বৃহস্পতিবার, জানুয়ারি ৯, ২০২৫
Homeঅন্যান্যযুদ্ধ ও জীবন-৭১

যুদ্ধ ও জীবন-৭১

নুর এমডি চৌধুরী কবি ও সাহিত্যিক

চারিদিকে মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজ। বিশেষ কাজে রণাঙ্গন থেকে বাড়ি ফিরেছে ক্লান্ত হাশেম গাজী। বড়ই ক্ষুধার্ত সে। ভাতের ক্ষুধার কথাই বলি মনের ক্ষুধা সে নাইবা বলি।বিয়ের বয়স তার ছয় মাস আর যুদ্ধে অবস্থান তিন মাস তের দিন। যুদ্ধে যাওয়ার পর এই প্রথম স্ত্রী সখিনার সাথে দেখা। হাশেম গাজী যুদ্ধের দাবানল চালিয়ে যতটানা ক্লান্ত সখিনা যেন তার চেয়েও অধিক।

মুখপানে তার তাকানো যায়না। আর যাবেইবা কি করে যে চোখ সহস্র লাশের প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী। বাবার ঝুলন্ত লাশ,মায়ের ছিন্নচ্ছরা দেহ, শশুর, শাশুড়ি আপনজন সকলের রহস্যময় মৃত্যু নিজের চরিত্রে হায়নাদের আঁচড়ের কালো দাগ, এতো সবের পরও কি করে সখিনার প্রাণে স্বস্তি থাকে! কি করে মুখে অদম্য হাসি থাকে!

বয়সটাও যে তার খুব বেশি তাও নয়। চৌদ্দ কি পনের বছর বয়স হবে। যৌবণের দ্বারপ্রান্তে আসতে না আসতেই শুরু হলো জীবন সংগ্রাম। মৃত্যুর দাবানলে স্বীকার হতে হলো একেক করে আপনজন প্রতিবেশী সকলকে। নিজেকে দফায় দফায় সমর্পিত করতে হলো পাক কমান্ডারের আস্তানায়। এখন যে তার বেঁচে থাকা আর না থাকার মধ্যে কোন তফাৎ নাই। এ পর্যন্ত তার অস্তিত্ব জুড়ে কত শত কলঙ্কের কালিমা যে লেপন হয়েছে তার হিসেব মেলা ভার।

মাঝে মাঝে ভেবেছে, এই কলংঙ্কিত জীবনটা রেখে তার আর লাভ কি একেবারেই শেষ করে দেই। কিন্তু না প্রিয় স্বামী হাশেম গাজীর কথা ভেবে বিয়ের পর যে মানুষটাকে মন ভরে দেখতেও পারেনি একবার, যুদ্ধে চলে গেছে। প্রাণখোলে যে মানুষটার সহিত কথাও বলতে পারেনি একবার সেই মানুষটাকে প্রাণভরে না দেখে মরি কি করে তাইতো স্বামী হাশেম গাজীকে দেখার তীব্র বাসনা নিয়ে সখিনা বেঁচে আছে। তার কেবল একটাই চাওয়া দূর থেকে তাকিয়ে হলেও স্বামী হাশেম গাজীকে যেন আর একটিবার দেখে মরতে পারি প্রভু! আমায় তুমি সেই সুযোগ টুকু দিও।

অথচ আজ কিনা সেই হাশেম গাজীই ফিরে এসেছে। যার প্রতীক্ষার প্রহর গুনেছে সখিনা।যাকে একটিবার প্রাণভরে দেখার প্রত্যয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছে এতোটা দিন। সেই হাশেম গাজীইতো তার ঘরের দোয়ারে নয় শুধু একেবারে মনের দোয়ারে এসেছে। বাড়ির আঙ্গিনায় নয় একেবারে মনের আঙ্গিনায় হাজির হয়েছে কিন্তু সখিনা যেন নিজেকে আড়াল করতে চাইছে বারবার।

এতদিন পর স্বামী হাশেম গাজী এসেছে জেনেও সখিনা কেন এতোটা নীরব, স্থবির, মোক। কেন ঘোমটা দিয়ে মুখখানা তার বারবার ঢেকে রাখতে চাইছে। মাথাটা কেন তার একেবারেই লজ্জাবনত! সুন্দর মুখখানি তারবকেন বৈশাখের কালমেঘে ছেয়ে গেছে? যেন কি এক মস্তবড় অপরাধে সে কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান ফেরারি আসামীর মত দাঁড়িয়ে।

