বৃহস্পতিবার, জানুয়ারি ৯, ২০২৫

দাফন

নুর এমডি চৌধুরী

প্রতিদিন সকালে বাসার কাছে একটি পার্কের চারপাশে পায়চারি করি। পার্কের এক কোনায় একটি চা’য়ের দোকান। দোকানটির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে একটা সরু লেক। মাঝে মধ্যে দোকানে গিয়ে একটা বিস্কিট এককাপ চা হাতে লেকের ধারে যাইতাম। জলে স্থবির হয়ে জমে থাকা সবুজ কচুরিপানা আর ফুটে থাকা শাপলা ফুলগুলো মন ভরে দেখতাম।

দোকানে গেলে প্রায়ই দোকানদার একটা কাঠের টোল এগিয়ে দিতো বসতে। লোকটার বয়স সত্তর অধিক হইবে। আমার বাবার বয়সী। মুখখানা সবসময় মলিনতায় ছেয়ে থাকলেও আমি যখন জিজ্ঞেস করতাম কাকা খেয়েছেন? সুন্দর মিষ্টি হাসি হেসে উত্তর দিতেন বুঝতে পারতাম কতটা আল্লাহ ভীরু তিনি। পরানটা ভরে যেতো তার মুখের মিষ্টি মাখা হাসিটা দেখে।

যতদিনই ঐ লেকের ধারে পায়চারী করতে যেতাম ততদিনই দেখতাম একজন বয়স্ক মহিলাকে লেকের ধারে বসে বসে কি যেন কি সংগ্রহ করছে। হাতে তার একটা বেতের ঝুড়ি দেখতাম সবসময় আর মাথাটা ঢাকা থাকতো আঁচলে। তবে কিছুক্ষণ পরপর দোকানে আসতো। দোকানদার চাচার সাথে বিড়বিড় করে কি যেন কি বলে চলে যেতো।

একদিন দোকানদার চাচা দোকান থেকে বেরিয়ে এসে আমার কাছাকাছি দাঁড়াল। লেকের ধারের বয়স্ক মহিলাটিকে ডাকলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, উনি আপনার কে হন চাচা। চাচা উত্তর দিলেন, আমরাই দুই’জন বাপু বুড়া আর বুড়ি। ও আচ্ছা আমিও তাই অনুমান করছিলাম। তো উনি কি করেন ওখানে লেকের ধারে প্রতিদিন। কাকা একটা দীর্ঘ:শ্বাস ফেলেন বলেন, কি আর করবে বাবা শামুক কুড়ায়।

খুব অভাবী সংসার তার। ভাঙা দোকানটা করে যদিও দুই চারটা পয়সা আয় হয় বাকীতেই তা চলে যায়। মহাজনের কাছেও বেশ টাকা ঋনী। শরীরটাও এখন আর আগের মত চলেনা। তাকে জোর করে চালাতে হয়। আরও কিছু জানার ইচ্ছে ছিলো কিন্তু চাচী চলে আসায় চাচাও দোকানের দিকে চলে গেলো।

প্রায় সময়ই চাচাকে জিজ্ঞেস করতাম চাচা, আপনার কোন ছেলেপেলে নাই। তিনি চুপ থাকতেন তারপর আক্ষেপের সহিত মাঝেমধ্যে বলতেন, ছেলেপেলে দিয়ে হবে ও থাকলেও যা না থাকলেও তা। বুঝে নিতাম ছেলেপেলে আছে ঠিকই কিন্তু খোঁজ খবর রাখেনা।

এই জায়গাটা আমার নানা কারণে প্রিয়। বাবা যখন চাকরি করতেন সে সুবাদে এখানে দীর্ঘ দিন থেকেছি। পাকিস্তান আমলে গড়া এখানকার নামকরা প্রাইমারি স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণী পাশ করে বাবার ঢাকায় বদলির সুবাদে রাজধানী শহর ঢাকায় চলে যাই। সেখানে নামকরা স্কুল থেকে এসএসসি এরপর ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স মাস্টার্স করে নানা বিষয়ে অভিজ্ঞতা নিয়ে অবশেষে এই মফস্বল শহরকে বেছে নেই। নেইনা আসলে অদৃষ্টই আমাকে এখানে নিয়ে আসে।

