রবিবার, জানুয়ারি ২৬, ২০২৫
Homeঅন্যান্যজীবনের মুখগুলো ৯৬ || সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

জীবনের মুখগুলো ৯৬ || সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

অনলাইন ডেস্ক

ভাষা আন্দোলনের ঠিক আগের বছরটিতে তাঁর জন্ম এবং আশ্চর্য ভাষার মাসের ঠিক আগের মাসটিতেই তিনি ভূনিসর্গের আলো দেখেন। যিনি পরবর্তীকালে ইংরেজি ও বাংলা- দুটি ভাষাকেই তাঁর জীবিকা ও সৃজনের বাহন করে নিবেন সেই সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ১৯৫১ সালের জানুয়ারির আজকের দিনটিতে জন্মগ্রহণ করেন সিলেটে। তাঁর শৈশব কৈশোর কাটে সিলেট শহরে, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনা ওই নগরেই। ছিলেন ঐতিহ্যবাহী মুরারী চাঁদ কলেজের মেধাবী ছাত্র।

তিনি আমার সরাসরি শিক্ষক নন, তাকে চিনেছি আমার প্রতিভাবান বন্ধু আজফার হোসেনের শিক্ষক হিসেবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ডাকসাইটে অধ্যাপক তিনি, আরেকটি বড়ো পরিচয় তিনি একজন কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও সমালোচক । ইংরেজি অধ্যাপকদের আমরা ভাবি তারা সর্বদা ইংরেজিতেই লেখেন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলামও তাঁর একাডেমিক প্রবন্ধগুলো ইংরেজিতে লেখেন, কিন্তু সাহিত্য লেখেন বাংলায়। তার কথাসাহিত্য উঁচুমানের, যার স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯৬ সালে তিনি কথাসাহিত্যে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন, পেয়েছেন সমালোচকদের সমীহ আর অগণিত পাঠকের ভালোবাসা। তাঁর লেখা ছোটগল্প পড়ে বারংবার মুগ্ধ হয়েছি।

তাকে প্রথমত জেনেছি বন্ধুর শিক্ষক হিসেবে এবং এও জেনেছি সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, কায়সার হক ও ফকরুল আলম- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের এই তিন প্রতিভাবান শিক্ষক পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তারা তিনজন কেবলই একাডেমিক গবেষণা করেন না, তারা সৃজনশীল রচনাও সৃষ্টি করেন । কায়সার হক একজন কবি, এদেশে যে গুটিকয় কবি ইংরেজিতে কবিতা লেখেন তিনি তাদের অন্যতম। কারো কারো মতে তিনিই শীর্ষে।ফকরুল আলম অনুবাদে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন। এই তিনজনের মধ্যে আমার সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠতা হয়েছে প্রফেসর ফকরুল আলমের সাথে। এর কারণ আমি যে বিশ্ববিদ্যালয় পড়াই, সেই ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে তিনি দীর্ঘকাল পড়িয়েছেন, ছিলেন এর উপ-উপাচার্য । আমার সবচেয়ে কম জানাশোনা প্রফেসর কায়সার হকের সাথে। এ দুজনের মাঝামাঝি আমি চিনি প্রফেসর সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে। একবার এক বিয়ের আসরে গিয়ে জানলাম তিনি আমার কলেজ জীবনের সহপাঠী বন্ধু হাফিজ সিকান্দারের আপন মামা।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে ঘনিষ্ঠভাবে জেনেছি দিল্লিতে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশীয় সাহিত্য উৎসবে যোগদানের সুবাদে। ২০১২ সালে আমি যখন প্রথমবার এ উৎসবে যোগ দেই, ঐতিহ্যবাহী নগরী লখনৌতে উৎসবটি হয়েছিল, তখন তাতে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। গত ডিসেম্বরেও একই উৎসবে তাকে পেয়েছি। দুটি উৎসবেই ইংরেজির তিন অধ্যাপক একসঙ্গে গিয়েছিলেন। লক্ষ্ণৌতে সহযাত্রী ছিলেন ফকরুল আলম ও খোন্দকার আশরাফ হোসেন। এবার দিল্লিতে সহযাত্রী ছিলেন ফকরুল আলম ও আবদুস সেলিম। দিল্লির ঐ উৎসবে, আমি দেখেছি, ইংরেজির অধ্যাপকদের বেশ সম্মান করা হয়, তারা অংশগ্রহণ তো করেনই, বিভিন্ন সেশনে সভাপতিত্ব করেন। মর্যাদাপূর্ণ দক্ষিণ এশীয় সাহিত্য পুরস্কারটি লাভ করেছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও ফকরুল আলম।

