কালজ্বয়ী উপন্যাস বিষাদসিন্ধু’র রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেনের ১৭৬তম জন্মবার্ষিকী আজ। দিনটিকে ঘিরে নেই কোন আয়োজন।
বুধবার (১৩ নভেম্বর) আধুনিক মুসলিম বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল, কালজ্বয়ী উপন্যাস বিষাদসিন্ধুর রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেনের আজকের এই দিনটিতে পৃথিবীতে আসেন।
এবছর মীর মশাররফ হোসেনের সমাধিস্থল রাজবাড়ীর পদমদীতে গড়ে ওঠা মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি কেন্দ্রে আলোচনা সভার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে বাংলা একাডেমীর আয়োজন । পর্যাপ্ত জমি ও যোগাযোগের সহজতর অবলম্বন থাকলেও এই স্মৃতি কেন্দ্রকে ঘিরে একটি পর্যটন কেন্দ্র ও পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দীর্ঘদিনের দাবী পূরণ না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে এ অঞ্চলের সাহিত্য প্রেমিকরা।
ক্ষণজন্মা এ অমর সাহিত্যিকের পৈত্রিক নিবাস রাজবাড়ীর পদমদীতে থাকলেও ১৮৪৭ সালের ১৩ নভেম্বর কুষ্টিয়া লাহিনীপাড়ায় মাতুলালয়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মীর মোয়াজ্জেম হোসেন ও মাতা দৌলতন নেছা। রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের পদমদী নবাব স্টেটে কর্মরত অবস্থায় ১৯১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়। তার স্মৃতি রক্ষার্থে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ২০০১ সালে পদমদীতে মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও উদ্যোগের অভাবে স্মৃতি কেন্দ্রটি আজ অযত্ন অবহেলায় পড়ে আছে । বিভিন্ন সময়ে এ স্মৃতি কেন্দ্রটিকে সরকারী ভাবে পর্যটন কেন্দ্র করার ঘোষণা দেওয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।
রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার এক নিভৃত পল্লী নবাবপুর ইউনিয়নের পদমদী গ্রাম। কালজয়ী উপন্যাস ‘বিষাদ সিন্ধু’র রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেনের সমাধিস্থলকে ঘিরে এ গ্রামটি এখন অনেকেরই চেনা। এখানেই মীর মশাররফ হোসেন তার জীবনের উল্লেখযোগ্য কাব্য, উপাখ্যান, উপন্যাস, নাটক, আত্মজীবনী, অনুবাদ ও প্রবন্ধ রচনা করেন। মীর মশাররফ হোসেন লিখিত গ্রন্থসমূহ: রত্নবতী (উপন্যাস) ১৮৭৩, বসন্তকুমারী (নাটক) ১৮৭৩, জমিদার দর্পণ (নাটক) ১৮৬৯, গড়াই ব্রীজ বা গৌড়ী সেতু (কবিতাগ্রন্থ) ১৮৭৩, এর উপায় কি (প্রহসন) ১৮৭৬, বিসাদসিন্ধু ঐতিহাসিক (উপন্যাস) ১৮৮৫-৯১, সঙ্গীতলহরী ১৮৮৭, গো-জীবন (প্রবন্ধ) ১৮৮৯, উদাসীন পথিকের মনের কথা (জীবনী) ১৮৯৯, গাজী মিয়ার বস্তানী (রম্যরচনা) ১৮৯৯, মৌলদ শরীফ পদ্যে পদ্যে লিখিত (ধর্মীয় গ্রন্থ) ১৯০০, মুসলমানের বাঙ্গালা শিক্ষা ছাত্রপাঠ্য (প্রথম ভাগ) ১৯০৩ এবং (দ্বিতীয় ভাগ) ১৯০৮, বিবি খোদেজার বিবাহ (কাব্য) ১৯০৫, হযরত ওমরের ধর্মজীবন লাভ (কাব্য) ১৯০৫, হযরত বেলালের জীবনী প্রবন্ধ) ১৯০৫, হযরত আমীর হামজার ধর্মজীবন লাভ (কাব্য) ১৯০৫, মদিনার গৌরব (কাব্য) ১৯০৫, মদিনার গৌরব (কাব্য) ১৯০৬, মোশ্লেম বীরত্ব (কাব্য) ১৯০৭, এসলামের জয় (প্রবন্ধগ্রন্থ) ১৯০৮, আমার জীবনী (আত্মজীবনী) ১৯০৮-১০, বাজীমাত (কাব্য) ১৯০৮, হযরত ইউসোফ (প্রবন্ধ গ্রন্থ) ১৯০৮, খোতবা বা ঈদুল ফিতর (কাব্য) ১৯০৮ ও বিবি কুলসুম (জীবনী) ১৯১০।
