বৃহস্পতিবার, জানুয়ারি ৯, ২০২৫
Homeঅন্যান্যদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির সাথে কি দারুণ অন্ত্যমিল, রঙিলা কিতাব

দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির সাথে কি দারুণ অন্ত্যমিল, রঙিলা কিতাব

Rumman Rashid Khan

লেখাটা Rumman Rashid Khan এর আইডি থেকে নেওয়া। রঙিলা কিতাব’ জনপ্রিয় লেখক কিঙ্কর আহসানের লেখা ২য় উপন্যাস; প্রকাশকাল: ২০১৫। ‘রঙিলা কিতাব’ উপন্যাস নিয়ে ওয়েব সিরিজ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন পরিচালক অনম বিশ্বাস ও প্ল্যাটফর্ম হইচই। সময়কাল: ২০২৩।

অথচ গতকাল ‘রঙিলা কিতাব’ দেখতে গিয়ে বিস্মিত হচ্ছিলাম, দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির সাথে কি দারুণ অন্ত্যমিল; গল্প তো বটেই, সংলাপেও। ক্ষমতাসীন দল পতিত হবার পর তার সমর্থকদের কি হাল হয়, রাজনীতিতে যে শত্রু-শত্রু কালের বিবর্তনে বন্ধুতে রূপান্তর হয়, ক্ষমতার দম্ভে অনেকেই যে নীতিবোধ খুইয়ে অন্ধ হয়ে যায়-সেই রগরগে সত্যগুলোই এবার ওটিটি’র পর্দায় দেখিয়েছেন পরিচালক অনম বিশ্বাস।

অনম বিশ্বাস বরাবরই নির্ভরযোগ্য পরিচালক। ‘আয়নাবাজি’র চিত্রনাট্য থেকে দেশের সরকারী অনুদানে নির্মিত একমাত্র ব্যবসাসফল ও প্রশংসিত সিনেমা ‘দেবী’ পরিচালনা, টাইম ট্র্যাভেল নিয়ে দেশের ১ম ওয়েব ফিল্ম ‘দুই দিনের দুনিয়া’ নির্মাণ-সবকিছুই ‘ভার্সেটাইল’ অনম বিশ্বাসের হস্তপ্রসূত, মস্তিষ্কপ্রসূত। যদিও ‘রঙিলা কিতাব’-এ সেই পরিচালক অনুপস্থিত। এবার যেন আমরা অন্য এক নির্মাতাকে দেখতে পেলাম। দুর্ধর্ষ অ্যাকশন, চেনা বলয়ের বাইরে গ্যাংস্টার ড্রামা-এ যেন এক অন্য অনম বিশ্বাস! বলিউড গর্ব করে এই ধারার সিরিজ ‘মির্জাপুর’ কিংবা ‘গ্যাংস অফ ওয়েসিপুর’ নিয়ে। তুলনায় যেতে চাই না। তবে আমাদের দেশে এর আগে এত নান্দনিক গ্যাংস্টার সিরিজ আগে দেখেছি বলে আমার মনে পড়ে না। ‘রঙিলা কিতাব’-এর প্লট, চিত্রনাট্য, সংলাপ, অভিনয়-সবকিছুতেই সোঁদা মাটির গন্ধ, পুরোটাই ‘লোকাল’। স্বরূপকাঠির নয়ন জুড়ানো সৌন্দর্য এর আগে কে কবে স্ক্রিনে ফুটিয়ে তুলেছিল? ‘রঙিলা কিতাব’-এ সেই সৌন্দর্য তো বটেই, আমরা আরো একবার বিমোহিত হলাম বান্দরবানের অপার সৌন্দর্য অবলোকন করে। বইয়ের পাতা থেকেই তো গল্পের সঙ্গে আমাদের অনেকের চেনা-জানা হয়েছিল, তবে অনম বিশ্বাসের নেপথ্যের কলাকুশলীরা যেন সোনার অলংকার হয়ে সেই ‘রক্তে রাঙা প্রেমের কিসসা’কে পূর্ণতা দিয়েছে।

সাধারণত ওয়েব সিরিজের গল্প জমে উঠতে আমরা দর্শকরা নির্মাতাকে একটু সময় দেই। তবে ‘রঙিলা কিতাব’-এর ১ম পর্বের ১ম দৃশ্য থেকে চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক আমাদের অদ্ভুত এক মায়াজালে বন্দী করে ফেলেছেন। এই ‘মায়া’ প্রদীপের জন্য, এই ‘মায়া’ সুপ্তির জন্য। যদিও ৮ পর্বের সিরিজে বেশ কিছু দৃশ্য আগের দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি মনে হয়েছে, চিত্রনাট্যের কিছু বাঁক, ২/১টি চরিত্রের উদ্দেশ্য আগেই বুঝতে পেরেছিলাম, তবে ‘রঙিলা কিতাব’-এর প্রোডাকশন ডিজাইন ছোটো খাটো খামতিগুলো ভুলিয়ে দিয়েছে। কায়নাত আহমেদ এই ক্ষেত্রে দুর্দান্ত কাজ করেছেন। খুব সহজেই আর দশটা কাজের থেকে ‘রঙিলা কিতাব’-এর প্রডাকশন ডিজাইন আলাদা করা যায়। তানভীর আহসান ভীষণ গুণী পরিচালক, তার চিত্রগ্রহণও এই সিরিজের অন্যতম সম্পদ। রঙ বিন্যাসও চোখে ভীষণ আরাম দিয়েছে। সম্পাদক হিসেবে লিওন রোজারিও বরাবরই আস্থাভাজন একজন, তার সঙ্গে আশিকুর রহমান সুজন যোগ্য সঙ্গত দিয়েছেন। আবহ সংগীতে তাকদীর, কারাগার, জাগো বাহে, গুটি’র মত দুর্দান্ত কাজ উপহার দেয়া রুসলান রেহমান আবারো মুগ্ধ করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে তার সঙ্গে আমার পরিচয় নেই, তবে দীর্ঘদিন ধরে আমি তার ভক্ত। তবে ‘রঙিলা কিতাব’-এর নেপথ্যের যে মানুষটি আমাকে সবচেয়ে বেশি আন্দোলিত করেছে, তিনি এই সিরিজের অ্যাকশন কোরিওগ্রাফার আসিফ হাসান সাগর। এত raw, এত বিশ্বাসযোগ্য, অথচ সিনেমাটিক অ্যাকশন বাংলাদেশের একটি ওয়েব সিরিজে দেখতে পারবো, ভাবতে পারিনি। বিশেষ করে মোস্তাফিজুর নূর ইমরান সহ যারা অ্যাকশন দৃশ্যে অংশ নিয়েছেন, এক কথায় ‘দুর্দান্ত’।

