মঙ্গলবার, অক্টোবর ৭, ২০২৫
Homeঅর্থনীতিজামালপুর জেলার কয়েকটি দর্শনীয় স্থান

জামালপুর জেলার কয়েকটি দর্শনীয় স্থান

নুর এমডি চৌধুরী সম্পাদক, বার্তা বাংলাদেশ

 জামালপুর জেলা ময়মনসিংহ বিভাগের একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী জেলা যা ১৯৭৮ সালে গঠিত হয়। এটি ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত একটি জেলা। এটি বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের একটি জেলা।
উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্য ও কুড়িগ্রাম এবং শেরপুর জেলা। পূর্বে ময়মনসিংহ ও শেরপুর জেলা। দক্ষিণে টাঙ্গাইল জেলা। পশ্চিমে যমুনা নদী এবং বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও গাইবান্ধা জেলা। জামালপুর জেলা যমুনা নদী এবং পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত।
প্রশাসনিক কাঠামো জামালপুর জেলা ৭টি উপজেলা, ৭টি থানা, ৮টি পৌরসভা, ৬৮টি ইউনিয়ন এবং ৮৪৪টি মৌজা নিয়ে গঠিত। এই জেলায় প্রচুর পরিমাণে ধান, পাট, আখ, গম, কাচামরিচ এবং চিনাবাদাম চাষ হয়। সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য জামালপুর নকশীকাঁথা ও হস্তশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ। এখানে প্রাচীন সুফি সাধক হযরত শাহ জামাল (রহঃ) ও হযরত শাহ কামাল (রহঃ) এর নামে পরিচিতি রয়েছে। 

লাউচাপড়া পিকনিক স্পট:
লাউচাপড়া অবসর বিনোদন কেন্দ্র বা লাউচাপড়া পিকনিক স্পট (Lauchapra Picnic Spot) বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত ঘেষা জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের পশরা সাজিয়ে থাকা লাউচাপড়ার পাহাড়, অরণ্য, লেক এবং আদিবাসীদের স্বতন্ত্র জীবনধারা দেশি বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করে। পর্যটকদের সুবিধার জন্য জামালপুর জেলা পরিষদ ১৯৯৬ সালে গারো পাহাড়ে ২৬ একর জায়গা জুড়ে ‘নিকা’ পিকনিক স্পট নির্মাণ করে। পিকনিট স্পটের প্রায় ১৫০ ফুট উঁচু পাহাড়ের উপর আরও ৬০ ফুট উঁচু একটি ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে। এই ওয়াচ টাওয়ারের উপর থেকে সারি সারি সবুজ পাহাড়, মেঘের লুকোচুরি খেলা এবং অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করা যায়। আর লাউচাপড়া পিকনিক স্পটে শিশুদের জন্য রয়েছে দোলনা, স্লিপার সহ বেশকিছু রাইড এবং গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। পার্কে প্রবেশ করতে দশ টাকা দিয়ে টিকেট সংগ্রহ করতে হয়।

কিভাবে যাবেন:
লাউচাপড়া পিকনিক স্পট জামালপুর জেলায় অবস্থিত হলেও ঢাকা থেকে ভ্রমণ করতে চাইলে শেরপুর জেলা হয়ে যাওয়া সবচেয়ে সুবিধাজনক। ঢাকা থেকে ড্রীমল্যান্ড পরিবহন বা আপনার সুবিধামত বাসে চড়ে শেরপুর এসে সেখান থেকে অন্য বাসে বকশীগঞ্জ চলে আসুন। বকশীগঞ্জ থেকে রিকশা বা ভ্যানে করে সহজে লাউচাপড়া পিকনিক স্পট যাওয়া যায়।

মালঞ্চ মসজিদ:
জামালপুর জেলার মেলান্দহ উপজেলার মালঞ্চ শিশু ও চক্ষু হাসপাতালের কমপ্লেক্সে কারুকার্য মণ্ডিত দৃষ্টিনন্দন মালঞ্চ মসজিদ (Maloncho Jame Mosque) অবস্থিত। সাবেক সচিব ও ইউনাইটেড ট্রাস্টের সহযোগিতায় মাজার, মসজিদ, কামিল মাদ্রাসা, মহিলা মাদ্রাসা, হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও ইসলামিক মিশনের সমন্বয়ে প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশে দৃষ্টিনন্দন এই মালঞ্চ কমপ্লেক্সটি নির্মাণ করা হয়েছে। সবুজ গাছ-গাছালীতে ঘেরা এক গম্বুজ বিশিষ্ট মালঞ্চ মসজিদের সামনে একটি স্বচ্ছ পানির দীঘি রয়েছে। নান্দ্যনিক সৌন্দর্যের জন্য বর্তমানে মালঞ্চ কমপ্লেক্সটি জামালপুর জেলার একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে।

