাম। দুইটা দিন কোন ভাবে কষ্টে-বিষ্টে থাকলাম আর মন টিকে না। তৃতীয় দিনের মাথায় আর যাস কই কিসের পুলিশ কিসের ভয় দুই বন্ধু অস্থির হয়ে বিকেল বেলায় বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আমাদের গ্রামটা মায়াময়ী গ্রাম অনেক সুন্দর। এ গ্রামে যখন যার পদধূলি পড়েছে সেই সম্যক প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছে। গ্রামটির পাশ দিয়েই বয়ে গেছে এঁকেবেঁকে স্রোতস্বিনী ঝাড়কাটা নদী। নদীটির ওপার-জুড়ে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। এক সময় ওপাড়েই এখন যেখানে পূর্বপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়টির অবস্থান সেখানে শত একর জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছিল বানিজ্যিক বন্দর। হাটবাজার, নানা পেশার মানুষদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বিশেষ করে মারোয়ারীরা পয়সাওয়ালা ছিল। তাদের স্বর্ণলংকারের দোকান ছিল। জমজমাট বাজার ছিল।

দেশি বিদেশী ইংরেজ বনিকেরা জাহাজ নিয়ে নূংগর ফেলতো ঘাটিতে। নদী পারাপারের ঘাট ছিল। যিনি জীবনের অধিকাংশ সময় এই ঘাটটির পারাপার করেছেন তার নামানুসারে ঘাটটিরও পরিচিতিও লাভ পায় কাজীর ঘাট নামে। অর্থাৎ কাজী ঘাইটেল এই ঘাটের মালিক ছিলেন দীর্ঘ অনেক বছর। তার সম্পর্কে জেনেছি একসময় শেরে বাংলা একে এম ফজলুল হক এই ঘাটতি দিয়ে যাতায়াত করতেন। কাজী ঘাইটেল এর সাথে বেশক্ষণ নৌকায় বসে গল্পও করেছিলেন। আজ সেই ঘাটটিও নেই নেই সেই অঞ্চল জুড়ে নামে ডাকে ভরা কাজী সাহেব। সময়ের স্রোত ধরে নদীর ভানংনে বিলিন হয়ে গেছে প্রসিদ্ধ বন্দরটি নদীর এপার পলি পড়ে চর জেগেছে আর ওপারের তীর ঘেসে গড়ে উঠেছে নতুন করে গুনারীতলা বাজার। সেই কাজীর ঘাটটিও ভেংগে নতুন ঘাতের উদয় হয়েছে বাজার সংলগ্ন। ঘাটের মালিকেরও পরিবর্তন ঘটেছে। তৎকালীন সময়ে গ্রামটির প্রসিদ্ধতার অন্যতম কারণ ছিল নীল চাষ। অত্র গ্রামে ব্যাপক আকারে নীল চাষ হতো। যার দুইশো বছরের স্মৃতি স্তম্ভ নিয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে নীল কুটিরে। যে কথা বলছিলাম। দুই বন্ধু হাটতে হাটতে ঝারকাটা নদী পারাপারের খেয়াঘাটিতে এসে পৌঁছেছি। নদীর ওপারেই সুবিস্তীর্ণ খেলার মাঠ। মাঠটির চারিধারে সারি সারি বৃক্ষ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পঁচাত্তর বছরের ঐতিহ্যের দাবীদার গুনারীতলা হাই স্কুল। মমতায় জড়ানো খেলার মাঠে যেখানে প্রতিদিন বিকেলবেলায় মাঠে আড্ডা না দিলে মন ভরেনা।

তাছাড়া প্রতিদিন জমজমাট ফুটবল খেলা হতো। আমরা দুই বন্ধুই ফুটবল খেলার পাগল প্লেয়ার ছিলাম। এপার থেকে ফিজিক্যাল স্যারের বাঁশির হুইসেল শুনছি আর দুই বন্ধু অস্থির হচ্ছি কখন মাঠে পৌঁছাবো। পারাপারের ডিঙি নৌকা ততক্ষণে ঘাটের-কিনারে এসে ভিড়েছে। আমরা দুই বন্ধু লাফ দিয়ে উঠে পড়লাম নৌকায়। লোক ভর্তি পুরো নৌকা ডুবু ডুবু অবস্থা। আমাদেরকে লক্ষ করে এক মুরুব্বি বলে উঠলেন, কিগো তোমরা না ছাত্র ওই দেখছোনা উপারে পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। শুনেছি ছাত্রদের ধইরে অনেক মাইরপিটও করে পুলিশরা। তোমরা জানোনা। দু’জনেই হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকাইলাম। ভূত দেখার মত চমকে উঠলাম। সত্যিইতো তাই। চার পাঁচজন খাকি পোষাকধারী পুলিশ সাইকেল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আপাদমস্তকে কাপোনী শুরু হয়ে গেল। ততক্ষণে আমরা প্রায় পাড়ের কিনারায় এসে গেছি।

বন্ধু রাজ্জাককে বলেছিলাম লোকজনের মধ্যে মাথা নীচ করে চুপিচুপি হেট পার হয়ে যাবো। সেও রাজি হয়েছিল। কিন্তু জানতামনা ভীতরটা তার এতো ভীরুতায় ভরা। নৌকা থেকে নেমেই নদীর পাড় ঘেষে উত্তর দিকে অমারম বিদ্যুৎ বেগে দৌড় দিল রাজ্জাক। ওর দৌঁড় দেখে আমি কি আর বসে থাকি আমিও ঘুড্ডির মতো দৌঁড় ওর পিছু পিছু। ব্যাপারী বাড়ির এরিয়া পার হয়ে এসেছি ওখানে একটা বড় রকমের গর্ত আছে। জায়গাটাও বড় ভয়ংকর দুষিত। মাঝে মধ্যেই রাতের বেলায় ভুতপ্রেতনী ওকানে খেলা করে। দিনের বেলায়তেও ঐ জায়গায় এলে সবারই ভয় লাগে। আমরা যখন ওই জায়গাতে পৌছিলাম উপর থেকে পুলিশ বলছে এই দাড়া বলছি, দাড়া নইলে কিন্তু গুলি করে দিবো। অমারম পানিতে ঝাপ দিলাম দুজনে।

টার্গেট নদী পার হয়ে ওপারে পৌঁছা। একদিকে দৌঁড়ের পর যেমন হাঁপিয়ে উঠেছিলাম তেমনি পানিতে সাতার দেওয়া দুইই মিলে দু’জনের ব্যপক কষ্ট হয়েছি উপাররে পৌঁছা। অনেক কষ্টে দুই বন্ধু উপারে পৌঁছিছিলাম। দৌঁড়াচ্ছি দৌঁড়াচ্ছি একবার পশ্চাতে তাকাইলাম। দেখলাম জনসমুদ্রের রুপ নিয়েছে মানুষ আর মানুষ ওপারে। সবার মাঝে খাকি পোষাকধারী পুলিশও অবস্থান করছে। তা দেখে অস্থিরতা একটু হ্রাস পেলো। জানতাম পুলিশ এপারে আসবেনা। কারণ ওপারটা হলো মাদারগঞ্জ থানাধীন আর এপারটা মেলান্দহ থানা।

- Advertisement -spot_img
আরও সংবাদ
- Advertisement -spot_img
এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here