নিজের সম্পর্কে তিনি বলেন, “I am a critic by training and a writer by compulsion.” অর্থাৎ লেখালেখি তার অবসেসন, না লিখে তিনি থাকতে পারেন না। তাঁর লেখালেখি শুরু হয় শৈশবেই। যখন তিনি ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র তখন স্কুল ম্যাগাজিনে তাঁর প্রথম লেখা ছাপা হয়। তিনি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বাবা মৃত্যুবরণ করেন। এই বিষাদময় ঘটনাটি তাকে আবেগাক্রান্ত করে এবং তিনি তাঁর জীবনের প্রথম ছোট গল্প ‘বিশাল মৃত্যু’ লিখেন। সেটা ১৯৭৩ সালের কথা। মুক্তিযুদ্ধের বছরটিতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতক (সম্মান) ও এর পরের বছর মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি কানাডা চলে যান সেখানকার কুইন্স ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করার জন্য। একাডেমিক উচ্চশিক্ষার এই সময়টিতে তিনি ফিকশন লিখলেও তা প্রকাশ করেনননি। যদিও তার প্রথম গল্পটি সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল এবং প্রশংসিত হয়েছিল।

কানাডায় পিএইচডি সম্পন্ন করার পর ফুলব্রাইট স্কলার হিসেবে তিনি আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন মিসিসিপিতে এক সেমিস্টার ইংরেজি পড়ান। তিনি ইচ্ছে করলে আমেরিকাতেই থেকে যেতে পারতেন, পারতেন কানাডায় সেটেল করতে কিন্তু মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার টানে তিনি স্বদেশে ফিরে আসেন। তাঁর এই প্রত্যাবর্তন যেমন বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে তেমনি তাঁর সাহিত্যপ্রতিভার উন্মীলন ঘটিয়েছে।দেশে ফিরে এসে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় লিখতে শুরু করেন। ঐতিহ্যবাহী দৈনিক সংবাদে শিল্প-সাহিত্যবিষয়ক তাঁর নিয়মিত কলাম ‘অলস দিনের হাওয়া’ শুধু পাঠকদের মনোযোগ ও ভালোবাসা টানেনি, সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে পূর্ণমাত্রার লেখালেখিতে। আশির দশকে লেখা হলেও ‘অলস দিনের হাওয়া’ বই আকারে প্রকাশিত হয় ২০১২ সালে। তাঁর প্রথম প্রকাশিত (১৯৮৫) প্রবন্ধের বই নন্দনতত্ত্ব বিষয়ে। বইটির নামও ‘নন্দনতত্ত্ব’। আরেকটি প্রবন্ধের বই ‘কতিপয় প্রবন্ধ’ ১৯৯২ সালে প্রকাশিত।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের লেখা ছোটগল্পের বই সাতটি। সাধারণত গল্পকারগণ বেশ কিছু গল্পের বই প্রকাশের পর শ্রেষ্ঠ বা নির্বাচিত গল্প সংকলন বের করেন। তাঁর বেলায় ঘটেছে উল্টো। ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত প্রথম গল্পগ্রন্থটির নাম ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’। সেই থেকে ২০১২ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে ‘থাকা না থাকার গল্প’, ‘কাঁচ ভাঙা রাতের গল্প’, ‘আলো ও অন্ধকার দেখার গল্প’, ‘প্রেম ও প্রার্থনার গল্প’, ‘সুখদুঃখের গল্প’ ও ‘বেলা অবেলার গল্প’। দুটি বিষয় লক্ষণীয়- গল্পগ্রন্থগুলোর বেশিরভাগের নামে বিপরীত বিষয়ের সমাবেশ এবং সবগুলো বইয়ের নামের শেষে ‘গল্প’ অভিধাটি রয়েছে।

জানিনা সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কবিতা লিখেছেন কিনা, তিনি কথাসাহিত্যের জগতের একান্ত ঘনিষ্ঠ মানুষ। ছোটগল্পের পাশাপাশি উপন্যাস লেখেন। প্রথম উপন্যাস ‘আধখানা মানুষ’ প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালে। ২০০৮ থেকে পর পর তিনবছর প্রকাশিত হয় তিনটি উপন্যাস ‘তিন পর্বের জীবন’, ‘কানাগলির মানুষেরা’ ও ‘আজগুবি রাত’। অনুমান করা কঠিন নয় ওই বছরগুলোতে ভীষণ সক্রিয় ও সৃজনশীল ছিলেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তার সর্বশেষ উপন্যাস ‘দিনরাত্রিগুলি’ প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে।একটা বিষয় খুবই লক্ষণীয় সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ছোটগল্প ও উপন্যাসের নামের ভেতর ‘মানুষ’, ‘জীবন’ ও ‘রাত্রি’র উপস্থিতি। অন্ধকারাচ্ছন্ন ও প্রহেলিকাকাময় রাত্রি অধিকার করে আছে তাঁর বাস্তবাশ্রিত কল্পনায় লেখা গদ্যের প্রচুর পৃষ্ঠা।