কিভাবে যাবেন;
ঢাকা থেকে সড়ক ও রেলপথে জামালপুর যাওয়া যায়। তবে ঢাকা থেকে ট্রেনে জামালপুর যাওয়া বেশী সুবিধাজনক। কমলাপুর রেলওয়ে ষ্টেশন থেকে যমুনা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও অগ্নিবিনা এক্সপ্রেস ট্রেনে জামালপুর যাওয়া যায়। আর মহাখালী বাস স্ট্যান্ড থেকে মহানগর, এনা কিংবা রাজিব পরিবহণের বাসে জামালপুর যেতে পারবেন। জামালপুর জেলা শহর থেকে বাস বা সিএনজিতে চড়ে ৮ কিলোমিটার দূরে মালঞ্চ বাজারের কাছে অবস্থিত মালঞ্চ কমপ্লেক্সে যাওয়া যায়। যমুনা সিটি পার্ক ইত্যাদি।

শাহ জামালের মাজার;
জামালপুর জেলা সদরের ব্রহ্মপুত্র নদী তীরে চাপাতলি ঘাটের কাছে অত্র অঞ্চলের বিখ্যাত সাধক পুরুষ পীর শাহ জামালের মাজার শরীফ (Shah Jamaler Mazar) অবস্থিত। ১৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে হযরত শাহ জামাল (রহঃ) ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্য ইয়েমেন থেকে এই অঞ্চলে আগমণ করেন। সুফি দরবেশ পীরে কামেল হযরত শাহ জামাল (রহঃ) এর আধ্যাত্মিক ক্ষমতার কথা মুঘল দরবার পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। তখন বাদশা আকবর হযরত শাহ জামাল (রহঃ) এর খানকা শরীফের সমস্ত ব্যয় বহন করার আগ্রহ পোষণ করেন। সেই সাথে হযরত শাহ জামাল (রহঃ) এর কাছে কয়েকটি পরগনা দানের সনদ পাঠান। কিন্তু হযরত শাহ জামাল (রহঃ) এই লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাণ করেন। হযরত শাহ জামাল (রহঃ)-এর কারণে এ অঞ্চল জামালপুর নামে পরিচিতি লাভ করে।

বর্তমানে হযরত শাহ জামালের মাজার শরীফের নির্মাণে আধুনিকায়ন করা হয়েছে। আর সমাধিস্থলের পাশে একটি পুরাতন ঐতিহ্যবাহী মসজিদ রয়েছে। প্রতি বছর ধারাবাহকভাবে এখানে ওরস মাহফিল অনুষ্টিত হয়। এছাড়া প্রতিদিন অসংখ্য ভক্ত মাজার শরীফ জিয়ারত এবং বিভিন্ন উদ্দেশ্যে এখানে মানত করতে আসে।

লুইস ভিলেজ রিসোর্ট এন্ড পার্ক:
জামালপুর জেলা সদরের বেলটিয়ায় নিরিবিলি পরিবেশে লুইস ভিলেজ রিসোর্ট এন্ড পার্ক (Luis Village Resort and Park) গড়ে তোলা হয়েছে। ২০১৬ সালে প্রায় ১০ একর জায়গাজুড়ে নির্মিত এই পার্কটি ইতিমধ্যেই ময়মনসিংহ বিভাগের মধ্যে সর্বাধুনিক বিনোদন কেন্দ্র হিসাবে সারাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। লুইস ভিলেজ রিসোর্ট এন্ড পার্কে ওয়ান্ডার হুইল, বাম্পার কার, সুইং চেয়ার, মেরী গো রাউন্ড, মিনি ট্রেন, কফি কাপ এবং বোট রাইডিংসহ সর্বমোট ১৪ টি দেশি বিদেশি রাইড রয়েছে।

লুইস ভিলেজ রিসোর্ট এন্ড পার্কে আরো আছে শিশুদের খেলনা ও হস্তশিল্প পণ্যের দোকান, ফাস্টফুড কর্ণার, পরিচ্ছন্ন রেস্টুরেন্ট এবং রাত্রিযাপনের জন্য রিসোর্টের সুবিধা। এছাড়া যেকোন ধরণের অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য এখানে একটি কনভেনশন সেন্টার রয়েছে।

