ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের গাজামুখী নৌবহরের অংশ হিসেবে কনশেনস নামের একটি জাহাজে আছেন আলোকচিত্রী শহিদুল আলম এবং দৃকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। জাহাজটিতে জীবন কেমন কাটছে,তাদের কী কী কাজ করতে হচ্ছে, প্রতিদিন এমন সব তথ্যই শেয়ার করেছেন আলোকচিত্রী শহিদুল আলম।
গতকাল রোববার (৫ অক্টোবর) তিনি তাঁর সমুদ্রযাত্রার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে লিখিত বর্ণনা দিয়েছেন। ইংরেজিতে লেখা তাঁর সে লেখাটি পাঠকদের জন্য ভাষান্তর করে প্রকাশ করা
হলো।

আজ সকালে আমরা গাজা উপত্যকায় অবস্থানরত চিকিৎসকদের সঙ্গে একটি ভিডিও কনফারেন্স করেছি। সত্যিকার অর্থেই আমরা যাঁরা কনশেনসে অবস্থান করছি তাদের সবার জন্য এটি একটি আবেগঘন মুহূর্ত ছিল—একদিকে গাজা বাসীকে এখনও সেবা দিয়ে যাওয়া মানুষের সাহসিকতা, অন্যদিকে বারবার নিষ্ঠুরতার মুখোমুখি হচ্ছেন সবাই এ যেন এক জীবন মরন সন্দধিক্ষনে।
গাজার হাসপাতালে হামলার বিষয়ে সাবেক সহকর্মীদের মুখ থেকে বিস্তারিত জানার পর কনশেনসে থাকা চিকিৎসক হ্যান বোসেলায়ের্স কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ দৃশ্য আমাকেও মনে করিয়ে দেয় যে আমাকে খুব সম্ভবত আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে কেন এই অভিযান জরুরি। এখানকার দৈনন্দিন জীবন সম্পর্কে মানুষকে ধারণা দেওয়া প্রয়োজন। কনশেনস জাহাজটি দীর্ঘ ভ্রমণের উপযোগী করে তৈরি হয়নি। এটি ১৯৭২ সালে বানানো একটি পুরোনো জাহাজ। মূলত অল্প দূরত্বে ভ্রমণের জন্য এটি নির্মাণ করা হয়েছে। তাই এখানে অনেক সীমাবদ্ধতা আছে।
১. যাত্রীদের ঘুমানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। কেবিনগুলো শুধু ক্রুদের জন্য সংরক্ষিত। অথচ যাত্রীদেরই সবচেয়ে বেশি ঘুমানো প্রয়োজন। সে কারণে আমরা বাকিরা সবাই মেঝেতে থাকছি। আমরা স্লিপিং ব্যাগ এবং ছোট ছোট বালিশ এনেছিলাম। এ ছাড়া অন্য কিছু তেমন একটা নেই। কারণ, প্রত্যেকে কেবল ১০ কেজি করে জিনিস আনতে পেরেছি। এখানে বিশুদ্ধ পানির খুব অভাব। সে কারণে প্রত্যেককে খুব হিসাব করে পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে। পুরো জাহাজের কারোরই গোসল নেই।
২. যে ক্রুরা জাহাজটি চালাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে কোন সার্ভিস স্টাফ নেই। সে কারণে জাহাজের ভেতর সব কাজ আমাদের নিজেদেরই করতে হচ্ছে। শৌচাগার পরিষ্কার থেকে শুরু করে পুরো জাহাজ পরিষ্কার, আবর্জনা পরিষ্কার, খাবার সরবরাহ, রান্নাঘর পরিষ্কারের মতো কাজগুলো করছি।
৩. অবশ্যই এখানে অতিরিক্ত নিরাপত্তার প্রয়োজন আছে। তাই আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ড্রোন দিয়ে নজরদারি চালাচ্ছে। পাশাপাশি খুব কঠোর কিছু বিধিনিষেধও মেনে চলতে হচ্ছে।
৪. আমরা এখানে যারা আছি, তারা মূলত সাংবাদিক ও স্বাস্থ্যকর্মী। সে কারণে কীভাবে একটি জাহাজের কার্যক্রম চলে বা হামলার সময় কী করতে হবে, তা আমরা কেও জানি না। তাই লাইফ জ্যাকেট ব্যবহার করা থেকে শুরু করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরার মতো বিষয়গুলো নিয়ে এখানে অনেক নিরাপত্তা মহড়া করা হয়। যদি আমরা নিয়মগুলো ঠিকভাবে অনুশীলন না করি, তাহলে হামলার সময় ৯৬ জন মানুষ দ্রুত কোথাও যাওয়ার চেষ্টা করলে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে। তাই প্রতিদিন একাধিক নিরাপত্তা মহড়া চালানো হয়।
৫. সমুদ্র কখনো কখনো খুবই উত্তাল হয়ে ওঠে। আমরা সাধারণত সমুদ্রযাত্রায় অভ্যস্ত নই, তাই আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি। কেউ কেউ আবার অনেক বেশি অসুস্থ হয়ে যান। সৌভাগ্যের বিষয় হলো, এখানকার চিকিৎসাকর্মীদের দলটি খুব ভালো। তবে কেউ অসুস্থ হলে তাঁর দায়িত্ব অন্যদের ভাগ করে নিতে হয়, যা সব সময় সহজ হয় না।
৬. আমরা যাঁরা সাংবাদিক আছি, তাঁরা ছবি তুলছি, ভিডিও ধারণ করছি, নিবন্ধ লিখছি, জাহাজের মানুষের সাক্ষাৎকার নিচ্ছি এবং পাশাপাশি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিচ্ছি। এত অনিশ্চয়তার মধ্যে এগুলো সময়মতো করাটা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ছে।
৭. এসবের পাশাপাশি আমাদের স্থলভাগে থাকা কারিগরি ও গণমাধ্যমকর্মীদের দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, আইনগত দলকে পরিস্থিতি সম্পর্কে সর্বশেষ তথ্য দেওয়া এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পরিচালনা–সংক্রান্ত কাজগুলো করতে হয়।
৮. নিরাপত্তা–সম্পর্কিত বিষয়ও আছে। এর জন্য আমাদের নিয়মিত ফ্লোটিলার অন্যান্য জাহাজ থেকে তথ্য নিতে হয়, ফিলিস্তিনে বসবাসকারীদের কাছ থেকে তথ্য নিতে হয় এবং সব দেশের সমন্বয়কারী দলের কাছ থেকে তথ্য নিতে হয়। এ ছাড়া সমস্যা দেখা দিলে প্রতিবারই পরিকল্পনা বদলাতে হয়। যেমন অপেক্ষাকৃত দুটি ছোট জাহাজে ইঞ্জিনের সমস্যা দেখা দিয়েছিল, এতে ভ্রমণ বাতিল করতে হয়েছে।
সুতরাং এখানে খাবার, পানি, শৌচাগারের সীমাবদ্ধতা আছে এবং ঘুমানোর ব্যবস্থাটাও সুবিধার নয়। সমুদ্র যখন উত্তাল হয়, তখন সবকিছু আরও জটিল হয়ে পড়ে। তাই দয়া করে ব্যক্তিগত আপডেট চাইবেন না। হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগে বিনীতভাবে ‘না’ কথাটি বলতেও সময় লাগে।