এবার আসি অভিনয়শিল্পীদের কথায়। নেপথ্যের কলাকুশলীরা এত দুর্দান্ত কাজ উপহার দেবার পরও ‘রঙিলা কিতাব’-এর পুরো আয়োজন ভেস্তে যেতে পারতো, যদি চরিত্র অনুযায়ী যোগ্য শিল্পীদের কাস্ট করা না হতো। প্রধান চরিত্রগুলো তো বটেই, অতিথি চরিত্রে শিল্পী সরকার অপুকে দেখে একবারও মনে হয়নি তিনি অভিনয় করছেন। সমু চৌধুরী থেকে ইকবাল হোসেন-সবাই গল্পে অল্প জায়গা পেলেও অভিনয় করার চেষ্টা করেননি; চরিত্রে ডুবে ছিলেন। অতিথি চরিত্রে তানভীন সুইটিকে দেখে কিছুটা অবাকই হয়েছি। এরকম ধূসর চরিত্রে তাকে আগে কখনো দেখিনি। সে জায়গা থেকে তিনি ছিলেন বিশেষ ‘চমক’। শিমুল শর্মা বরাবরই মজার চরিত্রে অভিনয় করেন। সেই গন্ডি পেরিয়ে এবার অন্যরকম একটি চরিত্রে পেলাম। ৮ পর্ব জুড়ে তিনি চরিত্র থেকে বের হননি। এটি প্রশংসনীয়। মনোজ প্রামাণিক সুযোগ পেলে তাক লাগিয়ে দেন, অতীতেও দেখেছি। যদিও ‘রঙিলা কিতাব’-এ তার চরিত্রটি নিয়ে শুরু থেকে অনেক উচ্চাশা ছিল আমার। শেষ পর্যন্ত ‘জাহাঙ্গীর’-এর চরিত্রায়ণে তৃপ্ত হতে পারিনি। পরের সিজনে নিশ্চয়ই পারবো। তবে চরিত্রের প্রতি শতভাগ বিশ্বস্ত ছিলেন মনোজ। চুলের স্টাইল থেকে পোশাক, বডি ল্যাংগুয়েজ-সবকিছুতেই তিনি নজর কেড়েছেন। ইরেশ যাকের বরবারই সুঅভিনেতা, তবে বরাবরই আন্ডাররেটেড। স্বপ্নজাল, দেবী থেকে কাজল রেখা কিংবা ওয়েব ফিল্ম ‘অসময়’-ইরেশ যাকের বরাবরই নিজেকে ভেঙে নতুন কিছু দেয়ার চেষ্টা করেছেন। সফলও হয়েছেন। তারপরও কেন জানি, ইরেশ যাকেরকে নিয়ে আলোচনা একটু কম-ই হয়। এবার ‘রঙিলা কিতাব’-এও ‘আজম সাহেব’ চরিত্রটি তিনি নিজের করে নিয়েছেন। এরকম ‘কুল ভিলেন’-সচরাচর আমাদের স্ক্রিনে দেখা যায় না। সে জায়গা থেকে ইরেশ যাকেরের ম্যানারিজম আমাদের কখনো হাসিয়েছে, আবার কখনো তার প্রতি ঘৃণার জন্ম দিয়েছে। একই কথা প্রযোজ্য আরেক জাঁদরেল অভিনেতা ফজলুর রহমান বাবু’র ক্ষেত্রে। জগতের খুব কম চরিত্রই আছে, যে চরিত্রগুলোর রঙ তিনি ধারণ করতে পারেন না। এবার তাকে সঙ্গত করেছে ভয়ংকর চোখের লেন্স। ‘নওরোজ শাহ’ চরিত্রে তার দুই স্তরের বিস্কুট ভেঙে চেটে খাওয়ার দৃশ্য দেখে যেমন মজা পেয়েছি, অন্যদিকে নৌকা থেকে ‘আজম সাহেব’ কে ফেলে দেয়ার দৃশ্যে ‘হা’ হয়ে গিয়েছি। শুরু থেকে শেষ-ফজলুর রহমান বাবু চরিত্রে এতটাই ডুবে ছিলেন, চরিত্র নেতিবাচক হবার পরও একটা সময় তার প্রতি মায়া জন্মেছে।

যদিও ‘রঙিলা কিতাব’-এর সব মায়া কেড়ে নিয়েছেন প্রধান দুই অভিনয়শিল্পী। মোস্তাফিজুর নূর ইমরান নিঃসন্দেহে এ সময়ের শ্রেষ্ঠ অভিনেতাদের একজন। মহানগর-২, ইতি তোমারই ঢাকা, জাহান, কাইজার-কনটেন্টগুলোতে তার অভিনয়ের ‘জালওয়া’ তিনি দেখিয়েছেন, তারপরও প্রধান চরিত্রে তাকে কাস্ট করার কথা কখনো নির্মাতারা ভাবেননি। অনম বিশ্বাস এবং হইচইকে ধন্যবাদ, সাহস করে চেনা রাস্তায় না হেঁটে গল্পের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার জন্য। ‘প্রদীপ’ চরিত্রে নূর ইমরান শতভাগ আলো ছড়িয়েছেন। এরকমই একজন পুরুষালী ‘লোকাল’ অভিনেতাকেই এই চরিত্রে প্রয়োজন ছিল। স্ত্রীর প্রতি প্রদীপের নিখাদ প্রেম, অপরাধবোধ, প্রতিশোধের নেশা-সবকিছু কি অবিশ্বাস্য দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন নূর ইমরান, না দেখলে বিশ্বাস হবে না। অ্যাকশন দৃশ্য কিংবা নওরোজ শাহের সঙ্গে হাসপাতালের দৃশ্যে তার অভিনয় প্রমাণ করেছে: নূর ইমরান একজন জাত অভিনেতা। আমাদেরই ব্যর্থতা হবে, যদি তাকে নিয়ে পরবর্তীতে আমরা আর না ভাবি। পরীমনির সঙ্গে ইমরানের জুটিও বেশ মানিয়েছে। তাদের রসায়ণ উচ্চকিত নয়, তবে জীবন্ত। দুজনের অ্যাকশন-রিয়েকশন আমাকে স্পর্শ করেছে।