দয়াময়ী মন্দির:
দয়াময়ী মন্দির (Doyamoyee Temple) জামালপুর জেলা শহরের জিরো পয়েন্টে অবস্থিত একটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা। ১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর আমলে শ্রীকৃষ্ণ রায় চৌধুরী এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় ৬৫ শতাংশ জমির উপর নির্মিত দয়াময়ী মন্দিরে আলাদাভাবে শিব, কালি, নাটমন্দির এবং মনসা দেবীর মন্দির স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া দয়াময়ী মন্দিরে শতবর্ষ পুরনো কারুকার্য খচিত বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন চিত্রকর্ম রয়েছে।

প্রায় ৩২১ বছরের পুরনো দয়াময়ী মন্দিরে প্রতিদিনই বিভিন্ন পূজা অর্চণা আয়োজন করা হয়ে থাকে এবং প্রতি বছর অষ্টমী মেলায় আগত হিন্দুধর্মালম্বীরা বিভিন্ন দেবতার উদ্দেশ্যে মানত করে থাকেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পর্যটকদের সুবিধার জন্য ঐতিহাসিক মন্দিরটি প্রতিদিন সকাল ৬ টা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত খোলা থাকে।

গান্ধী আশ্রম (Gandhi Ashram) জামালপুর জেলা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে ঝিনাই নদীর তীরে অবস্থিত। ১৯৩৪ সালে জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার ঝাউগড়া ইউনিয়নের কাপাস হাটিয়া গ্রামে আশ্রমটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ততকালীন জামালপুর মহাকুমার কংগ্রেসের সম্পাদক কৃষক নেতা নাসির উদ্দিন সরকার নামের এক ব্যক্তি। গান্ধিজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এ আশ্রমটি এক একর জায়গার উপর প্রতিষ্ঠা করা হয়। আশ্রমে সেবামূলক বেশকিছু কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। এখানে প্রতিদিন বহুদর্শনাথী আশ্রমটি দেখার জন্য আসেন।

ব্রিটিশ শাসিত ভারত বর্ষে পরাধীনতার শৃংখল মোচনের লক্ষ্যে পরিচালিত লড়াই-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় স্বদেশের হিতব্রতে মানব কল্যাণের লক্ষ্যে গড়ে তোলা হয়েছিলো জামালপুর গান্ধী আশ্রম। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলনের পথ রেখা ধরেই ১৯৩৪ সালে গান্ধী আশ্রমের প্রতিষ্ঠা। নাছির উদ্দিন সরকারের জ্যৈষ্ঠ কন্যা রাজিয়া খাতুন ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। আশ্রমের কার্যক্রমের মধ্যে ছিল খাদি কাপড় বোনা থেকে শুরু করে শিক্ষা কার্যক্রম, পাঠাগার, স্বাবলম্বন, হস্ত-কারুশিল্প তৈরী, শরীর চর্চা, বৃক্ষ রোপণ, স্বাস্থ্য সেবা সহ স্বদেশের হিতব্রতে বিবিধ কর্মসূচী। স্বদেশ চেতনা ও দেশ প্রেমে তরুন সমাজকে উদ্বুদ্ধ করাই ছিল আশ্রমের অন্যতম লক্ষ্য। পারিকস্তানী শাসক চক্র ১৯৪৮ সালে বার বার হামলা ও আক্রমন চালিয়ে আশ্রমের বহ স্থাপনা গুড়িয়ে দেয়, টিকে থাকে শুধু অফিস গৃহটি।

প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া আশ্রমটি আবার পুনর্জাগরিত করেছেন নাসির উদ্দিন সরকারের নাতি হিল্লোল সরকার এবং উৎপল কান্তি ধরসহ এলাকার বিভিন্ন স্তরের মানুষ। বর্তমানে আশ্রম পরিচালনার দায়িত্বে আছেন হিল্লোল সরকার। একটি ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত হয় সব কার্যক্রম।

