বাড়ির পারশে আরশি নগর
কামরুল হাসান (পর্ব-০১)
প্রথম কবে দেখেছি মেঘালয়ের পাহাড়গুলো আজ আর মনে নেই। সেকি সুনামগঞ্জের হাওড়ে গিয়ে নাকি তামাবিল যেতে যেতে? এমনও হতে পারে তাদের দেখেছি নেত্রকোনা মোহনগঞ্জের এক গ্রাম্য বাজার থেকে। যতবারই দেখেছি চোখ আর ফেরাতে পারিনি। হাওড়ের জলপিঠ, মাঠের বিস্তৃতি আর গ্রাম্য বাজারের দোকানসমষ্টির মাথার উপর তারা ছিল স্বপ্নরাজ্যের ইশারা। তামাবিল গিয়ে মনে হয়েছে এ কেমন বিচার? সবগুলো পাহাড় ওরা রেখে দিল! তখন লিখেছিলাম একটি কবিতা, যার শুরুটা ছিল নিম্নরূপ:
‘সবগুলো পাহাড় ওদের,
প্রতিবাদে নেমে আসে জল।’
সত্যি দেখেছি ওরা কায়দা করে, মাপজোকের জটিল কানুন বানিয়ে পাহাড়গুলো রেখে দিয়েছে। পাহাড় রেখে দিয়েছে সত্যি, কিন্তু জল আটকাতে পারেনি। শুধু জল নয়, অতিকায় পাহাড় ক্ষুদ্র নুড়ির রূপে নেমে আসছে সমতলে, যেন তার বিপুল বক্ষ থেকে অজস্র পাথর কান্নারূপে নেমে এসেছে বিস্তৃত সমতল বাংলাদেশে।
তামাবিল গিয়ে মনে হয়েছিল ঐ পাহাড়শ্রেণি পৃথিবীর শেষ দেয়াল, যেন তার ওপাশে কোন দুনিয়া নেই, সেই পাহাড় শ্রেণির নিচে এই উর্বর সবুজ দেশ, নদীরা যেখানে নেমে স্বস্তি পেয়েছে। সেখানে পাহাড়ের মাথায় সারাদিন সারারাত মেঘের আনাগোনা। এত কাছে তবু এত যে বয়স বেড়ে গেল আমার, কোনদিন দেখা হয়নি মেঘের রাজ্য মেঘালয়। অথচ এ বছরেই দুবার প্রস্তাবটি পেলাম মেঘালয়ে বেড়ানোর। প্রথম প্রস্তাব রেখেছিল ডালিয়া যে তার দার্জিলিং ট্যুর দলে আমাকে রাখার জন্য বেশ কিছুদিন ধরেই আঁক কষছে। আমি বলেছিলাম যাবো। কিন্তু সে ট্যুর প্রোগ্রাম পিছিয়ে গেল। এমনি সময়ে মাহমুদ হাফিজ জানালেন তিনি মেঘালয়ে যাচ্ছেন একটি আমন্ত্রণে, আমাকেও সঙ্গে নিতে চান। শুনে জলীয় কণা বাষ্প হয়ে যেভাবে মেঘ হয়ে আকাশে গিয়ে জমে, তেমনি আমার বিক্ষিপ্ত ভ্রমণভাবনাগুলি মেঘালয়ে গিয়ে স্থির হলো। এ যেন তিনটি ব্যর্থ ভ্রমণ পরিকল্পনার শেষে সফল চতুর্থ । এবার সেমিস্টার ব্রেকে পরপর তিনটি পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছিল। প্রথমটি ছিল আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ ভ্রমণ। সেটি পিছিয়ে গেল।
দ্বিতীয় পরিকল্পনা ছিল ডালিয়ার সাথে দার্জিলিং যাওয়া। সে পরিকল্পনা ব্যর্থ হলো। যারা যাবে বলে কথা দিয়েছিল তাদের শেষ মুহূর্তে নাম প্রত্যাহার। প্যাকেজের প্রাইস দেখে তারা আঁতকে উঠে ঐ হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। শেষ প্রচেষ্টা ছিল আমার বন্ধু কবিরুল ইসলামের সাথে ভারতের কোথাও না কোথাও ঘুরতে যাওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ তাকে যেতে দিতে নারাজ কেননা, সদ্যই সে ঘুরে এসেছে আমেরিকা। তাই মাহমুদ হাফিজ যখন প্রস্তাব দিলেন মেঘালয় ভ্রমণের, আমি লুফে নিলাম।
মাহমুদ হাফিজ কবি ও সাংবাদিক। জীবনের একটা দীর্ঘ সময় আমরা পরস্পরকে চিনতাম না, কিন্তু যখন থেকে চিনেছি তখন থেকে ঘনিষ্ঠ হয়েছি। আমরা মাঝে মাঝেই গুলশান বনানী এলাকার কোন না কোন রেস্তরাঁয় ব্রেকফাস্ট আড্ডায় মিলিত হই। আমাদের যোগসূত্রটি হলো ভ্রমণ ও লেখা। আমার চেয়ে ঢের ঢের বেশি দেশ তিনি ঘুরেছেন, তুলনায় তত বেশি লিখেননি। আমার লেখা তার পছন্দ, মেঘালয়ে নিয়ে যেতে চান ঐ কারণেই। জানেন মেঘালয়ে গিয়ে আমি মেঘকন্যাদের নিয়ে লিখব। রোজার ভেতর ভাটারা এলাকায় এক ধনবান ছড়াকারের ইফতার মাহফিল থেকে ফেরার পথে তিনি আমাকে নিয়ে যান সামনে ক্রিম পেছনেও ক্রিম Creame de la Creame নামের এক পুরোদস্তুর ইউরোপীয়ান কফিশপে। সেখানে গিয়ে শুনি মেঘালয়ে যাবার পেছনের কথা।