এবারের জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষে স্থানীয়ভাবে মীর মশাররফ হোসেন সাহিত্য পরিষদ, মীর মশাররফ হোসেন কলেজসহ স্থানীয় বিভিন্ন সাহিত্য ও সামাজিক সংগঠন পদমদীতে তার সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা একাডেমী একটি সেমিনারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে তাদের এই দিবসের কর্মসূচি।
মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি কেন্দ্র সুত্রে জানাগেছে, স্মৃতি কেন্দ্রে বর্তমানে ২জন নিন্মমান সহকারী, একজন অফিস সহায়ক, একজন নিরাপত্তা প্রহরী, একজন মালি কর্মরত। দুই একদিনের মধ্যে উপপরিচালকের যোগদানের কথা রয়েছে। লাইব্রেরীতে প্রায় ৪ হাজার বই থাকলেও মীর মশাররফ হোসেনের জীবনী ও বিষাদ সিন্ধু ছাড়া মীরের উল্লেখযোগ্য রচনাবলী এখানে নেই। স্মৃতি কেন্দ্রের ভবন প্রয়োজনীয় সংস্কারের অভাবে বর্তমানে বেহাল দশায় পরিণত হয়েছে। পর্যটকদের সুবিধার্থে শুক্রবার ও শনিবার খোলা রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তবে দর্শনার্থীদের বসার,থাকা, খাওয়া ও ফ্রেস হওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই।
স্থানীয় সাংবাদিক সোহেল মিয়া বলেন, মীরের জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকীতে শুধু এখানে দু’টি সামান্য আয়োজন হয়। পর্যটন কেন্দ্র ঘোষণা ও মীরের নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবী জানিয়ে আসলেও তা কার্যকর হয়নি। দুর-দুরান্ত থেকে ভ্রমন পিয়াসুরা আসলেও তাদের থাকা খাওয়ার কোন সু-ব্যবস্থা নেই। আবাসনের ব্যবস্থা না থাকায় দুরবর্তী দর্শনার্থীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
বিশিষ্ট আইনজীবী মোস্তফা কবীর জানান, শত একরের বেশী জমি এই নবাব স্টেটে। সেগুলো বেহাত হতে চলেছে। এগুলো সংরক্ষণ করা জরুরী।
তিনি বলেন, দর্শনার্থীরা এসে এখানে বসার জায়গা, পিকনিক স্পট, ভালো পরিবেশ না পাওয়ায় বেশিক্ষণ থাকেন না। তবে সরকারী ভাবে রেস্ট হাউজ, বসার জায়গা, পিকনিক স্পটের ব্যবস্থা করলে স্মৃতি কেন্দ্রটি যে উদ্দেশ্য করা তার বাস্তবায়ন হতো। আমরা দ্রুত স্মৃতি কেন্দ্রকে পর্যটন কেন্দ্র ঘোষণার দাবী জানাচ্ছি।
স্মৃতি কেন্দ্রে কর্মরত নিন্মমান সহকারী জাহিদুল ইসলাম বলেন, স্মৃতি কেন্দ্রটি বৃহস্পতিবার বন্ধ থাকে। ল্যাম্পপোস্টের লাইট বিকল ও ভবন সংস্কার ও রংয়ের জন্য বাংলা একাডেমিতে চিঠি প্রেরণ করা হয়েছে। এখানে দর্শনার্থীদের আমরা সকল প্রকার সহযোগিতা করে থাকি।
মীর মশাররফ হোসেন ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ কামাল হোসেন জানান, সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেনের নামে প্রতিষ্ঠিত এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ২০১৬ সালে জাতীয়করণের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে অদৃশ্য কারণে আবার জাতীয়করণের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। এথেকে প্রতিষ্ঠানটি বৈষম্যের শিকার। তিনি প্রতিষ্ঠানটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জাতীয়করণ এবং পর্যায়ক্রমে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে রুপান্তরের দাবী জানান।