টিকে থাকা অফিসঘরটি সাজানো হয়েছে মহাত্মা গান্ধীর বিভিন্ন কার্যক্রমের ছবি ও তথ্য দিয়েছ। এখানে ভারতবর্ষের ব্রিটিশপূর্ব, ব্রিটিশ-পরবর্তী তৎকালীন পাকিস্তান, ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধসহ ইতিহাসের নানা আলোকচিত্র প্রদর্শনী করা রয়েছে। এর পাশেই গড়ে উঠেছে মুক্তিসংগ্রাম জাদুঘর। জাদুঘরটি দোতলা। নিচতলায় আলোকচিত্র দিয়ে সাজানো। এর মধ্যে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গ করা সাত বীরশ্রেষ্ঠর ছবি–সংবলিত তথ্য। এর পাশেই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য ফাঁসির কাষ্টে জীবন উৎসর্গকারীদের নামসহ নানা তথ্য–সংবলিত বোর্ড। জাদুঘরের সিঁড়ির কাছেই খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা। রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময় ১১ নম্বর সেক্টরের একটি মানচিত্র, জামালপুর-টাঙ্গাইল অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত নানা ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নানা তথ্য, বাংলার নবাব মির কাশিম, নবাব সিরাজউদ্দৌলার ইতিহাস রয়েছে। সন্ন্যাসী, ফকির বিদ্রোহসহ টিপু পাগলের নেতৃত্বে ময়মনসিংহ অঞ্চলের পাগলপন্থীদের বিদ্রোহের নানা ইতিহাসও রয়েছে।

গান্ধী আশ্রম ও মুক্তিসংগ্রাম জাদুঘরে স্বদেশি আন্দোলনের সময়কার আশ্রমে ব্যবহৃত চরকা, চেয়ার-টেবিল, পুরোনো সিন্দুক, তখনকার ছাত্রীদের তৈরি নানা সূচিকর্ম ছাড়াও আশ্রমের পাঠাগারে রয়েছে দুর্লভ বইয়ের এক বিশাল সংগ্রহ। রয়েছে মুক্তিসংগ্রামের নানা স্মৃতিচিহ্ন, ছবি, বিভিন্ন বধ্যভূমির মাটি। বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ঐতিহাসিক কালপর্বভিত্তিক ইতিহাস গ্যালারিও রয়েছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নানা ইতিহাসে সমৃদ্ধ এই জাদুঘর। একই সঙ্গে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর একটি গ্যালারিও।

এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠির উদ্যোগে ২০০৭ সালে ০২ অক্টোবর মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিন উপলক্ষে জাতিসংঘ আহুত আন্তর্জাতিক অহিংস দিবস উদযাপনের মধ্য দিয়ে পুনরায় শুরু হয় মানব কল্যাণের জামালপুর গান্ধী আশ্রমের শুভধ্যায়ীনানা কার্যক্রম।

গান্ধী আশ্রম যাওয়ার উপায়জামালপুর এবং মেলান্দহ হতে সড়ক পথে খুব সহজেই সরাসরি গান্ধী আশ্রম যাওয়া যায়। উভয় স্থান থেকেই দূরত্ব মাত্র ১৫ কি.মি.। জামালপুর সদর উপজেলার গেট পার থেকে অটোরিক্সা নিয়ে যেতে হবে হাজীপুর বাজার অথবা সরাসরি জাদুঘরে। জামালপুর সদর উপজেলা থেকে কাপাসহাটিয়া যেতে খরচ পড়বে জনপ্রতি ৫০-৬০ টাকা। রাস্তা সরু হওয়ায় মাইক্রোবাস নিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও বড় বাস নিয়ে যাওয়া যাবে না।

খরকা বিল:
খরকা বিল বাংলাদেশের জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ উপজেলার একটি জলাশয়। অতীতে এটি সরাসরি যমুনা নদীর সাথে সংযুক্ত ছিল, কিন্তু বর্তমানে এটি নদী থেকে বিচ্ছিন্ন।

খরকা বিলের উৎপত্তির সঠিক সময় অজানা, তবে ধারণা করা হয় এটি ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এক ভয়াবহ ভূমিকম্পের ফলে তৈরি হয়েছিল। ঐতিহাসিকভাবে খরকা বিল তার গভীরতা এবং প্রচুর পরিমাণে মাছের জন্য মাদারগঞ্জের মাছের আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত ছিল। এই বিল মাদারগঞ্জ অঞ্চলের অর্থনীতি এবং মৎস্য সম্পদের বেশিরভাগই সরবরাহ করত।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়, খরকা বিলের পাশে বদি কোম্পানি নামে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্প ছিল, যা মুক্তিযুদ্ধের সময় এই অঞ্চলে ঐতিহাসিক তাৎপর্য বহন করে। খরকা বিল সম্পর্কে বিভিন্ন কবি সাহিত্যিক গল্পকার গল্প এবং কবিতা লিখে গেছেন, যা বিলের সাংস্কৃতিক তাৎপর্য এবং স্থানীয় লোককাহিনীর অন্তর্গত।