হাশেম গাজী বারান্দায় থেকে উঠানে গিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। পেটের ক্ষুধা যেন বরফে পরিণত হয়। বউ সখিনার নতশির আর নীরবতা যেন তাকে বিষাক্ত সর্প ছোবলে দংশন করতে থাকে। যে সখিনার চঞ্চলতায় সেদিন হাশেম গাজী ছিল অস্থির আর আজ সেই সখিনা কিনা এতোটাই নীরব যে নীরবতা যেন হাশেম গাজীকে পাগল করে তুলছে।

হাজারও প্রশ্ন করে যাচ্ছে হাশেম গাজী বউ সখিনার কোন জবাব নেই। বাবা কোথায় মা কোথায়, দাদা দাদী, চাচা চাচী ভাই বোন আত্মীয়স্বজন ওরা সব কোথায় আদৌ বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে সেসব জানা দূরে থাক সখিনাকে ঘিরেই যত ভাবনা হাশেম গাজীর।
তবু সখিনা কোন কথাই বলছেনা শুধু আঁচল দিয়ে মুখে কাঁদছে আর কাঁদছে।

প্রশ্ন চলে প্রশ্নের নিয়মে! নীরবতা যেন গহীন থেকে গহীনতর হয়। সরলা সখিনা স্তব্ধ হয়েই থাকে সারাক্ষণ। দু’চোখে যেন অশ্রুরা মেঘ হয়ে ঝরে। কোথায় এতোটা দিনের স্বপ্নের মানুষটারে কাছে পেয়ে আনন্দে বোকে টেনে নিবে তানা যেন ঘৃণায় নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে বারবার।

ঘৃণা! সত্যিই ঘৃণা আর লজ্জায় সরলা সখিনা লজ্জাবতী লতার ন্যায় নুয়ে পড়েছে আজ। মন্থর পৃথিবীতে সত্যিই নিজেকে সে বড় অপরাধী মনে করছে। যে মনে বাতাবি লেবুর ঘ্রাণ এতোটা দিন সযত্নে লালন করে রেখেছিলো সে ঘ্রাণ যেন পঁচে মজে দুর্গন্ধে রূপ নিয়েছে আজ।

হাশেম গাজী বিড়ি টানে একের পর এক। মা নেই, বাবা নেই, কোথায় জানা নেই আদৌও কি সবে বেঁচে আছে তাও জানেনা হাশেম গাজী। যাদের মুখে হাসি দেখার জন্য বলে নিজেকে করেছিল সমর্পণ যুদ্ধের রণাঙ্গনে। ঘরে অবলা স্ত্রী রেখে নিজেকে দাড় করিয়েছিলো রণক্ষেত্রে। আর আজ সেই রনবীরের স্ত্রীই কিনা বীরাঙ্গনা, বীরাঙ্গনা সখিনা।

“ওরে ও মুক্তি সেনা জবাব দেনা অশ্রু হাসে
কোথায় মোর মা জননী জন্মভূমি সর্বগ্রাসে”

চোখের পানিতো আর পানি নেই হাশেম গাজীর যেন রক্তের আল্পনা জমাট বেঁধেছে। আগুনের লেলিহান শিখার ন্যায় যেন প্রজ্জ্বলিত। নীরবতা, বড় কষ্টরে বউ এভাবে আর নীরব থাকিসনা, কথা বল উত্তর দে। কি হয়েছে খুলে কহ। আমায় বাঁচতে দেরে বউ, আমায় বাঁচতে দে……কান্নায় কাতর হয়ে ভেঙ্গে পড়ে হাশেম গাজী।

একবার কাছে গিয়ে সখিনার হাত দু’টি ধরে সব জানতে চেষ্টা করে হাশেম গাজী। কিন্তু সখিনা নিজেকে সরিয়ে নেয়। স্বামী! ওগো দোহায় আপনার আমাকে স্পর্শ করবেননা। আমাকে ছুবেননা আপনি। আমি যে কলঙ্কিনী আমি হতভাগিনী আমি বীরাঙ্গনা সখিনা।