কয়েক বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়া কবিতা উৎসবে মাহমুদ হাফিজের সাথে পরিচয় ঘটে মেঘালয়ের কবি ফাল্গুনী চক্রবর্তীর। তিনি বাঙালি, কলকাতার মেয়ে, কিন্তু বাস করেন শিলংয়ে। মেঘালয় হলো মূলত খাসিয়া জাতিসত্তার রাজ্য। সে রাজ্যে বাঙালি কবির সংখ্যা কম। ফলে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও অন্যান্য রাজ্যের বাংলা কবিতা উৎসবে কবি ফাল্গুনী চক্রবর্তী আমন্ত্রণ পান। তিনি বিদুষী ও সুদর্শনা। ফলে সকলের মধ্যমণি হয়ে থাকেন। কোন কোন কবিতা উৎসবে একাই মেঘালয়ের প্রতিনিধিত্ব করেন। ঢাকাতেও কয়েকবার এসেছেন। শেষবার যখন এলেন তখন তার সাথে মেঘালয়ের চার নারী কবি। এরা হলেন স্ট্রিমলেট ডেখার, বাকিয়া মুন, ইভানিশা পাঠাও। এরা যখন ঢাকায় এসেছিলেন তখন মাহমুদ হাফিজ অনেকটা লোকাল গাইডের মতো এদের নিয়ে ঘুরেছেন, নিয়ে গেছেন বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে। এভাবে বাকি চারজনের সাথে সখ্য গড়ে ওঠে। স্ট্রিমলেট ডেখার শিলংয়ের নর্থ ইস্টার্ন হিল ইউনিভার্সিটি (নেহু)র একটি অনুষদের ডিন। তিনি মাহমুদ হাফিজকে সপরিবারে মেঘালয় বেড়াতে আমন্ত্রণ জানান।
মেঘালয় যেতে আমরা যত উৎসাহী, আমাদের হোস্টরা তার চেয়েও বেশি উৎসাহী আমাদের সে রাজ্যে নিতে। তারা একটি WhatsApp (What’s happening) গ্রুপ খুলে বসল নিরন্তর যোগাযোগ রাখার জন্য। তারা এর নাম দিয়েছিল ‘বাংলাদেশ টু শিলং ট্রিপ’। ভ্রমণবিষয়ক পত্রিকা ভ্রমণগদ্যের সম্পাদক মাহমুদ হাফিজের ভাবনাসকল ঐ পত্রিকাটি ঘিরেই আবর্তিত। তিনি অনুরোধ করলেন নাম বদলে ‘ভ্রমণগদ্য শিলং ট্রিপ’ রাখতে। সেখানে ক্রমশঃ জমে উঠতে লাগলো ভ্রমণের আপডেট। বিশেষ কী নিয়ে যেতে হবে আমাদের এমন প্রশ্নে তারা জানাল, ছাতা, রেইনকোট, সানগ্লাস প্রভৃতি। আমরা সেসব কিনি আর আপডেট দিই।
আমার পাসপোর্টে একবছরে একাধিকবার ভারত ভ্রমণের ভিসা আছে। এই one year multiple entry ভিসা ভারত সরকারের একটি সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত। তিনটি পথ – বিমান, গেদে সীমান্ত দিয়ে রেলে আর বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে সড়কে যে কোন ভারতীয় ভিসায় common. একটি চতুর্থ পোর্ট যুক্ত করা যায়। আমার পাসপোর্টে সেটি হলো ফুলবাড়ি। ঐ যে ডালিয়ার সাথে দার্জিলিং যাওয়ার প্লান! মেঘালয় যেতে ভারতীয় সীমান্ত পোস্ট ডাউকি। সেটি যুক্ত করার জন্য ভারতীয় ভিসা এপ্লিকেশন সেন্টারে (আইভিএসি) গিয়ে দেখি সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল বা কমলাপুর রেলস্টেশনের চেয়েও বেশি ভিড়। দেখে মনে হতে পারে গোটা বাংলাদেশের অর্ধেক মানুষই বোধকরি ভারত চলে যাচ্ছে। দুটি নতুন পোর্ট সংযুক্তির জন্য পাসপোর্ট জমা দিয়েছি ১৯শে মে, ফেরত দেবার কথা ২৭ তারিখ। সেদিন গিয়ে দেখি বাকি অর্ধেক ভিসা সেন্টারে। সেদিন পেলাম না। পরের দুদিন সাপ্তাহিক ছুটি, তারপর দিন শবেকদর। ঘনিয়ে আসা ঈদছুটির ঠিক আগে কর্মদিবস মোটে দুটি। একটু টেনশনে পড়ে গেলাম আমি ও মাহমুদ হাফিজ। ভাগ্য ভালো সোমবার ডাউকি ও চেংরাবান্ধা যুক্ত হলো।
মেঘালয়ে ঘটছে আরেক কাহিনি। স্ট্রিমলেট ডেখার ও তার বাহিনী আমাদের আমন্ত্রণ জানানোয় অভিমান করে আছেন ফাল্গুনী চক্রবর্তী। তার সূত্রে পরিচয় অথচ তিনি আছেন সাইড লাইনে- এটা তার পছন্দ হচ্ছে না। তিনি নিজেকে কিছুটা সরিয়ে রাখলেন। একদিন গুলশান এক নম্বর সেক্টর বাজারে গিয়ে ছাতা আর রেইনকোট কিনে আনি। মেঘ আর বৃষ্টির দেশ মেঘালয়ে যাবার জন্য আমি প্রস্তুত!