সম্প্রতি বিলটিতে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এটি এখন জামালপুর জেলার অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। এখানে একটি সুন্দর সেতু নির্মিত হয়েছে। খরকা বিলের উপর এলজিইডি কর্তৃক নির্মিত ২৬০ মিটার দীর্ঘ সেতুর নির্মাণ কাজ ২০২০ সালের প্রথম দিকে শুরু হয়েছিল এবং বর্তমানে উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ভূমিকম্পের ফলে বিলের উৎপত্তির ধারণাটি স্থানীয় লোককাহিনী এবং বিলের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে বিদ্যমান। সেতু এবং মহাসড়ক নির্মাণের মতো অবকাঠামোগত উন্নয়ন বিলের পর্যটন সম্ভাবনাকে বয়পকভাবে বাড়িয়ে তুলেছে। তবে, বিল ভরাট করে নির্মাণ কাজের ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের সাথে পরিবেশ সুরক্ষার দ্বন্দ্ব দেখায়।

স্থানীয় অর্থনীতিতে খরকা বিলের গুরুত্ব:
স্থানীয় অর্থনীতিতে খরকা বিল ছিল আঞ্চলিক মৎস্য সম্পদের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। তাই এটি মাদারগঞ্জের মাছের ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। সময়ের সাথে সাথে, এটি মাছ সরবরাহকারী থেকে পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়েছে, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে এর বিশেষ প্রভাব পড়েছে। মাদারগঞ্জউপজেলা একটি কৃষিপ্রধান অঞ্চল হওয়ায়, বিলের পানি কৃষিতে এখন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে বিলটিকে ঘিরে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একটি সুন্দর সেতু নির্মাণ করা হয়েছে, পাশাপাশি একটি প্রশস্ত হাওয়াই রোডও তৈরি করা হয়েছে, যা এখন পর্যটকদের জন্য অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। হাতিরঝিলের আদলে বিলটি নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। বিলের পাশে একটি মিনি স্টেডিয়াম এবং একটি আধুনিক পৌর ভবন নির্মাণের পাশাপাশি এটি হাঁটার পথ, বৃক্ষরোপণ এবং আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করে পর্যটকদের আরও আকৃষ্ট করবে। এর ফলে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের অর্থনীতিতে পর্যটনের অবদান বৃদ্ধি পাবে।

 

খরকা বিলের পরিবেশগত অবস্থা এবং সমস্যা:
খরকা বিল বর্তমানে বিভিন্ন পরিবেশগত সমস্যার সম্মুখীন। আশ্রয়ণ প্রকল্প নির্মাণের জন্য বিলের একটি অংশ ভরাট করা হচ্ছে। স্থানীয়রা আশঙ্কা করছেন যে এই ভরাটের ফলে পুরো বিলটি ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাবে। ১৯৯৩ সালে, বিলের সাত একর জমির ৪০ শতাংশ জমি পরিবর্তন করা হয়েছিল এবং বর্তমানে সেখানে আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাজ চলছে। উপজেলা পরিষদের জন্য একটি নতুন ভবন নির্মাণের জন্য বিলের কিছু অংশ ভরাট করা হয়েছে।

বিল ভরাটের ফলে এর জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলস্বরূপ, হ্রদের জল দূষণের জন্য অসংখ্য মাছ এবং জলজ প্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে । এর ফলে দীর্ঘমেয়াদী পরিবেশগত এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে।

সংরক্ষণ এবং উন্নয়ন প্রচেষ্টা: খরকা বিল সংরক্ষণের জন্য স্থানীয়রা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন। বিলের ঐতিহ্য সংরক্ষণ করে হাতিরঝিলের আদলে এটি সংস্কার করে নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। উপজেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ অফিস সূত্রে জানা গেছে, ভায়াডাক্টসহ ২৬০ মিটার দীর্ঘ সেতুটির নির্মাণ ব্যয় ২৩ কোটি ৫১ লক্ষ ৮৪ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। সেতু নির্মাণের ফলে বিলের সহজলভ্যতা উন্নত হয়েছে এবং পর্যটন সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সেতু নির্মাণ এবং পর্যটন কেন্দ্র তৈরির ফলে বাস্তুতন্ত্রের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে কিনা তা বিবেচনা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।

- Advertisement -spot_img
আরও সংবাদ
- Advertisement -spot_img
এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here