আমি আপনার রেখে যাওয়া সম্পদকে রক্ষা করতে পারিনি স্বামী। শুধু একটি বার আপনাকে প্রাণভরে দেখবার পরম ইচ্ছে ছিলো আমার তাই হয়তো বিধাতা সে কথা রেখেছেন। আজ আর আমার কোন কষ্ট নেই স্বামী। আজ আর আমার কোন সাধ নেই, স্বপ্নও নেই, আনন্দ-আহ্লাদ কিছুই নেই। আমার আর কোন চাওয়া নেই স্বামী। আমাকে আপনি অনুনয় বিনয় করে আমাকে অপরাধী করবেন না। আমি আপনার দু’টি পায়ে পড়ি আমাকে যত পারেন প্রহার করেন, রক্তাক্ত করেন, আমায় গলা টিপে মেরে ফেলেন তবু..। কাঁদতে কাঁদতে সখিনা মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে।

পৃথিবীটা যেন নির্বাক হয়। নির্বাক হয় যেন পৃথিবীর সব মানুষ গুলোও। সারা বাংলার আকাশ বাতাসে তখন লাশ আর লাশের মিছিল। রক্তের নদী বয়ে চলেছে পদ্মা মেঘনা যমুনা সমগ্র বাংলা জোড়ে। সখিনার মত লাখো রমণী তখন বিরোঙ্গনা।

সুন্দর পৃথিবীতে কে না বেঁচে থাকি চায়। কার না সাধ হয় স্বামীর চরণতলে মাথা নুইয়ে বাঁচতে। কত নির্মমতার স্বীকার হলে একটি প্রাণ অকালেই ঝরে যেতে চায়, যে ঝরেছে সেই কেবল জানে কি তার যন্ত্রণা কি তার বেদনা কি তার অভাব অভিযোগ।
কান্নায় কাতরাচ্ছে হাশেম গাজী। অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে সখিনা।

এদিকে প্রতিদিনের মত সখিনার কাছে এসে হাজির হয়েছে পাক কমান্ডার। বাসনা চরিতার্থ করার উচ্ছ্বসিত প্রয়াসে। পাক কমান্ডার জানতো সখিনার স্বামী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। উঠানে বসা হাশেম গাজীকে দেখে কমান্ডার রাজাকার বদর উদ্দিনকে ঈশারা করে। বদর উদ্দিন ফিসফিস করে জানিয়ে দেয় এই সেই সখিনার স্বামী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া হাশেম গাজী। বহুত আচ্ছা হ্যাঁ, বলিয়াই হাশেম গাজীকে গাছের সাথে বেঁধে ফেলে বেধর পিটায়। আর সখিনাকে ঘরে নেওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখে সখিনা নি:প্রাণ নিথর দেহে পড়ে আছে উঠানে।

কমান্ডার ব্যগ্রতার সহিত নিজ হাতে পরপর কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়ে হাশেম গাজীর কলিজা বরাবর। নিমিষেই বুকটা ঝাঁঝড়া হয়ে যায়। সখিনাকেউ মৃত পেয়ে ক্ষোভ আর আক্ষেপে বুট দিয়ে পরপর কয়েক বার লাথি মারে কমান্ডার। শুধু তাই নয় মৃত দেহটার উপর পরপর কয়েক রাউন্ড গুলিও চালিয়ে যায়।

গুড়ুম গুড়ুম শব্দে প্রথমে প্রকৃতি, প্রকৃতির আকাশ বাতাস কেঁপে উঠেছিলো সেদিন। পাখিরা সব কেঁদে কেঁদে উড়াল দিয়েছিল দুরাকাশে।এক সময় গোধুলির লগ্ন নেমে এলো, নেমে এলো প্রকৃতি জুড়ে নিস্তব্ধতা, নীরবতা। দেহ দু’খানা নিথর ভাবে পড়ে রইলো উঠানে। হয়তো কোন এক দিন কতগুলো ক্ষুধার্ত শেয়াল কুকুর এসে ভক্ষণ করে চলে গেছে নয়তো…

- Advertisement -spot_img
আরও সংবাদ
- Advertisement -spot_img
এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here