‘রঙিলা কিতাব’ নিয়ে আমার সিংহভাগ মুগ্ধতার অভিব্যক্তিগুলো আমি শেষ অনুচ্ছেদের জন্য বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। আর এই মুগ্ধতার প্লাবনে যিনি আমাকে ভাসিয়েছেন, তিনি আর কেউ নন, চিত্রনায়িকা পরীমনি। ও মাই গড! বাংলা সিনেমার একজন নায়িকা কখনো একটি চরিত্রের জন্য নিজের ওজন এতটা বাড়াতে পারেন? পরীমনিকে না দেখলে বিশ্বাস হতো না। দেখতে তথাকথিত ‘নায়িকা’ সুলভ লাগছে না, অধিকাংশ দৃশ্যে মুখে মেকআপের লেশমাত্র-ও নেই, আস্ত একটা সিরিজে অন্ত:সত্তা নারীর চরিত্রে অভিনয় করে যেতে হবে-এমন সাহস ক’জন চিত্রনায়িকা করতে পারেন? যারা বলেন, পরীমনির মত তারকাদের নিয়ে কাজ করা অনেক হ্যাপা, তাদের এই সিরিজটি অবশ্যই দেখা উচিত। ব্যক্তি জীবনে সন্তানের মা হবার কয়েক মাস পর এতটা শ্রম দিয়ে কাজ করা, বরিশাল থেকে বান্দরবানের অলিগলি, ছাপোষা হোটেল, বিস্তীর্ণ জনপদে অভিনয় করা পরীমণিকে দিয়েও সম্ভব!!! বার বার মনে হয়েছে, ‘সুপ্তি’ চরিত্রটি শুধুমাত্র পরীমনির জন্যই জন্ম হয়েছে। এমনিতে চিত্রনাট্যে যদিও ‘সুপ্তি’ চরিত্রটি একমাত্রিক। তবে এই সাদামাটা চরিত্রেই পরীমনি কখনো ভালোবাসা, কখনো মায়া, কখনো ভয়, কখনো জেদ, কখনো প্রবল আত্মবিশ্বাসের অভিব্যক্তি দিয়ে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। সন্তান জন্ম হবার পর পরীমনি যখন কোলে তুলে নেন, সে দৃশ্যে যে কারো চোখ ভিজে যাবে। আমার বিচারে ‘রঙিলা কিতাব’-এর ‘সুপ্তি’ ছাড়িয়ে গেছে ‘স্বপ্নজাল’-এর ‘শুভ্রা’কে। ওয়েব সিরিজে কখনো জাতীয় পুরস্কার দেয়া হলে, আমি চাইবো ‘সুপ্তি’র জন্য পরীমনি এই পুরস্কারটি পাক। কারণ এতটা ন্যাচারাল অভিনয় পরীমনিকে এর আগে কখনো কেউ করতে দেখেনি। এর কৃতিত্ব অবশ্য পরীমনির পাশাপাশি পরিচালক অনম বিশ্বাসও পাবেন।

দিন শেষে ‘রঙিলা কিতাব’ রক্তে রাঙা এক প্রেমের গল্প, Must watch। এই গল্পের জন্য ভীষণ ‘ক্রিয়েটিভ’ কিঙ্কর আহসান তো ধন্যবাদ পাবেনই, সিরিজ নির্মাণের জন্য অনম বিশ্বাস ও তার টিম বিশেষ ধন্যবাদ পাবার দাবীদার। সেই সাথে এই ঝিমিয়ে পড়া ওটিটি প্ল্যাটফর্মকে চাঙ্গা করে তুলবার জন্য হইচইকেও অশেষ ধন্যবাদ। ‘রঙিলা কিতাব’-এর গল্পটা অসম্পূর্ণ। দ্বিতীয় সিজন ‘রংমশাল’ নির্মাণের মাধ্যমে গল্প পূর্ণতা পাক, সে প্রত্যাশায়।

- Advertisement -spot_img
আরও সংবাদ
- Advertisement -spot_img
এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here