এখানে যখন পড়তাম অনেক বন্ধু বান্ধব ছিল আমার। তবে ছেলেবেলার কথা ক’জনইবা মনে রেখেছে। কয়েকজনের নাম মনে আছে তাদের কথা জিজ্ঞেস করলে বলে কেউ ফ্রান্সে আছে কেউ আমেরিকায় কেউ বড় বড় ডিগ্রী নিতে লন্ডনে পাড়ি জমিয়েছে। কেউ হয়েছে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার কেউবা নামকরা উকিল মুক্তের। তবে আমার ক্লাসের যে ফাস্ট বয়টা ছিল আজমল তার সম্পর্কে জানার প্রবল ইচ্ছে আমাকে সবসময় তাড়া করতো।

আজমল হত দরিদ্র ঘরের ছেলে। বাবা ছিল রিকশাওয়ালা। মা অন্যের বাসায় কাজ করতো। এতটাই দরিদ্র ছিল যে তার বেশভূষা দেখে আমার খুব খারাপ লাগতো তাই মাঝে মধ্যে আমার জমানো টাকা থেকে তাকে কিছু দিতাম আর সে টাকাটা পেয়ে বেদম খুশি হতো।

যাহোক প্রতিদিনের মত পার্কে ঢুকেছি। দূর থেকে দেখলাম দোকানটা বন্ধ। তাই আর কাছে যেতে কিংবা লেকের ধারে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে করলোনা। ভাবলাম বকুল গাছটার নীচে সিমেন্টে মোড়ানো যে বসার বেঞ্চটা ফাঁকা কিছুটা সময় না হয় সেখানেই জিরিয়ে নেই। বসে বসে ভাবছিলাম সোনালী অতীত দিনের কথা। আমি যখন এখানে ছিলাম তখন এই জায়গাটিতে কিছুই ছিলনা। পুরো জায়গাটা ছিল ঝোপে জংগলে ভরা। আর এখন কত কি হয়েছে।

যেমন অট্টালিকার পর অট্টালিকা যেমন স্কুল কলেজ খেলার মাঠ তেমনি রাস্তা ঘাট। যোগাযোগ ব্যবস্থাও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। একজন ভদ্রলোক এলেন সালাম দিলেন ভদ্রতার সহিত একটু দূরত্ব নিয়ে বসলেনও। কোশল বিনিময় হল। অনেক কথার পর এক পর্যায়ে সে আমাকে চিনলও। আমিও চিনলাম তাকে। নাম ফয়সাল।সেই কতদিন পর দেখা চেহারার ব্যপক পরিবর্তন পরিবর্তন স্বাস্থ্যেরও। সে ছিল আমার ক্লাসমেট একই সাথে প্রাইমারি স্কুল পাশ করেছি। ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ফারুক সাহেবের ছেলে।পড়ালেখা শেষ করে কন্ট্রাক্টরি করেছে দীর্ঘদিন এখন রাজনীতির সাথেও জড়িত।

বেশক্ষণ কথা হল তার সাথে। এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করলাম আজমলের কথা। ফয়সাল আজমল নামটি শুনেই মুখটাকে কালো করে ফেললো বলল, ও একটা অমানুষ। বৃদ্ধ মা বাবাকে একটি বারের জন্যও দেখতে আসেনা। কি কষ্ট করে যে ওকে ওর মা-বাবা মানুষ করেছে তা কেবল আমি জানি। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রিক্সা চালিয়ে উকালতি পর্যন্ত পড়িয়েছে আর আজ ঢাকার বড় লোকের মেয়েকে বিয়ে করে গাড়ি বাড়ি সব হয়েছে কিন্তু ভুলে গেছে মা-বাবাকে। কি কষ্টে যে দিনাতিপাত করছে মানুষগুলো বলতে বলতেই ফয়সালের চোখে পানি এসে পড়েছে। এমন কথা শুনে ফয়সালের মত আমার চোখেও পানি চলে এলো। কিছুক্ষণ উভয়েই নীরব থাকলাম তারপর:

