১৯৭১ সালে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর যে বিজয় অর্জিত হয়েছে, সেটাই বাংলাদেশের মূল মাইলফলক। একটি বৈষম্যহীন ন্যায়ভিত্তিক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার যাত্রা সেখান থেকেই শুরু। স্বাধীনতার এই আকাঙ্ক্ষার পক্ষের মানুষই বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। আমাদের দেশের শাসকগোষ্ঠী এই সত্য ভুলে যায়।
খবর বেরিয়েছে গুম-খুনের সাথে ক্ষমতাচ্যূত পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জড়িত। সত্যটি হচ্ছে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার শাসনামলে ভালো কিংবা মন্দ কোনো কাজই শেখ হাসিনার নির্দেশ ছাড়া সংঘটিত হয় নাই। দেশে র্যাব তৈরি হয়েছিলো ২০০৪ সালে বিএনপির শাসনামলে। তারা তখন বলেছিলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য র্যাব গঠন করা হলো এবং এই বাহিনীকে সাধারণ আইনের বাইরে কিছু ক্ষমতা দেয়া হলো। আইন ভঙ্গ করে শৃঙ্খলা রক্ষার যে বিধান বিএনপি করেছিলো, সেটা ছিলো সংবিধান বিরোধী, গণতন্ত্রের সাধারণ নিয়মের বিরোধী এবং আন্তর্জাতিক আইনের বিরোধী। তখন আওয়ামী লীগও এর বিরুদ্ধে অনেক কথা বলেছিলো। দেখা গেলো সে যখন ক্ষমতায় এলো র্যাবকে আরো শক্তিশালী করলো অলিখিত নির্দেশের মাধ্যমে। ঘটলো অগণিত গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। এটাই সত্য, কোনো দেশে সরকার-প্রধানের অনুমতি ছাড়া এমন গুম-খুন বছরের পর বছর ধরে সংঘটিত হতে পারে না। দেশের মানুষ, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এর প্রতিবাদ করলেও কোনো ফল হয়নি।
এখন র্যাবের নতুন প্রধান অতীতে র্যাব কর্তৃক সংঘটিত গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। এটি একটি খুশির খবর। কিন্তু এবার নিশ্চিত করতে হবে যে, এমন কাণ্ড আর ঘটবে না। আর জনগণের দাবি, অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে সঠিক বিচার হতে হবে, কারণ খুন করে ক্ষমা চাইলে আইন কাউকে ক্ষমা করে না। জানা গেছে গুম-খুনের রিপোর্ট বের হয়েছে। রিপোর্টটি পাবলিক হওয়া আবশ্যক। এখানে তারা গুম-খুনের সাথে শেখ হাসিনার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছেন। হাসিনা যেভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন সেখানে তার অনুমতি ছাড়া ঘটনাগুলো ঘটার কথা না। এজন্য এ দাবি ন্যায্য যে তার বিচার হতে হবে। যদি বিচার না হয় তো বর্তমান ও আগামীর সরকার একই পথে হাঁটবেন। তারা মনে করবেন, ক্ষমা চাইলে বা কোনো রিপোর্ট প্রকাশ করলেই পুরনো পাপ মুছন হয়ে যায়।
অন্যদিকে বিএনপি আমলেও র্যাব কর্তৃক অনেক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়েছে। তারা আজ র্যাবের বিলুপ্তি চাইছেন। এতে বিএনপি এর থেকে দায়মুক্ত হয়ে যায় না। তারা এখনো ক্ষমা চাননি। সে আমলে যাদের দ্বারা অপরাধ সংঘটিত হয়েছিলো তাদেরকেও বিচারের আওতায় আনতে হবে। কোনো রাষ্ট্রে যে কোনো কারণে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলে তাকে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলা যায় না।
জাতি গভীর শ্রদ্ধার সাথে শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করেছে। উল্লেখ্য যে এতোদিন সবাই জানতো বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সাথে জামাতসৃষ্ট আলবদর, আলসামছ বাহিনী জড়িত। কিন্তু এবার জামাত ভিন্ন কথা বলছে, তাদের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে বলছে এ হত্যাকাণ্ডের সাথে ভারত সম্পৃক্ত। এটা স্তম্ভিত হওয়ার মতো উচ্চারণ। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটা জনযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জামাত সহ অল্প কিছু দল এই যুদ্ধের বিপক্ষে ছিলো। এছাড়া পুরু জাতি যেমন কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র ও নানা পেশার মানুষ, বাঙালি ও অন্যান্য ভাষাভাষি এবং নানা দলের মানুষ ঐক্যবদ্ধ ছিলো। কিন্তু আওয়ামী লীগ, অন্য দল বা ব্যক্তির অবদানকে স্বীকার করে নাই। এটা তাদের ইতিহাস বিকৃতি। এখন আওয়ামী লীগের পতনের পর দেখা যাচ্ছে জামাত রাজনীতির মাঠে একটা দৃঢ় অবস্থান সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। এ ব্যাপারে সরকারের উপদেষ্টাদের কেউ কেউ সাহায্য করছে, ওয়াকেবহাল মহলের অনেকের এমনই বক্তব্য। এই সুযোগে জামাত এবার আওয়ামী লীগের মতো ইতিহাস বিকৃতির আশ্রয় নিতে শুরু করেছে। ভারতের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষের শত অভিযোগ থাকতে পারে, কিন্তু বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগ নেই। এই ঘটনার সাথে জামাত জড়িত এটা নির্ভেজাল সত্য। শহিদ বুদ্ধিজীবীদের বৃহৎ অংশই ছিলেন বামপন্থী। তারা গণতন্ত্র ও সমতার সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করছিলেন। তাঁরা ধর্মভিত্তিক কোনো সাম্প্রদায়িক সমাজের পক্ষে ছিলেন না। এখানেই জামাতের সাথে তাঁদের আদর্শের পার্থক্য ছিলো। জামাত এইসব বুদ্ধিজীবীদের শত্রু জ্ঞান করতো যে জন্য তাঁদের হত্যা করেছিলো। আজকে জামাতের নেতারা বলছে, এই হত্যাকাণ্ডের সাথে তারা জড়িত ছিলো না, দোষ চাপাচ্ছে ভারতের ঘাড়ে। আসলে জামাতে ইসলাম আর ইসলাম এক না, ইসলামের নবী ছিলেন ন্যায়ের পক্ষে, সমতার পক্ষে আর জামাত হচ্ছে অন্যায় ও অসত্যের পক্ষে। রাজনৈতিক কারণে জামাত পাকিস্তানপন্থী হতেই পারে, ভুল রাজনীতি করতে পারে, কিন্তু তথ্য বিকৃতি করা, নারী ধর্ষণের ব্যবস্থা করা, ঠান্ডা মাথায় বুদ্ধিজীবীদের খুন করা পৃথিবীর যে কোনো আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধ। জামাত এখন পর্যন্ত ক্ষমা চায়নি, উপরন্তু নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপাচ্ছে। এটা ইসলাম বিরোধী, মানবিক মূল্যবোধ বিরোধী। তারা এমনটা করছে সরকারের কতিপয় উপদেষ্টার আশকারায়, চিন্তাবিদদের এমনই ধারণা। বুদ্ধিজীবী হত্যার ব্যাপারে একটি ঘটনার বেলায় বিতর্ক আছে, সেটি হচ্ছে জহির রায়হান হত্যাকাণ্ড। ১৬ ডিসেম্বরের পরে এই হত্যাকাণ্ড হয়। শাহরিয়ার কবির এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের দিকে আঙ্গুল তুলেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় জহির রায়হান ভারতে অবস্থানকালে অনেক ছবি তুলেছিলেন। সেসব ছবিতে আওয়ামী লীগের একাংশের অপকর্মের দৃশ্য ছিলো। সেইসব ছবি যদি তিনি প্রকাশ করে দেন সে আশঙ্কা থেকে তাকে হত্যা করা হয় বলে ধারণা করা হয়। বিষয়টির অনুসন্ধান হওয়া উচিত। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সাথে যে জামাত জড়িত এ বিষয় পরিষ্কার। এজন্য জামাতের বিচার হওয়া উচিত।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ না হলেও গায়েব হয়ে গেছে। কিন্তু আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা এখন কোথায়? এতোসব ঘটনা ঘটছে, তারা মুখে কুলুপ এঁটে আছেন কেনো? জ্ঞানীজনরা বলে থাকেন, তাদের মতো পাপী এদেশে কমই আছে। এই কথা চালু আছে যে, আওয়ামী নেতা-কর্মীদের লেখার যোগ্যতা সামান্য বিধায় এদের ভাড়া করা হয়েছে। এখন দল পালানোর সাথে সাথে তারাও পালিয়েছে। কারণ তাদের কোনো নৈতিক সাহস নেই। তারা জামাতের বিচারের দাবিটা তুলতে পারছে না। কিন্তু আমাদের দাবিটা তুলতে হবে, জনগণের পক্ষ থেকে তুলতে হবে যে, মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য জামাতের বিচার চালু থাকুক এবং সে বিচার আইন ও স্বচ্ছতার সাথে হোক।
সবশেষে যে কথাটি বলতে হয়, রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য শুভ আকাঙ্ক্ষাই যথেষ্ট নয়। এ জন্য থাকতে হয় দক্ষতা ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা যা এই সরকারের অনেকেরই নেই। তাদের ওপর জামাত-শিবিরের প্রভাব বেড়েছে। শিল্পকলা একাডেমি মাসব্যাপী অনুষ্ঠানমালা দিয়েছে। সুন্দর। কিন্তু নাম দিয়েছে, ডিসেম্বর মাসের অনুষ্ঠান। বিজয়ের মাসের অনুষ্ঠান এই নাম দিতে পারেনি। এখানেই জামাতের প্রভাব। জামাত বিজয় শব্দটা শুনলে আঁতকে ওঠে। ৭ম শ্রেণির বইয়ে একটা কবিতা নির্বাচিত হয়েছে, সেখানে কওমি শব্দটা আছে ও ফুরাৎ নদীর উল্লেখ আছে। প্রশ্ন জাগে রংপুরে তিস্তা নদী থাকতে ফুরাৎ আসলো কোত্থেকে। সরকার যতো বেশি জামাতকে প্রশ্রয় দেবে ততো জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে কারণ জনগণের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের মানুষই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এটা ক্রমশ বাড়বে, কমবে না।
১৬/১২/২০২৪ সাল।