বাংলা ও ইংরেজি- দুটি ভাষাতেই দখল রয়েছে এমন লেখকের সংখ্যা খুব বেশি নয়।দুভাষাতেই প্রবল দখল রয়েছে এমন লেখক বিরল। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সেই বিরল লেখকদের একজন। দু ভাষাতেই তার স্বচ্ছন্দ যাতায়াত। তিনি একজন শক্তিমান অনুবাদক। ইংরেজিতে একটা কথা আছে He who can think clearly, can write clearly। সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের বেলায় এর সাথে যোগ হবে can also speak clearly। তিনি একজন চিত্তাকর্ষক বক্তা।আমি অনেক অনুষ্ঠানে, যার ভেতর দিল্লির উৎসবের অনুষ্ঠান রয়েছে, তাঁর বক্তৃতা শুনেছি। তাঁর ব্যক্তিত্বের মতোই শান্ত এক স্বরে, নম্রমাধুর্যে তিনি জ্ঞানের দীপ্তি বিচ্ছুরণ করেন। তাতে কোনো ভণিতা নেই, রয়েছে দৃঢ়তা। যা বিশ্বাস করেন তাই বলেন। আমার বেশিরভাগ সময়ে মনে হয়েছে তাঁর বক্তৃতা লিখিতরূপে এলে প্রবন্ধের রূপ নিবে।

এত মেধা ও কীর্তি যে মানুষটির, তিনি কিন্তু সদাস্মিত, প্রাণবন্ত ও আন্তরিক এক ব্যক্তিত্ব। পোষাক-আষাকে তিনি দারুণ আধুনিক ও স্মার্ট। এবার দিল্লি উৎসবে দেখেছি তিনি অনুজদের সাথে শুধু যে যাত্রাপথে বাসে এবং দিনভর উৎসব প্রাঙ্গণে আলাপ করছেন তাই নয়, দিন শেষে আমরা যখন ফিরে এসেছি রাত্রিবাসের ডেরায়, ডিনার শেষে ফের বসেছেন অনুজদের সাথে আড্ডায়। আমার দুর্ভাগ্য অনলাইনে ক্লাস নেবার কারণে আমি সে আড্ডাগুলো মিস করেছি। ‘অলস দিনের হাওয়ায়’ তিনি যেভাবে গল্প করেছেন, তেমনি স্বচ্ছন্দে তিনি গল্প করেন। সকল কথাসাহিত্যিকই মূলত story teller। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম একজন অপূর্ব গল্পকথক। তার কথামালা থেকে যেমন আশ্চর্য সব ঘটনা শোনা যায়, শেখা যায় অনেক কিছু, তেমনি দশদিগন্ত সম্পর্কে চোখও খুলে যায়। নয়ডা থেকে প্রতিদিন সকালে দিল্লি যাবার পথে ও ফিরে আসার যাত্রায়, আমি দেখেছি কবি শাহেদ কায়েস, ওই গল্প শোনার লোভে, তার পাশে গিয়ে বসতেন। আমার অতো সাহস হতো না, কিন্তু আমি থাকতাম কাছাকাছি। পাশে গিয়ে না বসার আরেকটি কারণ আমার ছবি তোলার বাতিক, যা তাঁর অপছন্দ। একবার তো ছবি তুলতে গিয়ে মৃদু তিরস্কৃত হলাম। একজন শিক্ষক যেভাবে বকেন ছাত্রকে, তেমনিভাবে আমাকে বকলেন। অবশ্য সে বকুনির মাঝেও আমি মমত্ব টের পেয়েছি। এবার উৎসব শেষে বিদায় নেবার সময় আমি তার সাথে যখন হাত মেলাতে গেলাম, আমাকে অবাক করে তিনি বললেন, “আলিঙ্গণ করবে না?” অপ্রস্তুত হয়ে আমি আলিঙ্গণ করি এক উষ্ণ ও মহৎপ্রাণকে, আমাদের সময়কার এক প্রতিভাবান লেখক ও শিক্ষককে।

আপনাকে জন্মদিনের অঢেল শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা জানাই, স্যার। ফসওয়াল সাহিত্য পুরস্কার ২০২৪ প্রাপ্তির জন্য অভিনন্দন!

- Advertisement -spot_img
আরও সংবাদ
- Advertisement -spot_img
এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here