ওর মা-বাবার কথা জানতে চাইলাম বলল, ঐ যে লেকের ধারে ভাঙা একটা চায়ের দোকান ওটাই আজমলের বাবার দোকান। আর ওর মা সারাক্ষণ লেকের ধারে বসে শামুক কুড়ায়। দিন শেষে শামুক বিক্রি করে যে বিশ ত্রিশটা টাকা পায় বস্তুত এই টাকাটা দিয়েই তাদের জীবন চলে। আমি বাবাকে বলে বয়স্ক ভাতার কার্ড করে দিয়েছিলাম অভাবের তাড়নায় শুনেছি সেটাও নাকি বিক্রি করে দিয়েছে।

পরদিন বিষন্ন মনে পার্কে প্রবেশ করলাম। পায়চারীর উদ্দেশ্যে নয় চাচাকে উদ্দেশ্য করে। অফিস থেকে ফেরার পথে চাচার জন্য বিশ হাজার টাকা ব্যাংক থেকে তুলে এনেছি। এক পা দুই পা করে দোকানটার দিকে এগোচ্ছি আর ভাবছি কিভাবে টাকাটা দিবো কাকাকে। উনিতো সাহায্য নিবেননা জানি। নানা ভাবনা নিয়ে দোকানে কাছে গেলাম দেখলাম সেদিনও দোকানটা বন্ধ। লেকের ধারে চাচী নিশ্চয়ই আছেন ভেবে দ্রুত লেকের ধারে গেলাম কিন্তু না দেখলাম সেখানে চাচীও নেই।

চাচার দোকানটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ। অপেক্ষাও করলাম ঢের। একজন বয়স্ক লোক টিপটিপ করে হেটেহেটে এসে দোকানের কাছে দাঁড়ালো আমিও উনার কাছে গিয়ে দাড়ালাম দেখলাম দোকানটার দিকে তাকিয়ে লোকটি কাঁদছে হুহু করে আর বলছে, হায়রে পুত” হায়রে অমানুষ এমন কুপুত্র তুমি কারও ঘরে দিও না মালিক। কষ্ট করতে করতে শেষ পযন্ত বাপটা মরেই গেলো।

কি হয়েছে কাকা? কে মরলো? কার কথা বলছেন? আপনি কি এই দোকানদার কাকার কথা বলছেন? তারপর উনি যখন সত্যটা বললেন পুরো আকাশটা যেন আমার মাথার উপর ভেঙ্গে পড়তে লাগলো।

মানুষটার হাত ধরে দোকানদার কাকার বাড়িতে গেলাম। ভাঙা একটা ঘর। উঠানে চটের উপর লাশ শুয়ে আছে চেহারাটা কাঁচা হলুদের মত। মুখটা যেন হাসছে। শিয়রে চাচী আর্তনাদ করছে।

সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই। লোক সকল সমবেত হয়েছে। বলাবলি করছে আজমল আসবেনা ফোন করেছিলাম ওর নাকি কোটে কি জরুরি কাজ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দাফনের ব্যবস্থা করতে হবে। আমি কাকীকে ডাকলাম, যতটুকু সম্ভব সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করলাম। বুঝিয়ে বললাম, কাকী কাকার সাথে আমার আত্মার সম্পর্ক! তার মৃত্যুতে আমি যে পরিমাণ কষ্ট পেয়েছি তা শুধু এক আল্লাহ পাকই জানেন। পকেট থেকে বিশ হাজার টাকার বান্ডেলটা বের করলাম। কাকীর হাতে গুজে দিয়ে বললাম, কাকী আমি আপনার ছেলের মত এই টাকাটা রাখেন। কাকার দাফনের ব্যবস্থা করেন।

- Advertisement -spot_img
আরও সংবাদ
- Advertisement -spot_img
এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here